কক্সবাংলা ডটকম(২৫ নভেম্বর) :: প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছেন, রাজাকার-আলবদর, যুদ্ধাপরাধী, খুনি, দুর্নীতিবাজ ও ইতিহাস বিকৃতকারীরা যেন ক্ষমতায় আসতে না পারে। আগামীর বাংলাদেশ হবে অর্থনৈতিক মুক্তির ও সমৃদ্ধির বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণেই সে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সেই ভাষণ বিশ্ব প্রামাণ্যঐতিহ্য হিসেবে ইউনেসকোর স্বীকৃতি পাওয়া উপলক্ষে আয়োজিত এক সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন।
ইউনেসকোর স্বীকৃতি সরকারিভাবে উদ্যাপনের লক্ষ্যে গতকাল শনিবার বিকেলে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ওই সমাবেশের আয়োজন করা হয়। সমাবেশের আগে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদনের পর আনন্দ শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাতে অংশ নেন। রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার বিপুলসংখ্যক মানুষ ওই কর্মসূচিতে যোগ দেয়।
১৯৭১ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের নাম ছিল রেসকোর্স ময়দান। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বিকেল ৩টা ২০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু লাখো মানুষের সামনে ১৮ মিনিটের অলিখিত ভাষণ দিয়েছিলেন। তর্জনী উঁচিয়ে অনুপম ভঙ্গিতে দেওয়া ভাষণে ছিল মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনা।
বিশ্বের বিশিষ্ট রাজনীতিকদের ভাষণের মধ্যে এটি অনন্য। অলিখিত ছাড়াও ওই ভাষণে শেখ মুজিবুর রহমান দূরদর্শিতার পরিচয় দেন। ওই ভাষণের জন্যই তাঁকে বলা হয়ে থাকে রাজনীতির কবি, আর ওই ভাষণকে বলা হয় রাজনীতির কাব্য। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের ভাষণের দৃশ্য গতকাল বড় পর্দায় দেখানো হয়। সেই শব্দগুলো, সেই বজ্রকণ্ঠ, সেই কাব্যের কারিগরকে যেন প্রধানমন্ত্রী নিজেও নতুনভাবে দেখছিলেন, ছিলেন আপ্লুত। সমাবেশে উপস্থিত হাজার হাজার তরুণ-তরুণীর চোখের সামনে যেন আবার জীবন্ত হয়ে ওঠেন জাতির জনক।
সমাবেশস্থলে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় দুপুর ২টা ৫৫ মিনিটে। উচ্ছ্বসিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুষ্ঠান মঞ্চে উপস্থিত হয়ে সবাইকে শুভেচ্ছা জানান হাত নেড়ে। বিকেল পৌনে ৪টায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও যেন চলে যান ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের সেই উত্তাল জনসমুদ্রে। স্মৃতি থেকে তিনি তাই বলেন, ‘আজ এ জায়গায় দাঁড়িয়ে মনে পড়ছে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের কথা। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল সেই রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত থাকার। আমি বক্তব্য শুনেছিলাম। সে দৃশ্য দেখেছিলাম। বারবার মনে পড়ে সেদিনের কথা। ’
প্রধানমন্ত্রী ২১ মিনিট বক্তব্য দেন। ৭ই মার্চের ভাষণ দেওয়ার দিন বাবাকে ডেকে মায়ের দেওয়া পরামর্শের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘‘আমার মা বাবাকে বলেছিলেন, ‘তুমি সারাটা জীবন এ দেশের মানুষের জন্য সংগ্রাম করেছো। তুমি জানো এ দেশের মানুষের মুক্তি কিসে। কাজেই কারো কথা শোনার কোনো প্রয়োজন নেই। তোমার মনে যে কথা আসবে তুমি সেই কথাই বলবে। ’ বারবার মনে পড়ে মায়ের কথা। ৭ই মার্চের ওই ভাষণ দেওয়ার দিন বাবার সঙ্গে একদিকে ছিলেন দাদা-দাদি, অন্যদিকে মা। মা-বাবাকে সেদিন বলেছিলেন, ‘তুমি সারাটা জীবন মানুষের জন্য কাজ করেছ। তোমার মুখে যাই আসবে তাই বলবে। কারো কথা শোনার দরকার নেই। ’ পৃথিবীর বহু নেতার ভাষণ লিখিত। জাতির পিতার হাতে সেদিন কোনো কাগজ ছিল না, নোট ছিল না। মন থেকে বলেছিলেন। ”
ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ জ্যাকব জে ফিল্ডের ‘উই শ্যাল ফাইট অন দ্য বিচেস :
দ্য স্পিচেস দ্যাট ইনস্পার্য়াড হিস্ট্রি’ বইয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা তুলে ধরে সরকারপ্রধান বলেন, ‘জ্যাকব জে ফিল্ডের বইয়ে ৪১টি বক্তব্যে সিসেরো থেকে চার্চিল, লিংকন থেকে মাও—গত আড়াই হাজার বছরের সবচেয়ে উদ্দীপনা ও অনুপ্রেরণা সৃষ্টিকারী যুদ্ধকালীন বক্তৃতাগুলোর সারসংক্ষেপ রয়েছে। জাতির পিতার ভাষণ এ বইয়ে স্থান পায়। আর আমাদের দেশে পঁচাত্তরের পর যারা ক্ষমতায় এসেছিল তারা এই ভাষণ নিষিদ্ধ করেছিল সে সময়। ইতিহাসকে কেউ মুছে ফেলতে পারে না। ’
এ ভাষণ শোষণ-বঞ্চনার ইতিহাস :
সমাবেশে বক্তব্যের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী সমবেত শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীদের ‘ছোট ছোট সোনামণিরা উপস্থিত’ বলে তাদেরও অভিনন্দন জানান। শেখ হাসিনা বলেন, আগামী প্রজন্মের অনেক ছেলে-মেয়ে এখানে উপস্থিত রয়েছে। বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চ যে ভাষণ দিয়েছিলেন তা তাদের জানতে হবে, বুঝতে হবে, অনুধাবন করতে হবে। কেননা এ ভাষণেই বলা আছে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ কেমন হবে। তিনি বলেন, ‘৭ই মার্চের গৌরবগাথা শুধু ভাষণ নয়, এ ভাষণ শোষণ-বঞ্চনার ইতিহাস। আগে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ আমাদের করুণার চোখে দেখত। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে মর্যাদা পাচ্ছে। আমাদের আজ কেউ করুণা করতে পারে না। ’
যারা এই ভাষণ নিষিদ্ধ করেছিল, তারা এখন কোথায় মুখ লুকাবে : আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে হত্যার পর এই ভাষণকে নিষিদ্ধ করা হয়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে পারেনি। যারা এই ভাষণ নিষিদ্ধ করেছিল, তাদের অবস্থা আজ কী? তারা এখন কোথায় মুখ লুকাবে?’ তিনি বলেন, ‘একাত্তরে আমরা যারা এই ভাষণ শুনতে পেয়েছিলাম তারা সৌভাগ্যবান। পঁচাত্তরের পর থেকে যারা ইতিহাস বিকৃতি দেখেছে, সত্যি তাদের জন্য দুঃখ হয় যে আমরা মহান মুক্তিযুদ্ধ করে বিজয়ী জাতি, বিজয় অর্জন করেছি; কিন্তু সেই ইতিহাস আমাদের প্রজন্মের পর প্রজন্ম জানতে পারেনি। ’ তিনি আরো বলেন, ইতিহাস চির ভাস্বর। ইতিহাস কখনো মুছে ফেলা যায় না। ইউনেসকোর এই স্বীকৃতিতে তা আবারও প্রমাণিত হয়েছে।
দুপুর ২টা ৫৮ মিনিটে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় সমাবেশের আনুষ্ঠানিকতা। মন্ত্রিপরিষদসচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম শুরুতে স্বাগত বক্তব্য দেন। দুপুর ২টার আগেই জনসমুদ্রে রূপ নেয় পুরো উদ্যান। উদ্যানের লেকে ভাসানো ছিল সাদা নৌকা। মানুষের হাতে ছিল ব্যানার, ফেস্টুন। তাতে ৭ই মার্চের ওই ভাষণের বিশেষ বিশেষ অংশ ছিল চোখে পড়ার মতো। লাল-সবুজের পতাকা ছিল হাতে। অনেকের পরনেও ছিল লাল-সবুজ পোশাক।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ এ উদ্যানেই বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে হেঁটে এসেছিলেন অনেকে। তাঁদের অনেকেও ছিলেন গতকালের সমাবেশে। আনন্দ শোভাযাত্রা অনুষ্ঠানের বিষয়ে বিশেষভাবে আগ্রহী প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরীও বাবার হাত ধরে ৭ই মার্চের ভাষণ শুনতে এসেছিলেন। গতকাল বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি বলেন, “আমি অনুভব করছি ৭ই মার্চের উত্তেজনা। আদমজী থেকে হেঁটে বাবার সঙ্গে এসেছিলাম। আমি সৌভাগ্যবান, আমি শিহরিত। সেই দিন শুনেছিলাম, আজও যেন কানে ভেসে আসছে : ‘তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব, শেখ মুজিব’। ছিল মুহুর্মুহু ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি। ”
সমাবেশ শুরু হওয়ার আগে থেকেই সভাস্থলের আশপাশের এলাকায় ভিড় জমতে থাকে। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা এবং স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা দলে দলে সেখানে জড়ো হয়।
মহিলা মাদরাসার ছাত্রীরাও ছিল সমাবেশে। দলে দলে মিছিল নিয়ে হাজার হাজার শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। স্কুলের শিশুদের মুখেও ছিল ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি।
সমাবেশ শুরু হওয়ার তিন ঘণ্টা আগেই শাহবাগ, রমনা পার্ক, হাইকোর্ট মোড়, দোয়েল চত্বর, টিএসসি ও আশপাশের সব এলাকায় ছিল জনতার ঢেউ। রূপসী বাংলা মোড়, মৎস্য ভবন মোড়, হাইকোর্ট মোড়, চানখাঁরপুল, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মোড়, নীলক্ষেত মোড় ও কাঁটাবন মোড়ের রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ করে দেয় ট্রাফিক পুলিশ। এসব এলাকায় বেশির ভাগ মানুষকে হেঁটে সমাবেশস্থলের দিকে যেতে দেখা গেছে।
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বিকেল ৩টা ২০ মিনিটে ভাষণ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। গতকাল একই সময়ে একই উদ্যানে বাজানো হলো সেই ভাষণ। এরপর পরিবেশন করা হয় ‘ধন্য মুজিব ধন্য’ গান। পরে ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায় আবৃত্তি করে শোনান বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ নিয়ে নির্মলেন্দু গুণের লেখা ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’ কবিতাটি।
ভাষণে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্দেশনা দিয়ে গেছেন বঙ্গবন্ু্ল :
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের স্মৃতির কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা সমাবেশে বলেন, “সেদিনের জনসমুদ্রে আমার আসার সৌভাগ্য হয়েছিল। আমরা এসেছি, ভাষণ শুনেছি। দেখেছি সেদিন বাংলার মানুষের উত্তাল তরঙ্গ। সেদিন তাঁর ভাষণে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্দেশনা দিয়ে গেছেন বঙ্গবন্ধু। আমাদের প্রতিটি অর্জন জাতির পিতার নেতৃত্বে হয়েছে। শিক্ষা, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের পাশাপাশি দেশকে একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠায় জাতির পিতা আন্দোলন গড়ে তোলেন। তিনি স্বাধীনতার মন্ত্রে বাঙালি জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেন। বাংলার মানুষের সঙ্গে জাতির পিতার আত্মিক সম্পর্ক এ ভাষণে ফুটে ওঠে। কারণ তিনি বক্তব্যের শুরুতেই বলেছিলেন, ‘ভায়েরা আমার। ’ তিনি অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। তিনি গেরিলা যুদ্ধের নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এত দূরদর্শিতা, এত দিকনির্দেশনা পৃথিবীর কোনো ভাষণে পাওয়া যায় না। আজকে আমরা আনন্দিত। এ ভাষণ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। ৪৬ বছর আগের এ ভাষণকে স্বীকৃতি দেওয়ায় ইউনেসকো, তার সাবেক পরিচালক, যাঁরা ভোট দিয়েছেন এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানাই। ”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ওই রাজাকার, আলবদর, যুদ্ধাপরাধী, খুনি, ইতিহাস বিকৃতকারী—তারা যেন এ দেশে আর কোনো দিন ক্ষমতায় আসতে না পারে। …এই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এই দেশ ইনশাআল্লাহ এগিয়ে যাবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আমরা বাংলাদেশকে গড়ে তুলব। ’
Posted ২:১৭ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ২৬ নভেম্বর ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta