কক্সবাংলা ডটকম(৭ জানুয়ারি) :: টানা তৃতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারের এক বছর পূর্ণ হচ্ছে ৭ জানুয়ারি। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আকাশছোঁয়া জয় পেয়ে ৭ জানুয়ারি সরকার গড়েছিল আওয়ামী লীগ। এই এক বছরে দেশের সার্বিক উন্নয়নে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষিত প্রতিশ্রম্নতি পূরণে অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়েছে সরকার।
বিশেষ করে পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেলসহ প্রায় এক ডজন অবকাঠামোগত মেগা প্রকল্পে অগ্রগতি হয়েছে চোখে পড়ার মতো। বিমানের বহরে বোয়িংয়ের দুটি উড়োজাহাজ যুক্ত হয়েছে। মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মাধ্যমে ইতিহাস সৃষ্টি করে সরকার।
গত এক দশকের মতোই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থেকেছে। ফলে দ্রম্নত অগ্রসরমাণ অর্থনীতি হিসেবে বাংলাদেশের নাম সারা বিশ্বেই আলোচনায় ছিল।
তবে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নের হার সন্তোষজনক হলেও গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও মানবাধিকারের মতো ইসু্যতে সরকারের ব্যর্থতা রয়েছে ব্যাপক। বেড়েছে ক্রসফায়ারের মতো বিনা বিচারে
হত্যা এবং ধর্ষণের ঘটনা। গুমের অভিযোগের সংখ্যা কিছুটা কম হলেও বছরজুড়ে সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি ‘উদ্বেগজনক ছিল’ বলে বিভিন্ন বিশ্লেষণে বেরিয়ে এসেছে। আইনের শাসন ও মানবাধিকার সুরক্ষায় সরকারের আন্তরিকতা প্রশ্নবিদ্ধ বলে মানবাধিকার সংগঠনগুলোও অভিযোগ তুলেছে।
এদিকে ক্যাসিনোকান্ড-চাঁদাবাজির সঙ্গে সম্পৃক্ত বেশ কয়েকজন যুবলীগ, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকে সংগঠনের পদ থেকে অব্যাহতি এবং শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে বেশ কয়েকজন দুর্নীতিবাজকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় ক্ষমতাসীন দলের ইমেজ এক লাফে বেশখানিকটা বাড়লেও আকস্মিক তা থমকে যাওয়ায় এর লক্ষ্য নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষ কাউকে ঘায়েল করতে সরকার এ শুদ্ধি অভিযান চালিয়েছে কি না তা নিয়ে খোদ দলের নেতাকর্মীরাও সন্দেহ পোষণ করছেন।
বছর শেষে বিতর্কিত রাজাকার তালিকা নিয়ে দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও এ নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন করেছেন। তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার নাম চলে আসায় দুঃখ প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীরা। পরে সরকারকে এ তালিকা স্থগিত করতে বাধ্য হতে হয়েছে।
এদিকে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে গত ১ নভেম্বর সরকার নতুন সড়ক পরিবহণ আইন কার্যকরের ঘোষণা দিলেও পরিবহণ মালিক-শ্রমিকরা আন্দোলনের মুখে আইনটি বাস্তবায়নে শিথিল অবস্থান নেওয়ায় তা নিয়ে সাধারণ জনগণের সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। আটঘাট না বেঁধে সরকার অপরিকল্পিতভাবে এ উদ্যোগ নেওয়ায় তা শুরুতেই মুখ থুবড়ে পড়েছে, যা আগামীতে প্রণয়ন করা আরও কঠিন হবে বলে পরিবহণ সংশ্লিষ্টরা মন্তব্য করেছেন।
এদিকে সম্প্রতি জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘আইনের শাসন, নিরাপত্তা, জবাবদিহি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার’ দাবিতে এক সংবাদ সম্মেলনে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ বি এম শামসুল হুদা বলেন, ‘মানবাধিকার সুরক্ষা, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, আইনের শাসন ও জবাবদিহির ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে আছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারায় উন্নয়ন দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে না।’
এদিকে মানবাধিকার, আইনের শাসন ও জবাবদিহিতা নিয়ে বিভিন্ন মহলের নানা প্রশ্নে সরকারের নীতিনির্ধারকরা কোনো প্রতিউত্তর না জানালেও দক্ষ, সেবামূলক ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসন গড়ে তোলার উদ্যোগ অনেক দূর এগিয়েছে বলে তারা জোরালভাবে দাবি করেছেন। তাদের ভাষ্য, জনবান্ধব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গড়ে তোলার অঙ্গীকার পুরোপুরি পূরণ না হলেও এ ক্ষেত্রে সরকারের চেষ্টা অব্যাহত আছে। নারীর ক্ষমতায়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে নিশ্চয়তা, বিদু্যৎ ও জ্বালানি ক্ষেত্রে উন্নয়নের ঘোষণা বাস্তবায়নের পথে। শিল্পায়ন, শিক্ষা, সড়ক, রেলপথ ও বিমান পথে যোগাযোগের অভূতপূর্ব উন্নয়ন ঘটেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনীতি বিশ্লেষক অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হকের মতে, ‘বিগত এক বছরে গণতন্ত্র বা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র উন্নয়ন হয়নি। প্রতি মুহূর্তে এসব অধিকার খর্ব হয়েছে বা হচ্ছে। এর সবটাই যে সরকারি প্রশাসন করেছে তা নয়। আওয়ামী লীগের লোকেরাও করছেন।’
অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জন প্রসঙ্গে আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেন, ‘দেশের মানুষ প্রাণপণ চেষ্টা করে কৃষি উৎপাদন বাড়িয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকার কীটনাশক বা সার বিতরণে সাফল্য দেখিয়েছে। আগের মতো আর ভোগান্তি নেই। বিদেশে শ্রমিক পাঠানো বা গার্মেন্ট ক্ষেত্রে রপ্তানি দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। সরকার সফলতার সঙ্গে এটাকে চালিয়ে রাখতে পেরেছে। জাতিসংঘের মিশনে সৈন্য পাঠিয়ে বিদেশি মুদ্রা আয় অব্যাহত রয়েছে। ফলে আর্থিক অবস্থা ভালো আছে।’
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘সরকার অত্যন্ত সুচিন্তিত, সুগঠিত ও সুলিখিত নির্বাচনী ইশতেহার নিয়ে এসেছিল। দুর্ভাগ্যের বিষয়, এ ইশতেহারের মূল বিষয়গুলো বাস্তবায়নে তাদের উৎসাহ, উদ্যোগ বা উদ্যোম দেখিনি। এমনকি আমার কাছে অনেক সময় মনে হয়েছে, এগুলো যারা বাস্তবায়ন করার কথা মন্ত্রিপরিষদের সেই সদস্যরা অনেক নিরীহ প্রকৃতির। ইশতেহারের যে মূল প্রত্যাশা পিছিয়ে পড়া মানুষের জীবনমানের উন্নতি, সেটার অগ্রগতি হয়নি। ফলে সংস্কারের অভাবে সমস্যা পুঞ্জিভূত হয়ে সরকারের অর্জিত সাফল্যকে ম্স্নান করে আগামী বছরকে সরকারের পথচলার জন্য একটি অমসৃণ বছরে পরিণত করেছে।’
এদিকে প্রশাসনিক সূত্রগুলো জানায়, টানা তৃতীয় মেয়াদের প্রথম বছরে রূপপুরে পারমাণবিক বিদু্যৎকেন্দ্রে বালিশ-কান্ড সরকারকে সবচেয়ে বেশি সমালোচনার মুখে ফেলেছে। এছাড়া ফেনীর মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত হত্যায় আওয়ামী লীগ নেতার নাম আসায় সরকারকে চরম অস্বস্তিতে পড়তে হয়েছে। ভূমিখাতে দুর্নীতির বিষয়টিও ঘুরেফিরে সামনে এসেছে।
তবে ধর্ষণ ছাড়া খুন-ছিনতাইসহ অন্যান্য অপরাধ দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তথা সরকার যথেষ্ট সফলতার পরিচয় দিয়েছে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক অঙ্গনেও বড় ধরনের কোনো সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি। বিরোধী দলকে রাজপথে সামাল দিতেও সরকার কৌশলী ভূমিকা পালন করেছে।
গত বছরের মার্চ থেকে শুরু হওয়া ৫ ধাপে উপজেলা নির্বাচন এবং পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনও ছিল সংঘাতহীন। অক্টোবর পর্যন্ত চলা উপজেলা-পৌরসভা ও ইউনিয়ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের ছিল জয়জয়কার। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার বিষয়টি বড় সাফল্য বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
তবে গত বছর শেয়ারবাজার নতুন কোনো সুখবর দিতে পারেনি। ব্যাংক ঋণের সুদের হার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার আশ্বাস দীর্ঘদিনের। এর ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই আলোচনাই আছে। তবে সরকার তা গত অর্থবছরে বাস্তবায়ন করতে পারেনি। রাজস্ব আয়েও গতি নেই, রপ্তানি খাতও ভালো অবস্থায় ছিল না।
যদিও অর্থনীতির প্রাণশক্তি প্রবাসী আয়ে ঊর্ধ্বমুখী ধারা অব্যাহত আছে, প্রবৃদ্ধি ১৮ শতাংশ। গত বছর প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৮৩৩ কোটি ডলার। আগের বছর প্রবাসী আয় ছিল ১ হাজার ৫৫৩ কোটি ডলার।
বিদু্যৎ উৎপাদনে সরকারের সফলতার ধারা গত বছরে আরও বেশখানিকটা এগিয়েছে। বর্তমানে দেশে বিদু্যৎ উৎপাদন ক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার ৭২৭ মেগাওয়াট, যা এ খাতে বৈপস্নবিক উন্নয়নের দিকনির্দেশ করে।
এদিকে গত কয়েক বছরের মতো সরকারের তৃতীয় মেয়াদের প্রথম বছরও পররাষ্ট্রনীতির বড় চ্যালেঞ্জ ছিল রোহিঙ্গা ইসু্যটি। রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফেরত পাঠাতে ২০১৭ সালের নভেম্বরে মিয়ানমারের সঙ্গে প্রত্যাবাসনের চুক্তি করেছিল বাংলাদেশ; কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো রোহিঙ্গাকে পাঠাতে পারেনি।
চীনের সরাসরি মধ্যস্থতায় ২২ আগস্ট রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের তারিখ ঠিক করা হয়। এর আগে ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের তারিখ ঠিক করা হয়েছিল। দুটি উদ্যোগই ব্যর্থ হয়। ফলে গত বছর রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে কোনো অগ্রগতি অর্জিত হয়নি।
এর বাইরে আসামের জাতীয় নাগরিক তালিকা (এনআরসি) এবং ভারতের লোকসভায় পাস হওয়া নাগরিকত্ব সংশোধন আইন বাংলাদেশের জন্য কিছুটা হলেও অস্বস্তি তৈরি করে। গত অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে সাতটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। এর মধ্যে সমুদ্র উপকূলে রাডার স্থাপনের একটি চুক্তি রয়েছে। এসব চুক্তিকে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো দেশবিরোধী বলে বক্তব্য-বিবৃতি দেয়। এছাড়া দীর্ঘদিন আলোচনায় থাকার পরও তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি না হওয়ায় সরকারকে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়।
Posted ২:০৫ পূর্বাহ্ণ | মঙ্গলবার, ০৭ জানুয়ারি ২০২০
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta