কক্সবাংলা ডটকম(২৭ জুলাই) :: পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচন পরবর্তী পরিস্থিতি ঘোলাটে মনে হলেও বলা যেতে পারে যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মদদে ভোটে জিতে সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন।
২৭২টি জাতীয় আইনসভা এবং ছটি প্রাদেশিক আইনসভায় ইমরানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) অনেকটাই এগিয়ে। নওয়াজ শরীফের দল পাকিস্তান মুসলিম লীগ (পিএমএল-এন) ও নিহত বেনজির ভুট্টোর দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) ছাড়াও আওয়ামী ন্যাশনাল পার্টির (এএনপি) মতো অন্য দলগুলো নানা অভিযোগ এনেছে।
নির্বাচনে ইমরানের দল তেহরিক-ই-ইনসাফ পার্টি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সরাসরি সমর্থন পেয়েছে বলে যে খবর, তা ওপেন সিক্রেট। এসব কারণে প্রথাগত ক্ষোভ-বিক্ষোভ করেই প্রতিবাদ করছে ইমরানের দল ছাড়া প্রায় সবাই।
দুনিয়াজুড়ে ইমরান খানের পরিচিতি বিশ্বকাপজয়ী পাকিস্তান ক্রিকেট দলের অধিনায়ক কাম একজন ‘সেলিব্রেটি প্লেবয়’ হিসেবে। সেই ইমরান খানই রাজনীতির ধারায় হয়ে উঠেছেন পাকিস্তানের ধর্মীয় রক্ষণশীল ঘরানার এক জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ। ১৯৯৬ সালে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ঘোষণা নিয়ে পাকিস্তানের রাজনীতির বিশৃঙ্খল মাঠে পা রাখেন ইমরান খান। এরপর থেকে ব্যক্তিগত বিভিন্ন ইস্যু আর জাতীয় ইস্যুতে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়ে পাকিস্তানের রাজনীতিতে নিজের জায়গা করে নিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতিতে পাকিস্তান অনেক কারণেই আলোচিত, বর্তমানে পাকিস্তানের রাজনীতিতে জঙ্গিবাদের পুনর্বাসনও বেশ চোখে পড়ার মতো। নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামাত-উদ-দাওয়ার প্রধান হাফিজ সাঈদকে ভোটে দাঁড়ানোর ছাড়পত্র দিয়েছে পাকিস্তান নির্বাচন কমিশন। সাঈদ মুম্বাই হামলায় মোস্ট ওয়ান্টেড আসামী। নির্বাচনে তারা কোনো আসন না পেলেও খোলাখুলি রাজনীতির সুযোগ নানা শঙ্কা তৈরি করেছে।
এছাড়া ইমরানের তালেবানপ্রীতি সবার জানা। বেশি সমালোচনার শিকার হয়েছেন সামি উল হকের সঙ্গে নির্বাচনী জোট বেঁধে। সামি উল হক ‘তালেবানদের পিতা’ নামে পরিচিত। এছাড়া নির্বাচনের আগে পিটিআইকে আল-কায়েদা ঘনিষ্ঠ জঙ্গিদল হরকত-উল-মুজাহিদীনের সমর্থন করেছে। এসব নানা ঘটনা প্রতিবেশী দেশ ভারত, আফগানিস্তানসহ বাংলাদেশের জন্য চিন্তার কারণ বলে অনেক নিরাপত্তা বিশ্লেষক মত প্রকাশ করেছেন।
নির্বাচনের দিন ইসলামাবাদ, লাহোর, করাচি, পেশোয়ার, কোয়েটাসহ দেশটির সর্বত্র জারি হয় কড়া সতর্কতা। বোমা হামলাসহ নানা সহিংসতায় বহু হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।
ভৌগলিক অবস্থান বিবেচনায় বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে অনেক দূরে, তাছাড়া সরাসরি কোনো সীমানাও নেই। এরপরও পাকিস্তানে কোনো ধরণের জঙ্গিবসন্তের মতো পরিস্থিতি তৈরি হলে বৈশ্বিক জঙ্গিবাদের ভাইরাস সংক্রমিত হতে বেশি সময় লাগবে না বলে আমাদের শঙ্কা। বিষয়গুলোর প্রতি দেশের বিভিন্ন মহলকে সতর্ক থাকাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি বলেও আমরা মনে করি।
ক্রিকেটার থেকে রাজনীতিবিদ বনে যাওয়া ইমরান খান ইসলামাবাদে ক্ষমতায় আসার ফলে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে ঠিক কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে, তা নিয়ে দু’দেশের পর্যবেক্ষকরা যে একমত তা কিন্তু বলা যাচ্ছে না।
ইমরানের মতো ব্যক্তিত্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ফলে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক নতুন করে ঝালিয়ে নেয়ার একটা চমৎকার সুযোগ এসেছে বলে ইসলামাবাদে অনেকেই মনে করছেন। কিন্তু দিল্লিতে ভারতীয় বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ইমরান খানের সাফল্যের পেছনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর যে প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল তাতে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরও তিনি কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবেন সেই সংশয় থেকেই যাচ্ছে।
পাকিস্তানের পালাবদল দুই দেশের সম্পর্কে আদৌ কোনও পরিবর্তন আনবে কি না, তা নিয়ে দুই দেশের পর্যবেক্ষকদেরই মতামত জানার চেষ্টা করেছিলাম।
একুশ বছরের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ারে ভারতের বিরুদ্ধে বহু স্মরণীয় জয় পেয়েছেন ইমরান খান। কিন্তু ঠিক বাইশ বছর আগে রাজনীতিতে নামার পর দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি যে সেকেন্ড ইনিংস শুরু করতে যাচ্ছেন, তাতে তিনি কীভাবে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে সম্বোধন করবেন তা নিয়ে আসলে এখনও বহু প্রশ্ন।
তবে পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও দিল্লিতে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করে যাওয়া রিয়াজ খোকার কিন্তু বেশ আশাবাদী।
খোকার বিবিসিকে বলছিলেন, ‘দেখুন একজন সম্পূর্ণ আনকোরা নতুন নেতা, নতুন ব্যক্তি আর নতুন দল ক্ষমতায় এল- যেটা আমার মতে ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশের জন্যই সম্পর্কটা শুধরে নেয়ার দারুণ একটা সুযোগ। তার জয়টা প্রশংসনীয় ছিল, ভারতও নিশ্চয় সেটা খেয়াল করবে।’
‘আর ইমরানের পরিচিতি তো শুধু দক্ষিণ এশিয়াতে নয়, সারা দুনিয়া জুড়ে। তাকে ভারত সরকার উষ্ণ অভিনন্দন বার্তা পাঠালে আমি মনে করি সেটা দারুণ সৌজন্য হবে, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে এক নতুন সূচনারও জন্ম দিতে পারে।’
কিন্তু রাজনীতিবিদ ইমরান খান নানা সময়ে যেসব ভারতবিরোধী বিবৃতি দিয়েছেন, কিংবা কাশ্মিরে আত্মঘাতী হামলাকারীদের প্রতি পর্যন্ত সমর্থন জানিয়েছেন তাতে তাকে নিয়ে ভারতে একটা সন্দেহের বাতাবরণ আছেই।
ভারতের প্রাক্তন পররাষ্ট্র সচিব সালমান হায়দার অবশ্য মনে করেন, প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের ব্যক্তিগত কারিশমা সেই ছবিটা কিছুটা পাল্টাতেও পারে।
হায়দার বিবিসিকে বলছিলেন, ‘ইমরান খান একজন গগনচুম্বী ব্যক্তিত্ব, জীবনের নানা ক্ষেত্রে তিনি সাফল্য পেয়েছেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তাকে এতদিন অত সিরিয়াসলি না নিলেও ভারতও এখন দেখছে তার দল ভালো ফল করছে এবং অনেক চ্যালেঞ্জ সামলেও রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি নিজেকে ক্রমশ পরিণত করে তুলছেন।’
তবে ইমরান খানকে নিয়ে ভারতের সন্দেহের সবচেয়ে বড় কারণ, তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ‘পছন্দের লোক’।
সালমান হায়দারের কথায়, ‘এই যে ইমরান খানকে আর্মির ‘চোজেন ওয়ান’ বলা হচ্ছে – তাতে তার কাজকর্মে কতটা স্বাধীনতা থাকবে সেটাই কিন্তু দেখার বিষয়। আমি এত তাড়াতাড়ি এটা নিয়ে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে চাই না, তবে তারপরেও এটা নিয়ে প্রশ্ন কিন্তু থাকছেই।’
সাবেক পাকিস্তানি শীর্ষ কূটনীতিক রিয়াজ খোকারের মতে আবার এই আশঙ্কাটা একেবারেই অমূলক।
তিনি যুক্তি দিচ্ছেন, ‘নির্বাচন কিন্তু খুবই সুষ্ঠু ও অবাধ হয়েছে- এখানে কোনও প্রতিষ্ঠান বিশেষ কাউকে বেছে নিয়েছে তা মোটেও নয়। বিদেশি পর্যবেক্ষকরাও নির্বাচনী প্রক্রিয়ার প্রশংসা করেছেন, আর নওয়াজ শরিফের পার্টির জনপ্রিয়তাতেও যে ভাটা পড়েছিল তাতেও কোনও ভুল নেই।’
যদিও ভারতের মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয়ে সাবেক বিশেষ সচিব রানা ব্যানার্জি এই যুক্তি মোটেও বিশ্বাস করছেন না।
ব্যানার্জির কথায়, ‘যদিও ইমরান বেশ ভালোভাবেই জিতেছেন, এই জয়টা যে আর্মির সঙ্গে তার চুক্তি মোতাবেকই হয়েছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ফলে আমি নিশ্চিত অন্তত পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে প্রথম দিকে তিনি আর্মির শেখানো বুলিই বলবেন।’
‘হি উইল প্যারট দ্য আর্মি’জ পজিশন। কাজেই পাকিস্তানের ভারত নীতিতে চট করে কোনও পরিবর্তন হবে বলে আমি মনে করছি না।’
কিন্তু আবার পাকিস্তানে বেসামরিক সরকার ও আর্মির মতামত যদি একই হয়, সেক্ষেত্রে নতুন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কাজ করা ভারতের জন্য তো সুবিধাজনকও হতে পারে?
ভারতের সাবেক গোয়েন্দা প্রধান ব্যানার্জি জবাবে বলছেন, ‘পাকিস্তানি আর্মি আবার সেটাও পছন্দ করে না যে সিভিলিয়ান লিডারের মাধ্যমে কথাবার্তা বলা হোক। কারণ তারা চায় দেশের সিভিল সোসাইটির ওপর তাদের যে দাপট সেটা বজায় থাকুক!’
‘এখন আবার নতুন একটা ভাবনাও হাওয়ায় ছেড়ে দেয়া হয়েছে… পাকিস্তানি আর্মির সাবেক ব্রিগেডিয়ার ফিরোজ হাসান খান, যিনি এখন মার্কিন নাগরিক ও মন্টেরে-তে ইউএস ন্যাভাল স্কুলে পড়ান, তিনি হালে লিখেছেন পাকিস্তানি ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর মধ্যে সরাসরি আলোচনাটাই সম্পর্ক উত্তরণের একমাত্র রাস্তা!’
বিষয়টা নিয়ে যে দুদেশের নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বেশ চর্চা হচ্ছে, তিনি সেটাও উল্লেখ করতে ভোলেননি।
ফলে ইমরান খানের জমানায় পাকিস্তান ও ভারতের সেনাবাহিনীর মধ্যেও সরাসরি একটা সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা হতে পারে, এই ইঙ্গিতও তাই উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে।
কিন্তু ইমরান খানকে নিয়ে ভারত যে খুব আশাবাদী বা তিনি দুদেশের সম্পর্ককে রাতারাতি বদলানোর ক্ষমতা রাখেন বলে দিল্লি বিশ্বাস করে- বিষয়টা মোটেও সেরকম নয়!
Posted ১:২৮ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ২৭ জুলাই ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta