কক্সবাংলা রিপোর্ট(১৭ আগস্ট) :: নাম জহির আহম্মেদ। লোকে ডাকেন মৌলভী জহির। সুশ্রী সুফি চেহারার মানুষ। ঢাকায় তার বাসা, টেকনাফে ওষুধের দোকান। সেই দোকানে ওষুধ বেচাকেনার আড়ালে করতেন নিষিদ্ধ মাদকদ্রব্য ইয়াবার চালান সংগ্রহ। সেই চালান ঢাকায় এনে পরিবারের সবাই মিলে বেচতেন। পাশাপাশি জহির গড়ে তোলেন স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে, মেয়ের স্বামী, মেয়ের স্বামীর ভাইসহ ২৫-৩০ জনের একটি পারিবারিক সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট মিয়ানমার থেকে ইয়াবা আনিয়ে সুকৌশলে ঢাকা শহরে বিক্রি করতো। ৫-৬ বছর ধরে এই সিন্ডিকেট ইয়াবার ব্যবসা করে আসছিল ঢাকায়। এই ছিল ‘মৌলভী’ পরিচয়ের এক মানুষের কর্মকাণ্ড!
জানা যায়, গত ১৫ বছর আগে রোজিনা এন্টারপ্রাইজ নামে একটি সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসা শুরু করে জহির। তখন তার সঙ্গে টেকনাফের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট সাইফুলের পরিচয় হয়। তার হাত ধরেই ইয়াবা ব্যবসায় জড়ায় জহির।
র্যাবের মুফতি মাহমুদ খান বলেন, সাইফুলের মাধ্যমে জহির ইয়াবা ব্যবসায় সম্পৃক্ত হয়। টেকনাফে যদিও তার একটি ওষুধ ফার্মেসির ব্যবসা রয়েছে। তা মূলত ওষুধ ব্যবসার আড়ালে মাদক ব্যবসার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। টেকনাফে ইয়াবা সংগ্রহের পর তার স্ত্রীর তত্ত্বাবধানে পরিচিত ও নিকট আত্মীয়দের বাসাবাড়িতে রাখা হয়। টেকনাফের ভেতরে ইয়াবা বহনের জন্য মোমিনের ইজিবাইক ব্যবহার করা হয়। জহিরের স্ত্রী টেকনাফ ও কক্সবাজার এলাকায় ইয়াবার বাহক হিসেবে কাজ করে।
মো. জহির আহম্মেদ সিন্ডিকেটের মিয়ানমার কানেকশন
মিয়ানমারের এই সিন্ডিকেটের সরাসরি সদস্য রয়েছে, যে মিয়ানমারের মংডু থেকে নৌপথে টেকনাফে নিয়ে এসে ইয়াবা মজুত করে। এরপর সেগুলো ক্রমান্বয়ে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে র্যাব মুখপাত্র বলেন, এই সিন্ডিকেটের মিয়ানমার প্রতিনিধি আলম ওরফে বর্মাইয়া আলম। সে মিয়ানমারের মংডুতে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। এছাড়া টেকনাফেও বর্মাইয়া আলমের একটি বাড়ি রয়েছে। বর্মাইয়া আলম টেকনাফের বিভিন্ন এলাকা দিয়ে নৌপথে মংডু হতে ইয়াবা পাচার করে টেকনাফের নাজিরপাড়া, জালিয়াপাড়াসহ টেকনাফের বিভিন্ন এলাকার বাড়িতে মজুত রাখে। মজুত ইয়াবাগুলো জহির আহম্মেদের জামাতা আব্দুল আমিন, নুরুল আমিন ও মোমিন টেকনাফে বার্মাইয়া আলমের কাছ থেকে সংগ্রহ করে। এরপর আব্দুল আমিন, নুরুল আমিন ও আটককৃত মোমিন টেকনাফ বা কক্সবাজার থেকে বিভিন্ন পরিবহন, কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ঢাকায় পাচার করে থাকে।
ইয়াবা পাচারের কৌশল
মিয়ানমারের মংডু থেকে নৌপথে ইয়াবার চালান টেকনাফে আসার পর সেখানেই মজুত রাখা হয়। এরপর বিভিন্ন কৌশলে নিয়ে আসা হয়। কৌশল সম্পর্কে র্যাবের মুখপাত্র মুফতি মাহমুদ খান জানান, বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রিক্যাল সরঞ্জাম, যেমন- ফ্যান, ওয়াশিং মেশিন, এসি ইত্যাদির ভেতর ইয়াবা লুকিয়ে পরিবহন বা কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ঢাকায় পাঠায়। যাত্রীবাহী বাসে পরিবহনের সময় টেকনাফের দুই ব্যক্তি বাহক হিসাবে কাজ করে। মাঝে মধ্যে বহনকারী ছাড়া নির্ধারিত ড্রাইভার ও হেলপারের মাধ্যমেও ঢাকায় ইয়াবা পাঠানো হয়। ঢাকা থেকে উদ্ধার ইয়াবাগুলোও ৭-৮ দিন আগে দুটি চালানে নিয়ে আসা হয়। দুই চালানে কার্টনের মধ্যে রাখা ছিল এসি ও ফ্যান। এসব এসি ও ফ্যানের ভেতর লুকিয়ে ঢাকায় চালান করা হয়।
আটক জহির আহম্মেদ ও মোমিনের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, টেকনাফ ও কক্সবাজার থেকে ঢাকায় ইয়াবা পাঠানো জন্য বাহককে বা কুরিয়ার সার্ভিসে ইয়াবা বুঝিয়ে দিয়ে আকাশপথে ঢাকায় আসতো মোমিন ও আব্দুল আমিন। এরপর মোমিন ও আব্দুল আমিন ঢাকায় পৌঁছানোর পরে পূর্বে নির্ধারিত স্থান, বাসস্ট্যান্ড ও কুরিয়ার সার্ভিস হতে ইয়াবা সংগ্রহ করে জহির আহম্মেদের বাসায় পৌঁছে দিত।
মোমিন নিয়মিত আকাশপথে কক্সবাজার থেকে ঢাকায় যাতায়াত করতো। আর এসব মাদক বিক্রির টাকা লেনদেন হতো পরিবহন সেক্টরে কর্মরত ড্রাইভার ও হেলপারের মাধ্যমে।এছাড়া ইলেকট্রনিক মানি ট্রান্সফার, মোবাইল ব্যাংকিং, ব্যাংক ও হুন্ডি ব্যবসায়ীদের মাধ্যমেও টাকা টেকনাফে পাঠানো হতো।
উদ্ধার হওয়া নগদ টাকা ও মোবাইল ফোনর্যাবের মুখপাত্র জানান, জহির আহম্মেদ ও তার ছেলে বাবু ঢাকার কালাবাগান ও ধানমন্ডিসহ বিভিন্ন এলাকায় বাসা ভাড়া করে একযোগে ইয়াবা ব্যবসা চালিয়ে আসছিল। বাসা ভাড়া,আনুষঙ্গিক সার্ভিস চার্জ বাবদ প্রতিমাসে দুটি ভাড়া বাসা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এক লাখেরও বেশি টাকা খরচ করতো তারা। প্রতিটি বাসায় এক বছরের বেশি সময় তারা অবস্থান করতো না। পাশাপাশি বাসাগুলো নির্বাচন করতো অভিজাত এলাকা দেখে, যাতে কেউ সন্দেহ করতে না পারে। সর্বশেষ বাবু গ্রেফতারের পর ধানমন্ডির বাসা পরিবর্তন করে এলিফ্যান্ট রোডে নতুন বাসা ভাড়া নেওয়া হয়।
আটককৃতদের মধ্যে মোমিন ইজিবাইক ব্যবসার আড়ালে ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। সে জহির আহম্মেদের বড় ছেলে বাবুর মাধ্যমে ইয়াবা ব্যবসায় যুক্ত হয়। সে গ্রেফতারকৃত জহিরের নির্দেশনায় তার জামাতা আব্দুল আমিন ও নুরুল আমিনের সাথে ইয়াবা সংগ্রহ, বিতরণ ও অর্থ আনা-নেওয়ার কাজে জড়িত হয়। এছাড়া সে ঢাকায় অবস্থানকালীন খুচরা মাদক বিক্রেতাদের কাছে ইয়াবা পৌঁছে দিতো। ইয়াবা ব্যবসার পরিধি আরও বাড়ানোর কাজটিও করতো সে। এছাড়া অন্য আটককৃতরাও স্ব-স্ব সেক্টরে ও এলাকায় মাদক বিক্রির সঙ্গে জড়িত রয়েছে।
আটককৃতদের সম্পর্কে র্যাব জানায়, আটক ফয়সাল আহাম্মেদ (৩১) একটি বেসরকারি ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার। গত ৩ বছর ধরে ইয়াবা সেবন করে আসছে এবং ধীরে ধীরে ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছে। মিরাজ উদ্দিন নিশান (২১) একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের ১ম সেমিস্টারে ছাত্র। মোমিন ও তার বাড়ি একই অঞ্চলে হওয়ায় পরিচয় সূত্রে সে ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে। সে একজন ইয়াবা সেবনকারীও।
তৌফিকুল ইসলাম ওরফে সানি (২১) ঢাকায় একটি কলেজে ম্যানেজমেন্ট ১ম বর্ষের ছাত্র। তার কলেজের বন্ধু মিরাজ উদ্দিন। তার সূত্র ধরেই মোমিনে সঙ্গে পরিচয়। সে গত দেড় বছর যাবৎ ইয়াবা সেবন এবং ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত। সঞ্জয় চন্দ্র হালদার (২০) মাদারীপুরের একটি কলেজ হতে এইচএসসি পাস করে বর্তমানে পারিবারিক ব্যবসায় যুক্ত।
গত এক বছর থেকে ইয়াবা সেবন করছে এবং তৌফিকুল ইসলামের মাধ্যমে নিশানের সঙ্গে পরিচয় সূত্রে ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছে। সে এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ইয়াবা সংগ্রহ করে শরীয়তপুরে খুচরা বিক্রি করে আসছিল। আব্দুল আমিন (জহিরের জামাতা) ও আব্দুল আলিমের ভাই নুরুল আমিন সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রদত্ত মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
উল্লেখ্য ১৬ আগস্ট বৃহস্পতিবার রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের একটি বাসা থেকে ইয়াবার ব্যবসা পরিচালনা করছিলেন ৬০ বছর বয়সী জহির আহাম্মেদ ওরফে মৌলভী জহির।দীর্ঘ নজরদারির পর গত বুধবার থেকে এই পরিবারের সদস্যদের গ্রেফতারে নামে র্যাব।
গত বৃহস্পতিবার এই সিন্ডিকেটের মূলহোতা জহির আহাম্মেদসহ ৬ জনকে আটকের পর পারিবারিক ইয়াবা ব্যবসার বিষয়টি জানতে পারে র্যাব। গত ১৫ আগস্ট থেকে ১৬ আগস্ট সকাল ৮টা পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানে এলিফ্যান্ট রোডের দুটি বাসা ও আটক ৬ জনের কাছ থেকে ২ লক্ষ ৭ হাজার ১০০ পিস ইয়াবা এবং মাদক বিক্রির ১৬ লক্ষ ৬৪ হাজার একশত টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধারকৃত মাদকের মূল্য প্রায় ৭ কোটি ২৪ লাখ ৮৫ হাজার টাকা।
আটককৃতরা হলেন, জহির আহাম্মেদ ওরফে মৌলভী জহির (৬০), মমিনুল আলম ওরফে মোমিন (৩০), ফয়সাল আহাম্মেদ (৩১), মিরাজ উদ্দিন নিশান (২১), তৌফিকুল ইসলাম ওরফে সানি (২১) ও শ্রী সঞ্জয় চন্দ্র হালদার (২০)।
এ ব্যাপারে র্যাবের মুখপাত্র মুফতি মাহমুদ খান বলেন, আমরা জহির আহাম্মেদকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে জানতে পেরেছি, সে এবং তার বড় ছেলে জহিরুল ইসলাম ওরফে বাবু (২৮) বিগত ৫-৬ বছর ধরে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বাসা ভাড়া করে ইয়াবা ব্যবসা করছে। বাবু গত ২৫ এপ্রিল মাদকদ্রব্যসহ ধানমন্ডি এলাকায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অভিযানে গ্রেফতার হয় এবং বর্তমানে সে কারাগারে রয়েছে।
এছাড়া ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত রয়েছে জহির আহম্মেদের স্ত্রী, কন্যা, তার বড় জামাতা আব্দুল আমিন, জামাতার ভাই নুরুল আমিন। এছাড়াও টেকনাফের বেশ কয়েকজন জড়িত রয়েছে তাদের সিন্ডিকেটে।
এই সিন্ডিকেটে আরও জড়িত রয়েছে পরিবহন সেক্টরে কর্মরত কয়েকজন ড্রাইভার ও হেলপার, দুটি কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মচারী, ঢাকার কয়েকজন খুচরা বিক্রেতা এবং গ্রেফতারকৃতরা। এই সিন্ডিকেটের সদস্য সংখ্যা প্রায় ২৫-৩০ জন। আর এই সিন্ডিকেটের মূলহোতা জহির আহম্মেদ।
র্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জানান, আটককৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে, যা যাচাই বাছাই করে পরবর্তী কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে।
Posted ৪:১৪ অপরাহ্ণ | শুক্রবার, ১৭ আগস্ট ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta