কক্সবাংলা ডটকম(১৭ মার্চ) :: তারল্য সংকটে আছে দেশের ব্যাংকিং খাত। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, গত বছরের নভেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতে ঋণ-আমানতের অনুপাত (এডি রেশিও) ছিল ৮৫ দশমিক ৬ শতাংশ। এ হিসাবায়নের মধ্যে আছে ব্যাংকগুলোয় বড় অংকের সরকারি আমানত। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) গত ফেব্রুয়ারির তথ্য অনুযায়ী, সরকারি আমানত বাদ দিলে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের এডি রেশিও ৯২ শতাংশেরও বেশি।
ব্যাংকার ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে যে উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ, তাতে সরকারি আমানত থেকে ব্যয়ের প্রয়োজন পড়বে। ফলে তুলে নেয়ার প্রয়োজন হবে সরকারি আমানত। এতে বেড়ে যাবে ঋণ-আমানতের অনুপাতও, যা বিপদে ফেলবে ব্যাংকগুলোকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোর হাতে থাকা অতিরিক্ত তারল্য ক্রমেই কমছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে ব্যাংকিং খাতের এডি রেশিও। প্রত্যাশা অনুযায়ী আমানতের সংস্থান না হওয়ায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সহসাই ব্যাংকগুলোর আমানত সংকট কাটবে, এমন আভাস দেখছেন না সংশ্লিষ্টরা।
আইএমএফের হিসাবে, ২০১৬ সালের জুনে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে এডি রেশিও ছিল ৭৫ শতাংশ। সরকারি আমানত বাদ দিলে এ হার ৮০ শতাংশে সীমাবদ্ধ ছিল। এর পর থেকেই ব্যাংকিং খাতে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে এডি রেশিও। ২০১৮ সালের নভেম্বরে এডি রেশিও বেড়ে দাঁড়ায় ৮৫ দশমিক ৬ শতাংশে। সরকারি আমানত বাদ দিয়ে হিসাব করলে ওই সময় ব্যাংকিং খাতের এডি রেশিও ৯২ দশমিক ২ শতাংশ ছাড়ায়।
সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের প্রয়োজনে ব্যাংকগুলোয় থাকা সরকারি আমানত তুলে নেয়ার সম্ভাবনা দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, পদ্মা সেতুসহ একাধিক বৃহৎ অবকাঠামো নির্মাণের কাজ চলছে। বৃহৎ আরো নতুন প্রকল্পের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। জ্বালানি তেল আমদানির পাশাপাশি বৃহৎ ব্যয়ের খাতে যুক্ত হয়েছে এলএনজি। এ ব্যয় সংস্থানে ব্যাংকগুলোয় থাকা সরকারি আমানত তুলে নেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পাশাপাশি ব্যাংক থেকে সরকারের বড় অংকের ঋণ গ্রহণেরও প্রয়োজন পড়বে। এমনিতেই তারল্য সংকটে থাকা ব্যাংকিং খাতের জন্য যা বিপদ ডেকে আনবে।
ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, আমরা ঠিক জানি না, ব্যাংকিং খাতে কী পরিমাণ সরকারি আমানত রয়েছে। সরকার তার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনার স্বার্থেই ব্যাংক থেকে আমানত তুলে নেবে। এর বাইরে ট্রেজারি বন্ডের মাধ্যমে ব্যাংকিং খাত থেকে সরকার ঋণও বাড়াবে। ফলে আগামী দিনগুলোয় ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট আরো বাড়বে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় বন্ড মার্কেটকে বিকশিত করতে হবে। একই সঙ্গে দেশে বাড়াতে হবে বিদেশী বিনিয়োগ।
নতুন মুদ্রানীতিতেও সরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে সরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১০ দশমিক ৯ শতাংশ। এর আগের মুদ্রানীতিতে সরকারি খাতে ৮ দশমিক ৫ শতাংশ ঋণ প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হয়েছিল। আর বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ। যদিও ডিসেম্বর পর্যন্ত তা ১৩ শতাংশ অর্জিত হয়েছে। অর্থবছরের বাকি সময়ে এ ঋণ প্রবৃদ্ধি বাড়ার সম্ভাবনা দেখছেন না বিশেষজ্ঞরা।
তারল্য সংকটের কারণে চলতি অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের আর্থিক খাতে কোনো বৈচিত্র্য নেই। অর্থ সরবরাহের জন্য এখানে ব্যাংকই একমাত্র ভরসা। শেয়ারবাজারের ওপর মানুষের আস্থা না থাকায় বিনিয়োগকারীদের ব্যাংকেই যেতে হয়। ব্যাংকগুলোয় যে আমানত সংকট চলছে, সেটি দ্রুতই কাটিয়ে ওঠা যাবে, এমন কোনো সম্ভাবনা দেখছি না। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রাও ধাক্কা খাবে।
দেশের ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকটের শুরু ২০১৬ সালে। ওই বছর শেষে ব্যাংকিং খাতে বিনিয়োগযোগ্য তারল্য ছিল ১ লাখ ২২ হাজার ৭৪ কোটি টাকা। উদ্বৃত্ত এ তারল্য কাজে লাগাতে আগ্রাসী বিনিয়োগ শুরু করে বেসরকারি ব্যাংকগুলো। ফলে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি বেড়ে দাঁড়ায় ১৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ। এরপর ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ১৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ হলেও পরবর্তী সময়ে তা আরো বেড়ে যায়। সর্বশেষ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধি বেড়ে ১৬ দশমিক ৯৪ শতাংশে দাঁড়ায়।
ঋণ প্রবৃদ্ধি বাড়লেও সে অনুপাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি হয়নি ব্যাংকগুলোয়। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ব্যাংকিং খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩ দশমিক ৫২ শতাংশ। পরের দুই অর্থবছরে তা আরো কমে আসে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আমানতের প্রবৃদ্ধি নেমে আসে মাত্র ১০ দশমিক ৬০ শতাংশে। সর্বশেষ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ব্যাংকিং খাতে এ প্রবৃদ্ধি আরো কমে ৯ শতাংশে নেমে আসে।
ঋণ প্রবৃদ্ধির হারে আমানত না বাড়ায় তারল্য সংকটে পড়ে ব্যাংকগুলো। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতে বিনিয়োগযোগ্য আমানত ৭৬ হাজার ৩৯৩ কোটি টাকায় নেমে আসে। তবে উদ্বৃত্ত এ আমানতের সিংহভাগই রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী ব্যাংকে। রাষ্ট্রায়ত্ত এ ব্যাংকগুলোর এডি রেশিও এখনো ৪০-৬০ শতাংশে সীমাবদ্ধ। অথচ দেশের ইসলামী খাতের ব্যাংকগুলোর বর্তমান এডি রেশিও ৯৫ শতাংশের বেশি। বর্তমানে দেশের অন্তত ১৫টি ব্যাংকের এডি রেশিও নির্ধারিত সীমার বেশি রয়েছে।
এডি রেশিও অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় এ ব্যাংকগুলো তা কমিয়ে আনতে পারছে না বলে মনে করেন রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত। তিনি বলেন, আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষার জন্যই কেন্দ্রীয় ব্যাংক এডি রেশিওর সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু কিছু ব্যাংক আগ্রাসী বিনিয়োগের মাধ্যমে এ সীমা অতিক্রম করেছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা কঠোর হলে ওই ব্যাংকগুলো এতটা বেপরোয়া হতে পারত না।
তিনি আরো বলেন, এ মুুহূর্তে বাংলাদেশ ব্যাংক এডি রেশিওর বিষয়ে কঠোর। নতুন করে এডি রেশিওর হার কমিয়ে দেয়ার কারণে তারল্য পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি হয়েছে। এখন চেষ্টা করেও বেসরকারি ব্যাংকগুলো এডি রেশিও নির্ধারিত সীমায় নামাতে পারছে না। প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোর এডি রেশিও ৮৫ শতাংশই রাখা দরকার।
প্রসঙ্গত, আগ্রাসী বিনিয়োগের কারণে ২০১৭ সালে দেশের বেশির ভাগ বেসরকারি ব্যাংকের এডি রেশিও নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করে। এ পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের লাগাম টানতে এডি রেশিও কমিয়ে আনে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০১৮ সালের ৩০ জানুয়ারি জারি করা বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে এডি রেশিও কমিয়ে আনা হয়। ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলো পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত আমানতের সর্বোচ্চ ৮৩ দশমিক ৫০ শতাংশ ঋণ বিতরণ করতে পারবে। এর আগে এ ধারার ব্যাংকগুলোর এডি রেশিওর সর্বোচ্চ হার ছিল ৮৫ শতাংশ। সে হিসাবে সাধারণ ব্যাংকগুলোর এডি রেশিও ১ দশমিক ৫ শতাংশীয় পয়েন্ট কমানো হয়।
দেশের ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলো আমানতের সর্বোচ্চ ৯০ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ বিতরণ করতে পারত। বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী, এ ব্যাংকগুলোর সর্বোচ্চ এডি রেশিও হবে ৮৯ শতাংশ। সে হিসাবে এ ধারার ব্যাংকগুলোর এডি রেশিও ১ শতাংশীয় পয়েন্ট কমানো হয়। বেঁধে দেয়া এডি রেশিও সমন্বয়ের জন্য চার দফায় সময় পিছিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সর্বশেষ নির্দেশনা অনুযায়ী, এডিআর নির্ধারিত মাত্রায় নামিয়ে আনার জন্য ব্যাংকগুলোকে আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় দেয়া হয়েছে।
Posted ১০:৩২ পূর্বাহ্ণ | সোমবার, ১৮ মার্চ ২০১৯
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta