কক্সবাংলা ডটকম :: ইসলামী ব্যাংক থেকে ১১ প্রতিষ্ঠানকে আগ্রাসীভাবে ঋণ দেওয়ার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে একটি তদন্ত শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
তারই অংশ হিসেবে, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এসব কোম্পানিকে ৯ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা ঋণ ছাড় বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে।
মঙ্গলবার (২৯ নভেম্বর) বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘আমাদের একটি টিম ব্যাংকটি পরিদর্শন করে এসব অনিয়মের ব্যাখ্যা চেয়েছে।
এ-সংক্রান্ত নথিপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে’।
এদিকে ইসলামী ব্যাংকে বড় ধরনের ঋণ অনিয়মের ঘটনা নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য করেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষটির মুখপাত্রও কোনো মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র জি এম আবুল কালাম আজাদ বলেছেন, ইসলামী ব্যাংকের ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের একটি টিম কাজ করবে। ‘ইতোমধ্যে তারা দুদিন ইসলামী ব্যাংকে গেছেন। তারা আরও চারদিন সেখানে যাবেন’।
অপরদিকে ইসলামী ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটের ঘটনায় তদন্ত চেয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের তিন আইনজীবীসহ পাঁচ গ্রাহক।
বৃহস্পতিবার দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) বরাবর এ চিঠি পাঠানো হয়।
চিঠি দানকারী পাঁচজন হলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির, আব্দুল্লাহ সাদিক, মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াদুদ এবং দুই গ্রাহক যায়েদ বিন আমজাদ ও শায়খুল ইসলাম ইমরান।
ইসলামী ব্যাংকের অস্বাভাবিক ঋণ : রিট আবেদনের পরামর্শ হাই কোর্টের
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের ‘অস্বাভাবিক ঋণ’ বিতরণের তিনটি খবর নজরে আনার পর রিট আবেদনের পরামর্শ দিয়েছে হাই কোর্টের একটি বেঞ্চ।
বুধবার বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের বেঞ্চ এ পরামর্শ দেয়।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শিশির মনির বাংলা দৈনিক প্রথম আলো এবং দুই ইংরেজি দৈনিক বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড ও নিউ এইজে ইসলামী ব্যাংকের বিপুল পরিমাণ ঋণ দেওয়া নিয়ে তিনটি খবর নজরে এনে আদালতের স্বতঃপ্রণোদিত আদেশ চান।
তখন আদালত তাকে নিয়মিত রিট আবেদন করার পরামর্শ দেয় বলে জানিয়েছেন ওই আইনজীবী।
কখন রিট দায়ের করবেন এমন প্রশ্নে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “পড়াশোনা করছি, লিখছি।“
এর আগে শিশির মনির ফেইসবুকে লিখেন, “ইসলামী ব্যাংকের বিষয়টি আদালতের নজরে আনলাম। মাননীয় হাইকোর্ট বিভাগ রিট পিটিশন দায়ের করে আসতে বলেছেন। ইনশাল্লাহ তাই করব।“
আদালতের পরামর্শের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “প্রতিবেদন তিনটি উপস্থাপন করে আমি আদালতকে বলেছিলাম, অনেক মামলা আপনাদের এখানে আসে ঘটনা শেষ হয়ে যাওয়ার পর। এটাতে প্রিভেন্টিভ কিছু করা যায় কি না? এখনও কোনও উদ্যোগ নেওয়া গেলে এখনও কিছু সেইভ করা যাবে। তখন আদালত বলেন, প্রপার রিট ফাইল করে আসেন।“
‘ইসলামী ব্যাংকে ‘ভয়ংকর নভেম্বর’ শিরোনামে প্রথম আলোতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর গত ২৭ নভেম্বর ঘটনার তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বরাবর আবেদন করেন পাঁচ ব্যক্তি, যাদের মধ্যে শিশির মনিরও রয়েছেন।
সেই আবেদনে তারা নিজেদেরকে ইসলামী ব্যাংকের নিয়মিত গ্রাহক হিসেবে উল্লেখ করেন, “ব্যাংকের আমানতকারী হিসাবে আমরা উদ্বিগ্ন। স্বীকৃত মতে বর্তমানে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলা করছে। এমতাবস্থায় এই ধরনের সন্দেহজনক আর্থিক লেনদেনে আমরা সংক্ষুব্ধ।“
তদন্ত সাপেক্ষে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কার্যকর আইনগত দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ গ্রহণে সেই আবেদনে অনুরোধ করা হয়।
এরপর বুধবার তা আদালতের নজরে আনেন আইনজীবী শিশির মনির।
ইসলামী ব্যাংক থেকে শুধু নভেম্বরেই ২ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা তুলে নেওয়ার তথ্য দিয়ে গত ২৪ নভেম্বর ‘ইসলামী ব্যাংকে ভয়ংকর নভেম্বর’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করে প্রথম আলো। এ প্রতিবেদনে নিয়ম ভেঙে ওই ব্যাংক থেকে চলতি বছর নামসর্বস্ব আটটি কোম্পানি ঋণের নামে বড় অঙ্কের টাকা তুলে নেওয়া হয় বলে উল্লেখ করা হয়।
এর মধ্যেই বুধবার ইংরেজি দৈনিক নিউ এইজে বছর কয়েক আগে মালিকানা বদল নিয়ে আলোচনায় থাকা ইসলামী ব্যাংক থেকে চট্টগ্রামভিত্তিক ‘এস আলম গ্রুপ একক কোম্পানি হিসেবে ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে’ বলে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
ইসলামী ব্যাংকে ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণ কেলেঙ্কারি
ইসলামি শরিয়াহভিত্তিক পরিচালিত ব্যাংকগুলোতে চলছে ঋণের নামে হরিলুট। ঋণ বিতরণের কোনো নীয়মনীতি মানা হচ্ছে না। নামসর্বস্ব কাগুজে প্রতিষ্ঠানে বিপুল পরিমাণে টাকা ঢেলে যাচ্ছে তিনটি ব্যাংক। বাস্তবে এসব প্রতিষ্ঠানের কোনো অস্তিত্ব নেই।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঋণের নামে ভুয়া প্রতিষ্ঠানের খোলসে পাচার হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদন ও ব্যাংকগুলোর নথিপত্র অনুযায়ী, অন্তত ৩০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি প্রভাবশালী চক্র।সূত্রের তথ্য মতে, বিপুল এ ঋণকেলেঙ্কারিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা এবং কয়েকজন পরিচালক এ লুটপাট চালিয়ে যাচ্ছেন।
তথ্য অনুযায়ী, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড-আইবিবিএল থেকে ১১টি অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক থেকে চারটি প্রতিষ্ঠান নিয়েছে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা।অন্যদিকে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে তিনটি প্রতিষ্ঠান নিয়েছে এক হাজার ২০০কোটি টাকা।প্রভাবশালী চক্রের যোগসাজশে গায়েবি প্রতিষ্ঠানে তিন ইসলামি ব্যাংক বিপুল পরিমাণ এ অর্থ বিনিয়োগ করেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তথাকথিত এই ইন্টারন্যাশনাল প্রতিষ্ঠানগুলো আমদানির নামে অর্থপাচারে জড়িত থাকতে পারে। তাই ওভার ইনভয়েসিং ও ব্যাক টু ব্যাক এলসির নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ ইতোমধ্যে বিদেশে চলে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ঋণের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এসএস স্ট্রেইট লাইন নামে গত ৮ আগস্ট রেজিস্ট্রার অব জয়েন স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মস (আরজেএসসি) থেকে একটি যৌথ মূলধনী কোম্পানির রেজিস্ট্রেশন নিয়েছেন দুজন ব্যক্তি।
প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মো. সামিউল আলিমের বাড়ি রাজশাহীর দাওকান্দি, কলুপাড়া এলাকায়। একই জেলার পবা এলাকার মো. শাহজাহান আলী আছেন ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে। কৃষিপণ্য উৎপাদন, আমদানি ও বিপণনের উদ্দেশ্যে তিন কোটি টাকা মূলধনে তারা দু’জন মিলে কোম্পানিটি গড়ে তুলেছেন।
বনানীর বি-ব্লকের ২৩ নম্বর সড়কের ৯ নম্বর বাড়িতে (সিলভার স্টোন শাফায়ার) কোম্পানিটির অফিস। তার ঠিক এক মাস পর ১১ সেপ্টেম্বর একই ঠিকানায় একই ধরনের ব্যবসায়ীক উদ্দেশ্যে সমপরিমাণ মূলধনে আরও দুটি কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন হয়েছে আরজেএসসিতে। এ প্রতিষ্ঠান দুটির মালিকও দুজন করে। এর মধ্যে মেডিগ্রিন ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল রাকিবের গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলায়। আর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুবিন আহমেদের বাড়ি মুন্সীগঞ্জে।এছাড়া খুলনার মো. আবদুল্লাহ শেখ মার্টস বিজনেস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে আছেন। এ প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মো. সেলিম উদ্দিন। তার গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জে। এ তিনটি প্রতিষ্ঠান ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড-আইবিবিএল থেকে শত কোটি টাকা করে ফিক্সট ডিপোজিট (ইসলামী ব্যাংকের পরিভাষায় টিডিআর/এমটিডিআর) জামানত রেখে মোট দুই হাজার ৭০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে।অপর একটি প্রতিষ্ঠান এজে ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ৫০ কোটি টাকা জামানতে ঋণ নিয়েছে ৫০০ কোটি টাকা। আরজেএসসিতে প্রতিষ্ঠানটির তথ্য নেই। কিন্তু ঋণের নথিপত্র অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটির মালিক মো. জাহান বকশ। ব্যবসায়িক ঠিকানা রাজশাহীর পবা এলাকার দাওকান্দির তেকাতাপাড়ায়।ব্যাংক সূত্রের তথ্য অনুযায়ী এ চারটি প্রতিষ্ঠান বিপুল ঋণের নামমাত্র যে জামানত রেখেছিল তার ৯০ শতাংশ উত্তোলন করে নিয়েছে। (ইসলামী ব্যাংকের টিডিআর বা এমটিডিআর থেকে আমানতের টাকা উত্তোলনের সুযোগ রয়েছে। যদিও ডিপোজিট জামানত রাখলে উত্তোলন সুবিধা রহিত হয়ে যায়) অর্থাৎ প্রতিষ্ঠান চারটির তিন হাজার ২০০ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে জামানত আছে মাত্র ৩৫ কোটি টাকা। তবে আরজেএসসিতে প্রতিষ্ঠানগুলোতে লোনের কোনো তথ্য নেই। নিয়ম অনুযায়ী আরজেএসসিকে লোনের তথ্য দেয় ব্যাংক। এর জন্য তারা ৬০ দিন সময় পায়।প্রতিষ্ঠানগুলোর লোন স্টেটম্যান্টের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৮ সেপ্টেম্বর ইসলামী ব্যাংকের ১৯৭৫তম ইসি মিটিংয়ে এসএস স্ট্রেইট লাইন ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের অনুকূলে ৯০০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন হয়েছে। ৩৪৩ নং ম্যামোর ওই ঋণটি দুদিন পর ২১ সেপ্টেম্বর ৬৮৬ নং স্মারকে সেনশন হয়েছে। এর একমাস পর ২৪ অক্টোবর ইসলামী ব্যাংকের ১৯৭৮তম ইসি মিটিংয়ে মেডিগ্রিন ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের অনুকূলে ৯০০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন হয়েছে; যার ম্যামো নং ৪২৩। একই মিটিংয়ে মার্টস বিজনেস লিমিটেডকে ৯০০ কোটি (ম্যামো নং ৪২২) ও এজে ট্রেড ইন্টারন্যাশনালকে ৫০০ কোটি টাকা (ম্যামো নং ৪২১) ঋণ অনুমোদন দেয়া হয়েছে। গত ২৬ ও ২৭ অক্টোবর ৮০৮, ৮১১ ও ৮১২ নং স্মারকে ঋণ তিনটি সেনশন হয়েছে। ঋণ অনুমোদনের সময় এসব প্রতিষ্ঠানের বয়স হয়েছিল মাত্র একমাস।কোনোরকম ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও মাত্র দেড় মাস বয়সের স্বল্প মূলধনী এসব প্রতিষ্ঠানকে একরকম বিনা জামানতে বিশাল অঙ্কের এ ঋণ অস্বাভাবিক মনে হয়েছে আমার সংবাদের কাছে। তাই ঋণের নথির তথ্য অনুযায়ী প্রথমে আরজেএসসিতে খোঁজ নেয়া হয়। আরজেএসসিতে কোম্পানিগুলোর দেয়া ঠিকানায় গিয়ে দেখা যায় ‘সিলভারস্টোন শাফায়ার’ নামের ভবনটি একটি আবাসিক ভবন। যার সামনে লেখা আছে ‘অফিস ভাড়া দেয়া হয় না’। অথচ ইসলামী ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের লোন নেয়া অন্তত চারটি কোম্পানি এই ভবনের ঠিকানা ব্যবহার করেছে।
ভবনের নিরাপত্তাকর্মী হারুন অর রশীদ বলেন, ‘এটি একটি আবাসিক ভবন। এখানে কোনো অফিস নেই। যদি কেউ নিজের ফ্লাটে কোনো প্রতিষ্ঠানের অফিস হিসেবে ব্যবহার করত তাহলো অন্তত এই নামগুলো তারা জানতেন। সেখানে উপস্থিত ভবনের বিভিন্ন দায়িত্বে থাকা আরও কয়েকজনের কাছে জানতে চাওয়া হয় আশেপাশে এ নামে কোনো প্রতিষ্ঠানের কথা তারা জানেন কি-না। তারা জানান, এ ধরনের নাম তারা প্রথম শুনেছেন। এরপর প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকদের নাম বলা হয়।
তারা জানায়, এসব নামের কারও বাসা নেই এবং এমন কাউকে তারা চিনেন না। হারুন অর রশীদ বলেন, আমি অনেকদিন এখানে কাজ করছি, যদি এসব নামের কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এখানে থাকত; তাহলে কেউ না কেউ তাদের চিনত। এরপর যাওয়া হয় লোনের নথিতে ব্যবহার করা ঠিকানায়। বনানীর ডি-ব্লকের ১৭ নম্বর সড়কের ১৩ নম্বর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় নাবিল গ্রুপের অফিস। সেখানে এসব প্রতিষ্ঠানের কোনো অস্তিত্ত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। আশেপাশের ব্যবসায়ীদের কাছে জানতে চাইলে তারা এসব নামে কোনো প্রতিষ্ঠানের কথা শুনেননি বলে জানান। প্রতিষ্ঠানগুলো নাবিল গ্রুপের কি-না তা জানেন না খোদ গ্রুপটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিনুল ইসলাম স্বপন।
তিনি বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে আমি এখনি বলতে চাচ্ছি না। তবে তথ্য সংগ্রহ করে পরে জানাতে পারব।’ কিন্তু পরবর্তীতে তার কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে এজে ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল রাজশাহী জেলার পবা থানার দাওকান্দি এলাকার তেকাতাপারায় অবস্থিত নাবিল গ্রুপের একটি অফিসের ঠিকানা ব্যবহার করেছে। গ্রুপটির এমডি আমিনুল ইসলাম স্বপনের গ্রামের বাড়ি ওই এলাকায়।
এ বিষয়েও কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি। তবে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আমিনুল ইসলামের বাবা মো. জাহান বকশ এজে ট্রেড ইন্টারন্যাশনলে প্রোপ্রাইটর (মালিক)। তিনি নাবিল গ্রুপের চেয়ারম্যানের দায়িত্বেও আছেন। আর অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকরা কেউ তার আত্মীয় কেউ ব্যবসায়িক সহযোগী। অর্থাৎ প্রতিটি ঋণের নেপথ্যে নাবিল গ্রুপের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতাপশালী কারও যোগসাজশে একটি আঞ্চলিক গ্রুপের এমডি আর্থিক খাতের নয়া মাফিয়া হয়ে উঠছেন। ইসলামী ব্যাংকের মতো একটি স্বনামধন্য ব্যাংক থেকে এভাবে বেনামি লোন সৃষ্টি করা বিস্ময়কর বলছেন খোদ ইসলামী ব্যাংকের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তারা।
রাজশাহীর একজন ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘সমপ্রতি প্রকাশিত প্রতিষ্ঠানটির প্রায় সারে ছয় হাজার কোটি টাকা বেনামি ঋণ কেলেঙ্কারির কোনো তদন্ত বা বিচার হয়নি। অদৃশ্য ইশারায় পার পেয়ে যাচ্ছে দেশের অখ্যাত এই শিল্প গ্রুপটি। এর ফলে আরও বেপোরোয়া হয়ে পড়েছে আর্থিক খাতের এই নয়া মাফিয়া।’
এ ব্যবসায়ী বলেন, ‘নাবিল তার প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের নামে শতশত কোটি টাকা লোন করেছে। নাবিলের একজন পিয়নের নামে শতকোটি টাকা লোন রয়েছে; যিনি সাইকেল চালিয়ে অফিসে আসেন।’ইসলামী ব্যাংক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তার যোগসাজশে বিপুল এ অর্থ লেয়ারিংয়ের মাধ্যমে প্রথমে অন্য প্রতিষ্ঠানে, এরপর সোজা বিদেশে পাচার হচ্ছে বলে জানিয়েছে প্রতাপশালী গ্রুপটির একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র। ঋণের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এস এস স্ট্রেইট লাইনকে ৯০০ কোটি টাকা দিয়েছে রাজধানীর কাকরাইল এলাকায় অবস্থিত ইসলামী ব্যাংকের ভিআইপি রোড শাখা।
শাখার ব্যবস্থাপক মজনুজ্জামানের কাছে জানতে চাওয়া হয় কেন পরীক্ষা-নীরিক্ষা ছাড়াই অস্তিত্বহীন কোম্পানিকে লোন দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘লোন দেয়ার আগে আমরা নিয়ম মেনে পরীক্ষা করে তারপরই লোন দিয়েছি।’ যেহেতু বাস্তবে প্রতিষ্ঠানটির কোনো অস্তিত্ব নেই তাই জেনে বুঝেই কারসাজির উদ্দেশ্যে লোনটি দেয়া হয়েছে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ প্রশ্নের উত্তর প্রধান কার্যালয় দেবে। তাদের নির্দেশনা মেনেই আমরা ঋণ দিয়েছি। ঋণটি পরীক্ষা করেই এক্সিকিউটিভ কমিটি পাশ করেছে।’ মেডিগ্রিনকে ৯০০ কোটি টাকা দিয়েছে ইসলামী ব্যাংকের নবাবপুর শাখা। এ বিষয়ে শাখা ব্যবস্থাপকের মন্তব্য নিতে তার কার্যালয়ে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি।’
মার্টস বিজনেস লিমিটেডকে ৯০০ কোটি টাকা দিয়েছে ব্যাংকটির ফার্মগেট শাখা। অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানে লোন দেয়ার বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি শাখা ব্যবস্থাপক আবদুর রব মৃধা। জামানত হিসেবে থাকা এমটিডিআর প্রতিষ্ঠানটি কিভাবে উত্তোলন করল জানতে চাইলে তিনি, নীরব থাকেন। তবে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশনায় সব হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। এ ছাড়া এজে ট্রেড ইন্টারন্যাশনালকে ৫০০ কোটি টাকা দিয়েছে ইসলামী ব্যাংকের রাজশাহী শাখা।
অন্য দিকে, ব্যাংকটির গুলশান-২ শাখা থেকে নাবিল গ্রেইন ক্রপস লিমিটেডকে ৯৫০ কোটি টাকা ও রাজশাহী শাখা থেকে নাবিল ফিড মিলস ও সহযোগী প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে তিন হাজার ১০০ কোটি টাকা ঋণ বা বিনিয়োগ চলতি বছরের ২১ মার্চ ব্যাংকের ৩০৮তম বোর্ডসভায় অনুমোদন দেয়া হয়। যা জামানতবিহীন সন্দেহজনক ঋণ; বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে এ তথ্য উঠে এসেছে। ব্যাংকটির গুলশান-২ শাখা থেকে নাবা অ্যাগ্রো ট্রেড ইন্টারন্যাশনালকে আরও এক হাজার ১৪৮ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে।
এছাড়া রাজশাহী শাখা থেকে গত কয়েক মাসে বিপুল অঙ্কের ঋণ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল প্রডাক্ট প্যালেসকে ৫০০ কোটি, নাবা ফার্ম লিমিটেডকে ৪৮৯ কোটি, নাবিল ফিড মিলস লিমিটেডকে পুনরায় ১৭০ কোটি, আনোয়ারা ট্রেড ইন্টারন্যাশনালকে এক হাজার কোটি, শিমুল এন্টারপ্রাইজকে এক হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই কাগুজে। সরেজমিন এগুলোর কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
অন্যদিকে লোনগুলো মুরাবাহা টিআর পদ্বতিতে বিনিয়োগ হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকের স্বত্ব্বাধিকারে পণ্য ক্রয় করতে হয়। এরপর ওই পণ্যের রশিদের বিপরীতে অর্থায়ন করে ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলো। কিন্তু এসব লোনের ক্ষেত্রে পণ্য ক্রয়ের রশিদ ছাড়াই নগদ অর্থ দেয়া হয়েছে। যা ইসলামী ব্যাংকিংয়ে শরিয়তসম্মত নয়।
এসব বিষয়ে জানতে ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলার কার্যালয়ে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। জনসংযোগ বিভাগের প্রধান ব্যাংকটির ভাইস প্রেসিডেন্ট নজরুল ইসলামের কাছে এমডির বক্তব্য চেয়ে লিখিত আবেদন করা হয়। এ ছাড়া এমডির হোয়াট্সঅ্যাপে একাধিক ক্ষুদেবার্তা পাঠানো হয়েছে; কিন্তু কোনো মাধ্যমেই তিনি সাড়া দেননি।
এছাড়াও চলতি বছরের ২৩ জুন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ২৪৬তম বোর্ডসভায় নাবিল নব ফুড ও সহযোগী প্রতিষ্ঠান, নাবিল ফিড মিলস ও শিমুল এন্টারপ্রাইজের নামে এক হাজার ২০০ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়। একই বছরের ৩০ মে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ৪৮১তম বোর্ডসভায় গুলশান শাখা থেকে নাবিল নব ফুড ও সহযোগী প্রতিষ্ঠান নাবিল ফিড মিলস ও শিমুল এন্টারপ্রাইজের নামে এক হাজার ১২০ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন দেয়া হয়েছে। যা বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে সন্দেহজনক ঋণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ঋণের বিষয়ে জানতে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাঈদ ওয়াশিক মো. আলীকে মুঠোফোনে কল দিলে তিনি রিসিভ করেননি। পরে হোয়াটসঅ্যাপে ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়েও সাড়া মেলেনি। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে বেরিয়ে আসে এসআইবিএলের বিশাল এক ঋণ কেলেঙ্কারির তথ্য। পণ্য আমদানি বাবদ ব্যাক টু ব্যাক এলসির মাধ্যমে ব্যাংকটির বনানী শাখা থেকে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে শার্প নিটিং অ্যান্ড ডায়িং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। যার পুরো অর্থ পাচার হয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। লাইসেন্সবিহীন এই প্রতিষ্ঠানটির বিষয়ে পরিদর্শনের সারসংক্ষেপ পাঠিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এতে দেখা যায়, কোনো প্রকার বৈধ বন্ডেড ওয়ারহাউজ লাইসেন্স লাইসেন্স ছাড়াই প্রতিষ্ঠানটি ২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৮৮৯টি ব্যাকটু ব্যাক এলসি খুলেছে। এর পরিমাণ ১৫৮ কোটি মার্কিন ডলার। দেশীয় মুদ্রায় বর্তমান রপ্তানি নগদায়ন বিনিময় মূল্য ১০০ টাকা হিসাবে এর পরিমাণ ১৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। বিপুল এ অর্থের এলসির বিপরীতে পণ্য রপ্তানি করার কথা থাকলেও বাস্তবে কোনো কাঁচামাল আমদানি বা রপ্তানি হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শকদল প্রতিষ্ঠানটির কারখানায় আমদানিকৃত কাঁচামাল বা প্রস্তুতকৃত কোনো পণ্যের মজুত পায়নি। অর্থাৎ রপ্তানি ছাড়াই আমদানির এলসি খুলে বিপুল এ অর্থ পাচার করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানগুলোতে ইসলামী ধারার তিন ব্যাংকের ঋণের পরিমাণ প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা।
এ বিষয়ে এসআইবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাফর আলমের কাছে জানতে চাওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মিত পরিদর্শন ছিল। এ ধরনের অভিযোগ পেলে তো আমরা নিজেরাই ব্যবস্থা নেবো।’ ছয় বছর ধরে চলে আসা এ অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে অবগত আছেন কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঘটনাটি আমার এমডি হিসেবে যোগদানের আগের। আমি দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে সার্বিক বিষয়ে স্বচ্ছতার সাথে পরিচালনার চেষ্টা করছি।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘ব্যাকিং সেক্টরে মোটা দাগে দুটি বড় সমস্যা রয়েছে। একটি হলো এনপিএল বা খেলাপি ঋণ। যা সরকারি ব্যাংকে বেশি ঘটে। অন্যটি হলো আরপিএল বা রিলেটেড পার্টি ল্যান্ডিং। বেসরকারি ব্যাংকের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো আরপিএল। যার মাধ্যমে খোলস তৈরি করে অর্থ সরিয়ে নেয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত আরপিএলের প্রকৃত তথ্য বের করে এখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া।’
তিনি বলেন, বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিনিধিদের একটি অনুমানভিত্তিক রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী ব্যাংকিং খাতে আরপিএলের পরিমাণ মোট ঋণের ২০ শতাংশের বেশি। এ অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, রপ্তানি আদেশ ছাড়া ব্যাংক থেকে ডলার দিয়ে এলসি খোলার কোনো সুযোগ নেই। যদি এমনটা হয়ে থাকে বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া।’
নাবা অ্যাগ্রো ট্রেড ইন্টারন্যাশনালকে গত এপ্রিল ও জুলাই মাসে ১ হাজার ২২৪ কোটি টাকা দিয়েছে ইসলামী ব্যাংকের গুলশান শাখা। ব্যাংকটির নথিপত্রে দেওয়া কোম্পানির ঠিকানা ১৫/২ আহমদনগর, রাজশাহী। সেখানে এ নামে কোনো প্রতিষ্ঠান পাওয়া যায়নি। তবে এ ঠিকানায় নাবিল গ্রুপের পাঁচতলা আবাসিক ভবন রয়েছে। সেখানে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা থাকেন। ভাড়াও দেওয়া আছে। একই ঠিকানা ব্যবহার করে নাবিল ফিড মিলস গত ২৭ অক্টোবর ইসলামী ব্যাংকের রাজশাহী শাখা থেকে নেয় ৬১ কোটি টাকা।
রাজশাহীর ঘোড়ামারা ২১/৪ শিরোইল, ঠিকানা ব্যবহার করে ইন্টারন্যাশনাল প্রোডাক্ট প্যালেস গত ৪-৬ সেপ্টেম্বর সময়ে ইসলামী ব্যাংকের রাজশাহী শাখা থেকে নেয় ৫৪৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৪ সেপ্টেম্বর ১৪২ কোটি টাকা, ৫ সেপ্টেম্বর ২৫০ কোটি টাকা এবং ৬ সেপ্টেম্বর ১৫৩ কোটি টাকা। এ ঠিকানায়ও এ নামে কোনো প্রতিষ্ঠান খুঁজে পাওয়া যায়নি।
রাজশাহীর গোদাগাড়ীর ঝিকরাপাড়া ঠিকানা ব্যবহার করে নাবা ফার্ম লিমিটেড ইসলামী ব্যাংকের একই শাখা থেকে গত অক্টোবরের এক সপ্তাহে নেয় ৬৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১০ অক্টোবর দেওয়া হয় ১০৭ কোটি টাকা, ১১ অক্টোবর ৯৭ কোটি টাকা, ১৯ অক্টোবর ২৪৪ কোটি টাকা, ২৬ অক্টোবর ৫৩ কোটি টাকা এবং ২৭ অক্টোবর ১৩৮ কোটি টাকা। ওই ঠিকানায় নাবা ফার্ম লিমিটেড নামের একটি মুরগির খামার রয়েছে। যার ধারণক্ষমতা ৭ লাখ ২০ হাজার। এখন দৈনিক প্রায় দুই লাখ ডিম পাওয়া যায়।
রাজশাহীর খড়খড়ি বাইপাস এলাকার বামন শিখরের ঠিকানা ব্যবহার করে আনোয়ারা ট্রেড ইন্টারন্যাশনালকে গত জুলাই মাসেই ১ হাজার ৯০ কোটি টাকা দেয় ইসলামী ব্যাংকের রাজশাহী শাখা। এ ঠিকানায় আনোয়ারা ট্রেডের কোনো প্রতিষ্ঠান খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে নাবা ফার্ম লিমিটেডের একটি ডিম বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। সেখানে সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে, এটি নাবিল গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান।
রাজশাহীর পবা এলাকার ভেড়াপোড়া বাজারের ঠিকানা ব্যবহার করে রাজশাহী শাখা থেকে শিমুল এন্টারপ্রাইজ নেয় ১ হাজার ৬৯৩ কোটি টাকা, যা দেওয়া হয় গত জুলাই ও নভেম্বর মাসে। এর মধ্যে ২৪ জুলাই ৩৩৫ কোটি টাকা, পয়লা নভেম্বর দেওয়া হয় ২১৩ কোটি টাকা, ১৬ নভেম্বর ৫৩৪ কোটি টাকা এবং ১৭ নভেম্বর ৬১০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে।
পবার ওই এলাকায় গিয়ে শিমুল এন্টারপ্রাইজ নামে কোনো প্রতিষ্ঠান পাওয়া যায়নি। বাজারের একাধিক মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একসময়ের শিমুল এন্টারপ্রাইজই এখন নাবিল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক নামে পরিচিত। এখানে নাবিলের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে নাবিল অটো রাইস মিল, নাবিল অটো ফ্লাওয়ার মিলস, নাবিল ফিড মিলস, নাবিল কোল্ডস্টোরেজ, নাবিল ডাল মিল। বড় এলাকাজুড়ে প্রতিষ্ঠানটিতে স্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রায় ৩০০ জন। দৈনিক মজুরি বা চুক্তিভিত্তিক কাজ করেন এক হাজার থেকে দেড় হাজার জন।
নাবিল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের সহকারী মহাব্যবস্থাপক মো. আয়নাল হক বলেন, এখানে বাংলাদেশ থেকে ধান সংগ্রহ করে শুধু চাল বানানো হয়। আর বাকি পণ্যগুলো বাইরে থেকে এনে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। এখানে গড়ে ময়দা উৎপাদন করা হয় দেড় শ টন, চাল ১০০ থেকে ১৫০ টন, ফিড (মাছ ও পোলট্রি) ১০০ থেকে ১৫০ টন ও মসুর ডাল ২০০ টনের মতো।
ইসলামী ব্যাংকের রাজশাহী শাখার আমানত ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা এবং ঋণ ৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। নাবিল গ্রুপকে ঋণ দিতে ইসলামী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় রাজশাহী শাখায় টাকা দিয়েছে। শাখার ঋণের মধ্যে শুধু নাবিল সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে গেছে ৫ হাজার ১০ কোটি টাকা। এতে পুরো শাখাটি ওই গ্রাহকের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে।
কোম্পানিগুলোর সবই নাবিল গ্রুপের কি না, তা জানতে চাইলে গ্রুপটির এমডি মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আমি ১৮ বছর ধরে ব্যবসা করি, এখানে লুকানোর কিছু নেই। যা আছে তার সবটাই ব্যাংক জানে। আমার ঋণের বিষয়ে ব্যাংক বক্তব্য দেবে।’
পিছিয়ে নেই ফার্স্ট সিকিউরিটি ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক
নাবিল গ্রুপ ইসলামী ব্যাংকের পুরোনো গ্রাহকদের একজন। তবে অন্য ব্যাংকগুলোতে চলতি বছরেই গ্রাহক হয়। এসব ব্যাংকের গ্রাহক হওয়ার পর সব ব্যাংকেই গ্রুপটির ঋণ বেড়েছে হু হু করে। চলতি বছরের শুরুতে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণ পেতে বনানী শাখায় হিসাব খোলে নাবিল গ্রুপ।
এরপর গ্রুপটির প্রতিষ্ঠান নাবিল নাবা ফুডস, নাবিল ফিড মিলস ও শিমুল এন্টারপ্রাইজকে এক হাজার ২০০ কোটি টাকা ঋণ আবেদন করে। ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ গত জুনে ৫০০ কোটি টাকা ফান্ডেড (সরাসরি ঋণ) ও ৭০০ কোটি টাকা নন ফান্ডেড (ঋণপত্র) সুবিধা দেওয়ার অনুমোদন দেয়। এরপর গ্রুপটি ফান্ডেড ঋণের ৩০০ কোটি টাকা নিয়েছে বলে জানা গেছে। বাকি অর্থ নেওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে।
যখন ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক নাবিল গ্রুপকে ঋণ অনুমোদন দেয়, তখন গ্রুপটির কাছে অন্য ব্যাংকের পাওনা ছিল ফান্ডেড ৩ হাজার ৩৪৮ কোটি টাকা ও নন ফান্ডেড প্রায় ২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা।
এ নিয়ে জানতে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে গেলে উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) মাসুদুর রহমান শাহ বলেন, ‘নাবিল আমাদের নতুন গ্রাহক। তবে এখন পর্যন্ত দেওয়া ঋণ সম্পূর্ণ নিরাপদ। গ্রুপটির ব্যবসা ভালো চলছে। এ জন্য ঋণ অনুমোদন হয়েছে। তবে ঋণের টাকা ছাড় করতে গ্রুপটি অতটা আগ্রহী না। আমরা পর্যাপ্ত জামানত পাওয়া সাপেক্ষ ঋণ ছাড় করছি।’
চলতি বছরে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের গুলশান শাখায় গ্রাহক হয় নাবিল নাবা ফুডস, নাবিল ফিডস লিমিটেড ও শিমুল এন্টারপ্রাইজ। গত জুলাইয়ে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ এ তিন গ্রাহকের অনুকূলে ঋণ দেয়। এমন অর্থায়ন করতে ফার্স্ট সিকিউরিটি ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের বড় অঙ্কের টাকা ধার দিয়ে রেখেছে ইসলামী ব্যাংক।
এ নিয়ে জানতে চাইলে ব্যাংকটির এমডি জাফর আলম বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানগুলো ভালো, এ জন্য আমরাও অর্থায়ন করেছি। তবে অনুমোদিত সীমার পুরোটা এখনো দেওয়া হয়নি।’
কেন এমন অর্থায়ন
ইসলামি ধারার এই তিন ব্যাংক এসব ঋণ দিয়েছে মুরাবাহ টিআর পদ্ধতিতে। এ পদ্ধতিতে বিনিয়োগ করতে পণ্য ক্রয়ের নথিপত্র থাকতে হয়। তবে ব্যাংকগুলোর কাছে পণ্য ক্রয়ের কোনো প্রমাণ নেই বলে জানিয়েছেন ব্যাংক তিনটির কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ব্যাংক তিনটির কর্মকর্তারা পুরো বিষয়টি অনানুষ্ঠানিক জানালেও তেমন সাড়া পাচ্ছেন না। এর আগে এসব ব্যাংকে একাধিকবার অনিয়ম ধরতে গিয়ে ফিরেও এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারাও এখন অনেকটা চুপ হয়ে গেছেন।
ইসলামী ব্যাংকের পর্ষদের বেশির ভাগ সদস্য একটি বড় গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মনোনীত পরিচালক। গ্রুপটির পক্ষে এখন ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক মোহাম্মদ নাজমুল আহসান। আর ভাইস চেয়ারম্যান দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক কমিশনার মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন।
এ নিয়ে জানতে ব্যাংকের চেয়ারম্যানকে ফোনে পাওয়া যায়নি। তবে ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন বলেন, ‘সব বিষয় পর্ষদের সভায় আসে না। নিচ থেকেই অনুমোদন হয়ে যায়। পর্ষদে আসলে চেয়ারম্যান সাহেব মতামত দেন। তবে সবকিছু নিয়ম মেনে চলছে।’
ইসলামী ব্যাংকের এমডি মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা প্রথম আলোকে বলেন, ‘নাবিল গ্রুপের ঋণ ৩-৪ হাজার কোটি টাকার মধ্যে। তারা আমাদের বেশ পুরোনো গ্রাহক। আর অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো সবই ট্রেডিংনির্ভর। এসব অফিস সাজানো–গোছানো হয় না। এ জন্য হয়তো ঠিকানায় গিয়ে পাওয়া যায়নি। ইসলামী ব্যাংকে কোনো উল্টাপাল্টা কাজ হয় না। যা হচ্ছে, সবই নিয়ম মেনে হচ্ছে।’
ইসলামী ব্যাংক একসময় ছিল দেশের ভালো ব্যাংকগুলোর একটি। ভালো শিল্প গ্রুপগুলো ছিল ব্যাংকটির গ্রাহক। মালিকানা পরিবর্তনের সাত বছরের মাথায় ভালো গ্রুপগুলো ব্যাংক ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। আর শীর্ষ গ্রাহক হিসেবে যুক্ত হয়েছে স্বল্প খ্যাত অনেক প্রতিষ্ঠান।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ এ নিয়ে বলেন, ‘এভাবে ব্যাংকের মালিকানা পরিবর্তনটি একটি ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। যে ব্যবসায় ঋণ দিয়েছে, তা যথাযথ আছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে। অর্থনীতি সংকটের সময় এমন বড় অনিয়ম হলে তা কোনোভাবেই বরদাশত করা যাবে না। বাংলাদেশ ব্যাংককে উদ্যোগী হয়ে এসব বিষয়ে নজরদারি বাড়াতে হবে। ওপরের নির্দেশের জন্য বসে থাকলে চলবে না।’