কক্সবাংলা ডটকম(৩ এপ্রিল) :: টিপ। দুই ভ্রুর মাঝে পরা গোল একটা বৃত্তের রয়েছে নারীর সৌন্দর্যকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেওয়ার জাদুকরী ক্ষমতা।
বাঙালি সংস্কৃতিতে টিপ অবিচ্ছেদ্য অংশ। টিপের আবেদন সেই প্রাচীন কাল থেকে এই যুগেও ম্লান হয়নি এতুটুকুও। উৎসবের জমকালো সাজ কিংবা রোজকার আটপৌরে পোশাক, সবকিছুর সঙ্গেই দারুণ মানিয়ে যায় টিপ।
পহেলা বৈশাখ, পহেলা ফাল্গুনের মতো বাঙালির একান্ত নিজস্ব উৎসব থেকে শুরু করে ঘরোয়া অনুষ্ঠান কিংবা রোজকার জীবনের যেকোনো আয়োজনে, বাঙালির নারীর কপালে শোভা পায় টিপ।
তবে সম্প্রতি বাঙালি ললনার সৌন্দর্যবর্ধক এই টিপ পরাকে কেন্দ্র করে ঘটে গেছে এক ন্যাক্কারজনক ঘটনা। নারীর কপালে জায়গা করে নেওয়া এই টিপ হয়েছে আক্রোশের শিকার।
গত শনিবার রোজকার মতো কলেজে যাচ্ছিলেন রাজধানীর তেজগাঁও কলেজের থিয়েটার অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের প্রভাষক লতা সমাদ্দার। ফার্মগেট মোড় পার হয়ে তেজগাঁও কলেজের দিকে যাওয়ার সময় মোটরসাইকেলে বসা পুলিশের পোশাক পরা এক ব্যক্তি তাকে ‘টিপ পরছোস ক্যান’ বলে গালি দেন। সেখানেই শেষ নয় প্রতিবাদ করায় ওই শিক্ষিকার পায়ের ওপর নিয়ে মোটরসাইকেল চালিয়ে দেন পুলিশের পোশাক পরা ওই ব্যক্তি।
রাস্তাঘাটে হয়রানির শিকার অনেকেই যখন থেমে যান, সেখানে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন লতা সমাদ্দার। আর দশজনের মতো চেপে না নিয়ে শনিবার শেরেবাংলা নগর থানায় লিখিত অভিযোগ করেন তিনি।
আক্রোশের শিকার লতার প্রতিবাদ আলোড়ন তুলেছে নেটদুনিয়ায়। লতার দেখানো পথে টিপকেই প্রতিবাদের হাতিয়ার করেছেন নেটিজেনরা। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়, ‘জাগো সূর্যের টীপ পরি জয়ন্তিকা’ সুরে সুর মিলিয়ে নিজেদের টিপ পরা ছবি পোস্ট করে #টিপ দিয়ে অভিনব প্রতিবাদ শুরু করেছেন তারা। এই প্রতিবাদে শুধু নারীরা নন, সামিল হয়েছেন পুরুষরাও।
একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদকর্মী নাসরিন মৌ তার ফেসবুকে লিখেছেন, আমরা ‘টিপ’ পরবোই। পারলে ঠ্যাকা….বহু কষ্টে দেশ পাওয়া। উড়ে এসে জুড়ে বসা না। বেইমানি করে লুটেপুটে চেটে খাওয়ার খাতায় এখনো নাম লিখানো হয়নি। হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খৃষ্টান-ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এই দেশ আমাদের সবার। অনেক হয়েছে….. আর না….
উন্নয়নকর্মী ফারহানা হাফিজ লিখেছেন, ‘ধীরে ধীরে আমাদের বোধ, মনন, আচার, ব্যবহার গ্রাস হচ্ছে, সংকোচিত হচ্ছে; কার দ্বারা— তার উত্তর গতকাল টিপ পরা নারীটির পায়ের উপর পুলিশ পোশাক পরিহিতের বাইক চালিয়ে নেওয়ার ঘটনায় পাওয়া যায়। খুব সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতায় এসব করে আসার আশকারা পেয়ে আসছে। তাদের প্রথম টার্গেট নারী এবং মাধ্যম অবশ্যই পোশাকের রাজনীতি। কারণ এদেশের উন্নয়ন গতিধারায় নারীরা জোয়ার এনেছে, তা রুখে দিলেই তাদের অর্ধেক কার্যসিদ্ধি হয়।’
বাংলাদেশ যুব মহিলালীগের সাধারণ সম্পাদক ও সংরক্ষিত আসনের সাবেক এমপি অধ্যাপক অপু উকিল লিখেছেন, ‘টিপের সঙ্গে এই উপমহাদেশের অনেক প্রাচীন সম্পর্ক রয়েছে। আমি কপালে টিপ পরতে খুব ভালোবাসি। শুধু ভালোবাসাই নয়, আমি বিশ্বাস করি, টিপের সঙ্গে আমার সংস্কৃতি এবং আস্থা জড়িয়ে রয়েছে।’
সাংবাদিক ও কলামিস্ট মাসুদা ভাট্টি লিখেছিন, টিপটা সবুজ, যা বাংলাদেশকে নির্দেশ করে সব সময়। কিন্তু কারা যেন বাংলাদেশকে (টিপকে) মুছে দিতে চায়…। কালকেই লিখছিলাম- কারা এই নিষ্ঠুর সমাজ তৈরি করছে? অনেকেই অনেক কথা বলেছেন, এই যে দেখুন কারা সমাজকে আরও কট্টর, হিংসাশ্রয়ী করে তুলছে। একটা টিপকে মেনে নিতে যাদের কষ্ট হয় তারা নারীর স্বাধীনতাকে মানবে কেন? ওদিকে একদল করছেন, হিজাব-বোরকা-ছবি না তোলার আন্দোলন, ভগিনীগণ আপনারা কি টিপ পরার স্বাধীনতার পক্ষেও দাঁড়াবেন? নাহলে আপনাদের দাবিতে কেন টিপ-ওয়ালারা গলা মেলাবে বলুন?
ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের নির্বাহী প্রযোজক পিয়া রহমান বিদ্রূপের ভঙ্গিমায় লিখেছেন, ‘আসুন, সবাই টিপ পরি আর দলে দলে ইভটিজিংয়ের শিকার হই! ইভটিজিংকে এনজয় করা শিখি?!’ সঙ্গে তিন নারী সহকর্মীকে নিয়ে হাস্যোজ্জ্বল মুখে ছবি পোস্ট করেছেন তিনি।
সংবাদকর্মী খাদিজাতুল কোবরা ইভা নিজের ফেসবুকে টিপ পরা ছবি পোস্ট করেছে লিখেছেন, ‘একটা রাষ্ট্র টিপ পরতে পারবে না/ এই ঘোষণা দিয়াই আমারে মাইরা ফেলতে পারবে।/ আমি লোনলি হয়া যাবো, শূন্য হয়া যাবো।’
তবে শুধু নারীরাই নন, টিপ নিয়ে এই আক্রোশের বিরুদ্ধে সবর হয়েছেন পুরুষরাও।
সংগীতশিল্পী ও সমাজচিন্তক অরূপ রাহী নিজের কপালে টিপ পরেছেন। সেই ছবি ফেসবুকে দিয়ে ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন অরূপ রাহী লেখেন, না, পুরুষ হইয়া টিপ পড়লেই বুঝা যাবে না ভিন্ন লিংগের উপর ‘৯৯ ভাগের দেশে’ চলা পুরুষতান্ত্রিক পুলিশি। এই পুলিশি সমাজের ‘পুরুষরা’ খালি আত্মীকরণ করে না, নিজেরাও ভুগতে থাকে পুরুষ পারফর্ম করতে গিয়া, অবশ্য সেটা সবাই টের পায় না বা বুঝে না- কেন কীভাবে তারা পুরুষতন্ত্রে ভুগতেছে। তাদের ‘ভালোবেসে’ ঠিক করার দরকার নাই। তাদের প্রতি দরকার আক্কেল গজায়ে দেয়া আচরণ। আমার ক্ষেত্রে হইলেও। ভালোবাসা, প্রেম নিজেদের রূপান্তরের সাধনা, সমাজ রুপান্তরের সাধনা।
কবি ও লেখক, শোয়েব জিবরান এ নিয়ে নিজের ব্যক্তিগত একটি অতীত ঘটনা স্মরণ করে লেখেন, কপালে টিপ পরার কারণে গায়ে মোটর সাইকের উঠিয়ে দেওয়ার ধর্মপুলিশি কাণ্ডে ঘটনাটি আবার মনে পড়ল। বঙ্গবন্ধু অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেন। ১৯৭১ সালে ধর্মভিত্তিক পাকিস্তান রাষ্ট্র থেকে রক্তের বিনিময়ে এ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রটি তৈরি করা হয়েছিল। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের একটি মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রটিকে আবার পাকিস্তানমুখী আদর্শের দিকে পরিচালিত করা হয়েছিল। কিন্তু তার এতোগুলো বছর পর বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সংগঠন রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা অবস্থায় এ ধর্মপুলিশি কাণ্ড সত্যি অবাক করার মতো।
রাষ্ট্রের মূল আদর্শকে চ্যালেঞ্জ করা এ কাণ্ডটির নিশ্চয়ই তদন্ত ও বিচার করা হবে।
‘আমরা সবাই তালেবান/বাংলা হবে আফগান’ এ শ্লোগানের নয়, জয় বাংলা শ্লোগানেরই জয় হবে।
তবে ফেসবুকই নয়, এই ঘটনায় জাতীয় সংসদে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য সুবর্ণা মুস্তাফা। রোববার সংসদে অনির্ধারিত আলোচনায় অংশ নিয়ে সংসদ সদস্য ও অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফা এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রলায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের কোন সংবিধানে, কোন আইনে লেখা আছে যে একজন নারী টিপ পরতে পারবে না? এখানে হিন্দু-মুসলমান, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ এমনকি সে বিবাহিত না বিধবা সেটা বিষয় নয়। একটি মেয়ে টিপ পরেছে। তিনি একজন শিক্ষক। রিকশা থেকে নামার পর দায়িত্বরত পুলিশ অফিসার ইভটিজ করেছে।
Posted ১১:২৯ অপরাহ্ণ | রবিবার, ০৩ এপ্রিল ২০২২
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta