কক্সবাংলা ডটকম(৯ নভেম্বর) :: কয়েক দশকের প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে বাবরি মসজিদ নিয়ে ঐতিহাসিক অযোধ্যা মামলার রায় ঘোষণা করেছে ভারতের সুপ্রিমকোর্ট। শনিবার ভারতের প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈর নেতৃত্বে সুপ্রিমকোর্টের পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চ এই রায় দিয়েছে। এতে বাবরি মসজিদের জায়গা নিয়ে সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডের আর্জি এবং হিন্দুত্ববাদী সংগঠন নির্মোহী আখড়ার দাবি দুটোই খারিজ করে দেওয়া হয়েছে।
শীর্ষ আদালত জানিয়েছে, অযোধ্যার ওই বিতর্কিত জমি পাবে ‘রাম জন্মভূমি ন্যাস’। এই জমিতে মন্দির তৈরিতে কোনো বাধা নেই। তবে কেন্দ্রীয় সরকারকে সুপ্রিমকোর্টের নির্দেশ- তিন মাসের মধ্যে একটি ট্রাস্ট গঠন করতে হবে। ওই ট্রাস্টের তত্ত্বাবধানেই থাকবে বিতর্কিত মূল জমি। কীভাবে কোন পদ্ধতিতে মন্দির তৈরি হবে, তারও পরিকল্পনা করবে সেই ট্রাস্ট।
অন্যদিকে সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডকে মসজিদ নির্মাণের জন্য বিকল্প ৫ একর জমি দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ কোনো জায়গায় ওই জমির বন্দোবস্ত করতে হবে সরকারকে। তবে ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা বেআইনি ছিল বলেও স্বীকার করেছেন আদালত। আবার এটিও বলা হয়েছে, বিতর্কিত এই জমির ওপর রামলালার অধিকার স্বীকার করে নেওয়াটা আইনশৃঙ্খলা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার প্রশ্নের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
আনন্দবাজার পত্রিকা বলছে, এই রায়ে বাবরির বিতর্কিত জমির ওপর বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কর্তৃত্বও খর্ব হলো, যারা ১৯৯২ সালে মন্দির নির্মাণের জন্য মসজিদ ভেঙেছিল। কারণ জমিটি এখন ট্রাস্টের অধীনে চলে যাবে এবং ট্রাস্টি বোর্ড মন্দির নির্মাণসহ সেটির দেখভালের দায়িত্বে থাকবে।
রায় পড়ে শোনানোর সময় প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ বলেন, ‘মোগল সম্রাট বাবরের সেনাপতি মির বাকি যে এই মসজিদ তৈরি করেছিলেন, তার প্রমাণ রয়েছে। তবে সেটা কোন সালে তা নির্ধারিত নয় এবং তারিখ গুরুত্বপূর্ণও নয়। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার (এএসআই) খননে ওই মসজিদটির নিচে অন্য কাঠামোর প্রমাণ মিলেছে। তবে সেই কাঠামো থেকে এমনও দাবি করা যায় না যে, সেগুলো কোনো মন্দিরের ছিল। যেহেতু বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে জমির মালিকানা ঠিক করা সম্ভব নয়, তাই আইনের ভিত্তিতেই জমির মালিকানা ঠিক করা উচিত।
আপাতত কেন্দ্রীয় সরকার ওই জমির মালিকানা পাবে। সরকারকে তিন মাসের মধ্যে বোর্ড অব ট্রাস্ট গঠন করে তাদের হাতে বিতর্কিত জমি তুলে দিতে হবে। পরে ট্রাস্টের তত্ত্বাবধানেই বিতর্কিত ২.৭৭ একর জমিতে মন্দির নির্মাণ হবে। সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড ওই জমিতে অধিকার দাবি করতে পারবে না। তবে তারা মসজিদ নির্মাণের জন্য বিকল্প জমি পাবে। অযোধ্যার কেন্দ্রের কোথাও তাদের পাঁচ একর জমি দেওয়া হবে এবং সেখানে তারা মসজিদ নির্মাণ করতে পারবে।’
এই রায় নিয়ে হিন্দু ও মুসলমানরা মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। রায় ঘোষণার পর সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণেই হিন্দুদের ‘জয় শ্রীরাম’ সেøাগান দিয়ে দিতে দেখা গেছে। অন্যদিকে অসন্তোষ প্রকাশ করে সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডের আইনজীবী জাফরিয়াব জিলানি বলেন, ‘আমরা এই রায় মানতে পারছি না। যদিও আমরা রায়ের সব অংশের সমালোচনা করছি না। তার পরও সমস্ত জমি অন্য পক্ষকে দেওয়া ঠিক নয়। আমরা শীর্ষ আদালতকে সম্মান জানাই, কিন্তু রায়ের সঙ্গে সহমত না হওয়ার অধিকার আমাদের আছে। অনেক মামলায়ই রায় পাল্টেছে শীর্ষ আদালত। আমাদের অধিকার আছে রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন জানানোর।’ যদিও পরে সুন্নি ওয়াকফ ট্রাস্টের মুখপাত্ররা বিবিসিকে জানিয়েছেন, তারা রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করবেন না।
রায় ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘আজ এমন এক রায় হলো, যার দীর্ঘদিনের ইতিহাস রয়েছে। দেশবাসীর ইচ্ছে ছিল অযোধ্যা মামলার রায় হোক। অবশেষে সেই রায় এসেছে। এতদিন বিশ্ব জানত, ভারত সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ। কিন্তু আজ বিশ্ব জানতে পারছে গণতন্ত্রের ভিত্তি কতটা শক্তিশালী। এবার নয়া ভারতের সূচনা হবে। নতুন ভারত বিশ্ব জয় করবে।’ রায়কে স্বাগত জানিয়েছে ভারতের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসও।
এদিকে বহুল আলোচিত অযোধ্যা মামলার রায় ঘিরে বিশৃঙ্খলা এড়াতে গতকাল সকাল থেকেই উত্তরপ্রদেশেজুড়ে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। এ ছাড়া কাল সোমবার পর্যন্ত রাজ্যের সব স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। অযোধ্যায় অবশ্য কারফিউ জারি রয়েছে এক সপ্তাহ ধরে। প্রতিবেশী রাজ্য কর্নাটক ও মধ্যপ্রদেশেও একই নির্দেশ জারি হয়েছে বলে জানিয়েছে আনন্দবাজার।
অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে বাবরি মসজিদ ও রাম জন্মভূমি নিয়ে বিরোধ মামলা চলছে। ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বরে বিতর্কিত জমিতে রামের মূর্তি স্থাপনের পরে ফৈজাবাদ আদালতে বাবরি মসজিদের পক্ষে প্রথম মামলা করেন হাসিম আনসারি। ২০১৬ সালে তিনি মারা গেলে তার ছেলে ইকবাল আনসারি মামলার বাদী হন। পরে এই বাবরি মসজিদের বিষয়টি ১৯৮০-এর দশকে ভারতে অন্যতম রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়। স্পর্শকাতর এ মামলাটি নিয়ে নানা টানাপড়েনের পর চলতি বছরের শুরুতে মধ্যস্থতার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টায় ভারতের সুপ্রিমকোর্ট একটি কমিটি গঠন করে দেন।
যদিও ওই কমিটি সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলে নানাভাবে সমাধানে পৌঁছার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। এর পর গত ৬ আগস্ট থেকে বিরতিহীনভাবে মামলার শুনানি হয়। গত ১৬ অক্টোবর চূড়ান্ত শুনানি হলেও রায় প্রদান অপেক্ষমাণ রেখেছিলেন শীর্ষ আদালত। কিন্তু শুক্রবার হঠাৎ করেই সুপ্রিমকোর্ট গতকাল রায় ঘোষণা করা হবে বলে ঘোষণা দেন। রায়ের তারিখ ঘোষণার আগে প্রধান বিচারপতি গগৈ নিজের চেম্বারে ডেকে নিয়ে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী এবং ডিজির সঙ্গে কথাও বলেন।