মঙ্গলবার ২১শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৭ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শিরোনাম

মঙ্গলবার ২১শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

শিরোনাম

উৎপলের কবিতার ফর্মের ডিকশন : প্রথামুক্তির ব্যাকরণ ও বিদ্রোহ

শুক্রবার, ১০ আগস্ট ২০১৮
793 ভিউ
উৎপলের কবিতার ফর্মের ডিকশন : প্রথামুক্তির ব্যাকরণ ও বিদ্রোহ

কক্সবাংলা ডটকম(৯ আগস্ট) :: উৎপল কুমার বসু বর্তমান বাংলা কবিতার অন্যতম স্পেস ও ফর্ম। তাঁর কবিতার পাসপেকটিভ নিয়ে এই বার্তা ডিসকোর্স যোগ্য। উহ্যত-একথা বলা যায় তাঁর অন্তর্সংকটের ভাষা থেকে নোতুন শিল্পভাবনা মিথ হয়ে ওঠে। কেননা, আকার ও পরিপ্রেক্ষিতে যাবতীয় বিনির্মাণ প্রকাশিত। এই প্রকাশের আকার কী? – ভাবে, বর্ণে, রং-এ মাখা সে ঘুড্ডি; কবি ও পাঠকের সাংকেতিক চিহ্ন অথবা তা স্বয়ং সম্পূর্ণ ফেজ কিংবা তার কোনটিই নয়- শুধু মাত্র বিষয়ের প্রক্রিয়া; যা কবি উত্থাপন করেছেন- পাঠক যে ভাবে, যে মনে তা গ্রহণ করেছেন- তার প্রতিক্রিয়া পদ্ধতি। সে জন্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কবিতাকে বুঝতে যাওয়াটা অনুভূতির রহস্যেও গোলক ধাঁধাঁয় অথবা মুগ্ধতার বিড়ন্বনায় নিজেকে নিয়ে যাওয়া ছাড়া অন্য কিছু নয়?

কবিতা লিখতে গিয়ে, কলা ও কৈবল্য নিয়ে ভাবতে গিয়ে যে অরগ্যানিক বোধিসত্ত্বা আমার মনোজাগতিক নন্দনতত্ত্বের ধারণা ও তার জাঁহাবাজমর্মকে আঘাত করে, চূর্ণ করে দেয় নোতুন ডিকশনে এবং যাঁর অভিনব ব্যাকরণ ও বিদ্রোহ বঙ্গকবিতাবিদ্যাকে অপ্রচলের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়- তাকে নিয়ে আর যা করা যাক আলোচনাটা দুরূহ সে কথা মেনেই রচি মম এই ফাল্গুনী।

‘‘…….কবিতা আমরা জানি কোন স্বয়ং সম্পূর্ণ বস্তু নয়।’’

কবিতা হয় কী- একটা প্রচ্ছন্ন ক্রিয়া: শব্দ, বর্ণ, র-এর ফুটকিতে অভিনব এক ভাবেব আধার। আর তা যা অধিকার করে থাকে- তা অব্যাখ্যাত। যা বয়ে আনে এক দূরবাণী, চেনার হেরফেরে তার সাহিত্যস্বাধীন ব্যাখ্যা ভিন্ন হয়ে ওঠে। তারপরও অত্যন্ত নির্লিপ্ত ও নিজস্ব একটা ঢং এবং ত্রিভূজের ত্রিকোণের মতো স্পেস আছে- এই কবিতা নামক ধ্বনিগুঞ্জনমালার। ধ্বনির এ্ ঘনঘোর প্রস্তাব কবিতাকে দুরাগত করে রাখে। বলে, আছন্ন সম্মোহনের ভাষা; বক্ষে জ্বেলে দেয় রহস্যের নির্মল আগুন। এখন ভাবো, ভাবিয়া মরো-কিন্তু এরপরও উৎপল ভিন্ন কিছু পথ্য জোগায়। কথা বলে আরেক ভাষায়; তাঁর ভাবে, ভাষায় লেগে থাকে পদের ফলজ ও ভেষজ গুণ। আমাদের চৈতন্যে আত্মপুষ্টি ও দূরারাগ্য লাভ করে। এই সবকিছু ঘটে- সদাভ্রাম্যমাণ ভাবনার ভেতর; কেননা

‘‘ কবিতা, পাঠক এবং কবির মধ্যে এক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকারী পদ্ধতি’’

প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি কবির ভেতরে, শব্দ বর্ণমালার ভেতরে এমনকি পাঠকের পাঠক্রিয়ার ভেতরেও থাকে- তাকে অনুভূতির হাতের মুঠোয় এড়ো মেরে পেড়ে আনা যায়? তবু সে অসম্ভব দরোজাকে ব্যাখ্যা করা যায়না। এ ক্ষেত্রে কোনটা কবিতা, কোনটা কবিতা নয় এরকম ব্যাখ্যা চলেনা কিন্তু এর ভেতরে প্রবেশের একটা আলাদা তৃতীয়মাত্রা আছে- যাকে অভিনব কাব্য ব্যাকরণ বলো- আর কলাকৈবল্য বলো- তা কিছু একটা; অবশ্যই তা এই পৃথিবীর মতো আপেক্ষিক- পরিবর্তনশীল, নশ্বর অংশ? অথচ এই কুহকী নির্মাণ মৎস্যকন্যার মতো নিয়ে যায় অনুভূমির মর্মসাগরে। তাই অনুমান ও অনুভূতির ব্যস্তবতার একসেন্টগুলি আমাদের ইন্দ্রিয়কে ভারাক্রান্ত করে তোলে। আর এটি ঘটে ফর্ম দিয়ে, কনটেন্ট দিয়ে, কলাকৈবল্যের ব্যাকরণগত চাবিশব্দ দিয়ে-

‘‘প্রক্রিয়ার জন্মদাত্রী বলে কবিতার প্রাণ আরোপিত হয়।’’

এইসব ভাবনা অরগ্যানিক, অন্যরকম বোধাক্রান্ত- যা চৌদিকের সাজানো জীবনের জল হাওয়া পরিবর্তন করে তুচ্ছ করে দেয়। আর উৎপলের কাব্যলোচনায় এই ভাবনা তাই ক্রোড়পত্র রূপে প্রকাশিত। আমরা যে চাবিশব্দ দিয়ে সেই অপ্রচল শব্দ বাস্তবতাকে ছুঁতে চাই- তাই হয়ে ওঠে উৎপলের

‘‘কথা বলি আরেক ভাষায়’’-

‘‘সূচের মতোন ঢুকে পড়ো বিবিধ ফাটলে, কবিরা তো সহজে

পাল্টায় নিজের ঘর, চামড়া বদল করে, নইলে কী ভাবে

আমি বা তোমাকে ডাকি অন্য নামে, কথা বলি আরেক ভাষায়?’’

যখন আমরা কথা বলি আরেক ভাষায়- তখন ‘‘কবিতা যখন কবিতা থেকে দূরে’’ কিংবা ‘‘এখনকার কবিতা ঠিক বুঝতে পারিনা’’- এই ধরণের পাণ্ডিত্য কি কবিতা সম্পর্কিত কোন বিষয় হতে পারে? যাঁরা একটু অন্যরকম ‘‘নশ্বরতার মাঝখানে থাক এক ধ্যানে বসা যোগী’’- তাঁদেরকে বোঝা এমনি সহজ? তা নয়- তাঁরা ভাবনার জটিল প্রতিনিধি। মধুসূদনের কবিতাকল্পনালতার ব্যাখ্যা কী তারা বোঝেন? এইসব ব্যাখ্যা খুঁজতে যাওয়া অর্থহীন আর এইসব ক্ষেত্রে উৎপলের কবিতা সবসময় দূরবাণী হয়ে ওঠে। কেননা, কবিতা যে প্রকরণ সূড়ঙ্গ আমাদের সম্মুখে দাঁড় করিয়ে দেয় তা ব্যাখ্যাতীত। এক্ষেত্রে আমরা কী বলতে পারি তা আমাদের জানা নেই…? এইসব কবিতার আত্মপ্রকাশের ভাষা বস্তুজগতের নির্দিষ্ট কোন অর্থের বাইরে- তবু এক অচেনা বিস্তৃতিতে পাখা মেলে; যা শব্দের অমোঘ ফল।

উৎপলের কবিতার একটা আলাদা চেহারা আছে, ফর্মের থেকে যাকে ‘মেট্রোপ্যাটার্ন’ বলা যেতে পারে। এবং সেটি অন্য আর পাঁচজন বাঙালি কবির মতো কেরাণীসূলভ বা আধুনিকতার আত্মা প্রতরণা নয়- বরং তা কখনো কখনো ইউরোপের গার্ডেনে ফোটা ফুল মনে হতে পারে?

কিন্তু সে উদাহরণ নির্দিষ্ট অর্থ বা শব্দ ব্যঞ্জনার বাইরে। সে কারণে এইসব ক্ষেত্রে কবিতাকে বুঝতে না চেয়ে, কবিতার প্রত্নচৈতন্য বা অতলকে আবিস্কার করার অভিপ্রায় নেওয়া ভালো। কিন্তু মনে রাখতে হবে, উৎপলের ভাষা প্রথাবদ্ধ নয় প্রবণতাতাত্যাগী; তাঁর ভাবনাগুলি সদাভ্রাম্যমাণ- সত্ত্বা নির্গত পরিকাঠামোতে মোড়া- ‘কিছু না বলা উদ্ভাস’- পড়ার পর ভাবনার পাগলামী জাগে; অথচ ভাবনাটা অর্থহীন অর এই দীর্ঘ শব্দ- মহাকালে গড়ে ওঠে আমাদের নন্দন চৈতন্য- শুরু হয়ে যায় নি:শব্দ আদিম প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার তথাকথিত আধুনিক, উল্টরাধুনিক- কলাচৈবল্য আছে কি নেই- তা কি বিচার্য বিষয়? ফলে, কবিতা শত বিচিত্র প্রসঙ্গেও নিমন্ত্রণে পাগলের ম্যাজিক রিয়েলিটিতে পৌছে যায়। তার স্থায়ীত্ব, ভালোমন্দ বিচার্য মাপকাঠি থাকেনা।

‘‘ অর্থাৎ বস্তু ও প্রাণ, ব্যাকরণ ও বিদ্রোহ, শৈলী ও প্রযুক্তিতে জুড়ে রয়েছে এক সেতু যার নাম নশ্বরতা। কবিতার মৃত্যু হয়। লুপ্ত হয় তার ভাষা, সংকেত, উপদেশ ও কলাচৈবল্য…।’’

কিন্তু অমারতালোভী বলো আর প্রতিষ্ঠান বিরোধী বলো- এই নশ্বরতাকে মেনে নিয়েই কবিতার অনশ্বরতাকে ছুঁতে চান কবি; বলতে চান- ফর্মে কিংবা কনটেন্ট। যে কোন ভাবেই তারা এই পরিবর্তনের হাওয়াকে ছড়িয়ে দেয় সর্বশক্তিমান সৌন্দর্যের তৃতীয় মাত্রায়। উৎপল এক্ষেত্রে ফর্মকে নিয়ে এগোয়- কথা বলে আরেক ভাষায় আর তার সে ভাষার গৃহস্থলী সাজানো হয় ‘মেট্রাপ্যাটার্নে’।

তারপরও আমাদের দাবি আর প্রয়োজন, সংসার আর রাজনীতি-আমাদেরকে তুচ্ছ যেনতেন ভাবে তুষ্ট মানুষ করে তোলে-

‘‘ কিন্তু কবিতা এসবকে তুচ্ছ জ্ঞান করে বলে এর আদি অন্তহীন রহস্যের সামনে আমাদের চুপ করে থাকতে হয়।’’

এমনিভাবে নব কোন ধ্যানধারণা আমাদেরকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মতো বড় বড় শব্দ থেকে মুক্তি দিয়ে ‘ সম্পর্ক স্থাপনের অভিজ্ঞানে’ ‘মানব মনের পরিচিতির সীলমোহর’ লাগিয়ে দেয়। অর্থাৎ যা থেকে মুক্তি তাকে ভাঙার জন্যই পরবর্তী নোতুন কবিকে সাজতে হয় সমাজ সংস্কারক, বিদ্রোহী; লাভ করতে হয় ভাষা জগতের নবুয়্যত।

উৎপলের কবিতায় সেই ভাষায়/সুরার সম্মোহনে আমরা বঙ্গকবিতাবিদ্যার নোতুন ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে উঠি-

(i)

‘‘লৌহকণার গান শুনে যাও। শ্বেতশণিকার ক্ষিপ্ত নৃশংসতা শোনো।

বিষ- যার চোখ নেই, বৃদ্ধি আছে, খসে পড়া আছে,

নেই ত্বক, শুধু ঝুলন্ত প্রদর আছে, পুঁজ আছে

– এক নমষ্কার করো।’’

(ii)

‘‘ছিল একদিন, একদা যখন ছিল ‘সীতিকবিতা’ এই শব্দের অগোচরে আমরা

জেনেছিলাম লিরিক তুমি সরল বীণার কাঠ……।

(iii)

প্রিয়তমা, দেখছি তোমার কালো স্তন,

দেখছি এবার ধর্ম প্রচারকগণ

সেঁটে দিচ্ছে ইস্তাহার

দেখছি তোমার কালো স্তন ভরে যায় ধর্মীয়

দ্রুত লিখন অক্ষরে-’’

(iv)

‘‘কেবল পাতার শব্দে আমি কাল জেগেছি সন্ত্রাসে।’’

(v)

‘‘আমাকে দাওনি তুমি কম্পাসের খল- নির্ভরতা।’’

‘‘কবিতার দুর্বোধ্যতার সুযোগ নিচ্ছে একালের অকবিরা, কাজেই আজ ‘সততা’ কবির গুণের অবশ্য অংশ উঠছে’’- উৎপলের কবিতার কাছে এই শব্দগুঞ্জনমালা অর্থহীন- বানানো এবং একাডেমিক পাঠ্যক্রম হয়ে ওঠে। কেননা, কবিতা কি রকম হবে, কি হবে তার ভাষা, কি হবে তার ব্যাকরণ, কিভাবে প্রচল বা প্রথামুক্তি ঘটবে- এসব কিছু বিশ্লেষণ করা যায় না, এাঁ হয়ে ওঠে আলো আধারী ভাষায়, তারপর তা মিথের মেটাফোর; নিজস্ব ঘরানা। সে স্কুলের অনুসারী হয়ে ওঠে পরবর্তী প্রজন্ম। শব্দের এই ইঙ্গিত থেকে আমরা কি বলতে পারি কবিতা নিয়ে কিছু কথা, যদি পারিতো অনুভূতির ভাষায় এরকম হয় তার প্রকাশ:

‘‘ হয়তো কবিতা নিজেকে ঘিরে যে অস্তিত্ব জটিল বাস্তবতা তৈরি করে তাকে আমরা প্রতিবিম্ব, প্রতিফলন, ছায়াপাত ব’লে স্বীকার করে নিলে খানিকটা স্বস্তি পাবো।’’

আমাদের জগত প্রকৃতি ও অাদিভৌতিক অবস্থার মধ্যে যে সম্পর্ক যে স্মৃতিবিভ্রম তাও হতে পারে কবিতার ভাষা। মূলত: কবিতা নামক এই অনুভূতির ভাষায় নানাভাবে ধ্বনির অগুপ্ত আভাস মেলে ধরেন কবি।

‘‘ এর কার্যকরণ, রীতিনীতি আমি জানি না’’…

জানতে চাইনা, কেননা তা জানা যায় না- যা জানা যায় তা হলো অনুভূতির প্রতিক্রিয়া; শব্দ-উপমা অলঙ্কারের ব্যাকরণ ও বিদ্রোহ, অভিনব শৈলী ও প্রথামুক্তির আত্মাদেহ।

উৎপলের কবিতা পড়লে বুঝা যায় যে কোন শব্দকে ডেকে আনতে পারেন তিনি, বাঁধিয়ে দিতে পারেন শব্দ চৈতন্যের হট্টগোল। বুঝা যায় না সে শব্দের জীবন কাঠামো প্রকৃতি নির্ভর নাকি- বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মূল স্বরূপ উম্মোচনে সে ব্যস্ত; শুধু ধাক্কা দেয় বক্ষে এক অচিন পাখি? ফলত: এভাবেই উৎপলের নিজস্ব ডিকশন, যেখানে জীবনানন্দের অনুসরণে নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরু এবং প্রথা ও প্রভাব মুক্তির মধ্যে তৈরি হলো কবিতাবিদ্যারকোড।

‘‘ তাহলে আমি কি সৃষ্ট পৃথিবীর গান গাইছি?…’’

‘‘আবিষ্কার’’ আর ‘উদ্ভাবনা’ এই শব্দ দ্বয়ের অবচেতনায় থাকা ধ্বনিগুলোর বহি:প্রকাশ এক নয়। কেননা, কবিতা তো উদ্ভাবনা? কবিতার শব্দ-কোড-অলঙ্কার ধ্বনিগুঞ্জনের সমীরে ভাসে সারৎসার। প্রজাপতি হয়ে ওঠে সৃষ্ট পৃথিবীর গান। আর শিল্পীআত্মার ক্ষরণ থেকে নিস্তার পায় না দরদী বকুল। মারাত্মক ছুরি বিঁধে যায়; কি সেই টেনশনে ভরা মাংসের গন্ধ, বিদ্যুৎবিদ্ধ জলাদের শব্দ শব্দ খেলা-

‘‘ জানতাম ঐ ‘রোমান্টিসিজম’ শব্দের অন্তরালে দীর্ঘশ্বাস…’’

কবি হয়তো বা সময় শাসিত কিন্তু সময়কে নয় মহাকালকে সে শাসন করে ধরে রাখে যুগ-যুগান্তরের আলোপুত্র হিশেবে। ফলত: তাঁর স্থাপনা, ভাষা, কোড, ইশারা-তাঁরই অবস্থানগত জীবনানুসন্ধান; এই চিন্তা অনুসারে এর বাইরে কোন কলাকৈবল্য ইতিহাস নেই? উৎপলকুমার বসু এর ভেতরে বসে সদাভ্রাম্যমাণ ভেঙে চলেছেন কবিতার ব্যারকণ আর তৈরি করে চলেছেন অভিনোতুন পরিকাঠামো। আমার মনে হয়, উৎপলের কবিতা কেন আমাকে উদ্বিগ্ন করে- কেন করোটিতে মহাদেশ ডুকিয়ে দেয়; কেন শব্দের শরীর ও আত্মা-কাঁচা রমণীর স্বাদে তিক্ত সুন্দর দেহ অনুভূতি ছুঁড়ে দেয়-

(i)

‘‘ এ-দেহ সঙ্কেতময়, তুমি পড়ো, তুমি পাঠ করো

পাঁচটি আঙুলে ধরো অস্ত্রখণ্ড, তবু মন ভয়ে জড়ো সড়ো-

…………………………………………………………..

দেহ, যার ক্ষয় নেই, অশ্বহীন রন’’

(ii)

‘‘ অর্থাৎ মোচন করো

তুমি

নিক্ষেপ করিছিলে

ঐ ক’টি পাতা

উাল্গুনের তাপে রাজ্ঞী

খুলে ফেলো

পাতা আর স্তন-আবরণ

আর ছুঁড়ে ফেলো তীর

নার্গিসকান্তারে

দেখা হয়েছিল

নিক্ষেপ করেছিলে ঐ ক’টি পাতা

দ্রাক্ষা হতে

উতরোল সুতিবস্ত্র খসে পড়েছিল।’’

উৎপলের কবিতার একটা আলাদা চেহারা আছে, ফর্মের থেকে যাকে ‘মেট্রোপ্যাটার্ন’ বলা যেতে পারে। এবং সেটি অন্য আর পাঁচজন বাঙালি কবির মতো কেরাণীসূলভ বা আধুনিকতার আত্মা প্রতরণা নয়- বরং তা কখনো কখনো ইউরোপের গার্ডেনে ফোটা ফুল মনে হতে পারে? কিন্তু তাঁর কবিতার বিশ্লেষণলব্ধ টবে গঠিত হয় যে মুকুলিকা-তাকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য এই অভিধায় ভাগ করা যায় না? কেননা, তাঁর কবিতার ইউরোপীয় শরীর ও প্রাচ্যের আত্মা এদুটি মাখামাখিতে সবুজ ফল হয়ে ওঠে। যেমন-

(i)

‘‘মরিয়ম তোমার বাগানে, তোমাদের কার্পাস বাগানে, ঈশ্বর প্রদত্ত গাধা

চরছে একাই…’’

(ii)

‘‘সিনো, তুমি বাল্যে ছিলে কুকুর ছানা’’

(iii)

‘‘একটি প্রাচীন গ্রীক লিরিকে যা বলা হয়েছিল’’

(iv)

‘‘যিশুর বাড়ির রাজহাঁস অনাদরে বেড়ে উঠেছিল’’

(v)

‘‘অর্কিড সহজ ফুল- কিন্তু তারও জটিলতা চাই’’

তেমনি-

(i)

‘‘মায়াবী লন্ঠন ঘিরে বহু কাচ অুসীর খেলা’’

(ii)

‘‘সেই মালাদের রক্তে আমি জন্মিয়েছি’’

(iii)

‘‘হস্তচালিত প্রাণ তাঁত সেই আধো জাগ্রত’’

(iv)

‘‘ঘুম আর বোঝা পড়ার মাঝখানে ধ্বনিবহুল ধানক্ষেত’’

(v)

‘‘কাটা শেষ হলে এত বেশি অবিচ্ছিন্ন খড়’’

(vi)

‘‘স্বপ্নের দেশে স্রোত বিনা, জল বিনা অগণ্য নৌকা চলে’’

এই শব্দ ব্রহ্মাণ্ড আমাদের মগজের টবে পুঁতে দেয় ধ্বনির অহেতুক গুঞ্জনমালা, ঘটে যায় মর্মান্তিক ব্যাপার- আমাদের এতদিনের ধারণা, এত প্রচলের মাখামাখি-তার সবকিছু দেহকোষ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে, তার পাশাপাশি তিনি গড়ে দেন বিশ্ববীক্ষায় মহিমাম্বিত বর্ণের সিঁকি-আধুলি।

‘ঈশ্বর প্রদত্ত গাধা’ ‘কেবল পাতার জেগেছি সন্ত্রাসে’ ‘একদিন বড়ো মূর্খ হবো’ ‘কাম্পাসের খল-নির্ভরতা’ ‘প্রতিহিংসাপরায়ণ পর্দা’ ‘ধামি সিঁকি-আধুলির মতো’ ‘উড়ে আসে ধর্মবক; ‘প্রিয় হে, সবুজ ফল’ ‘স্বপ্নমূল্যে পুং মহিষের পুরুষত্ব নষ্ট করা চলে’ ‘ক্ষেতে জলসিঞ্চনের মতো জননী প্রতিভা’ ‘স্ত্রীলোকের রক্তক্ষরণ হচ্ছে এই মহাউৎসবের দিনে’ ‘ািনার আড়াল থেকে চিৎকার করে উঠেছে তারা’-এই সব অপ্রতিহত শব্দরহস্যময়তা, বোধ প্রকরণ, কলাকৈবল্য আখ্যান যাঁর ব্যাকরণ হয়ে ওঠে আর এই দারুন বিস্ময় যা মানবমানবীয় আর্তচিৎকারের মতো কোন কার্যকারণ (হয়তো কার্যকরণ আছে?) রীতিনীতি ছাড়া-

‘‘বাসনে-বোয়েমে, হাঁড়ি কলসীতে সংগ্রহ করে রাখে জীবনের যা-কিছু সম্পদ’’…

এই সবই উৎপলের লিপিকার হয়ে ওাা প্রথম সংক্ষরণ’…

‘‘যে খাদ্যবিন্দুকে তুমি ধ্যান করো’’…

যা কিছু উৎপলের কবিতার অনুশীলনী-তাই উৎপলের কবিতা, যাহা কলাপুরাণ-ব্যাকরণ ও বিদ্রোহ। বোধিতে এই বিদ্যার জগৎ নিয়ে কনশাসনেস ব্যবহার করেন উৎপল-আর তা পৌছায় কালেকটিভ আনকনশাসনেস-এ। কিন্তু পাঠক ও দুর্বিনীত সমালোচক এক না হতে পারলে তাঁর কবিতার এই সুধামহলের কহবতীর নাচকে অনুভব করা যায় না। ‘বন্যা’ কবিতার কম্পোজিশনের সামনে এরকম সিকোয়েন্স দাঁড় করাতে পারি আমরা; কেননা, উৎপলের মানবীয় চৈতন্যে থাকে নোতুন প্রকরণের দৈর্ঘ্য; বোধ ও অবচেতন সেই যাত্রা পথে; যাহা এইভাবে প্রাগ্রসর অনতিক্রমনীয়তা তৈরি করে।

দর্শনের চক্রতীর্থে যা দর্শন অতিক্রম করে হয়ে ওঠে সবুজ ফলরূপ দেহ- আর এই আত্মার জাগতিক কার্যক্রম প্রবাহিত আমৃত্যু শব্দগুঞ্জনমালায়।

‘যে খাদ্যবিন্দুকে তুমি ধ্যান করো’ ফলত: এই বাণী কবি উৎপল কুমারের পদ ও পদ্যকে করে তোলে অভিনোতুন প্রস্ত। সমাজ দেহের অন্তর্সংকটের ভেতর থেকে তিনি গ্রহণ করেন প্রতিক্রিয়া-যা অভিনব ও প্রাগৈতিহাসিক। আর পঞ্চইন্দ্রিয়ের রহস্যময়তার নয়, কুহকী বাস্তবতায় তিনি হয়ে ওঠেন মানবিক কায়া শাখার সেক্রেটারি। কবিতার অথবা কবি উৎপলের এই মেটাফর নিয়ে কাব্য ভাবনা আমাদের। এই ভাবনা উপনিবেশিক ভাষায় নিষ্ফলতা অথবা ‘আসে কাছিম-দেবতা পিঠে কালো মেঘ’-নিয়ে। তাই

পাবলো ভনে এই কথা লহো বক্ষে-জীর্ণ অন্তর্সংকটকে-কহো কথা উৎপলীয় ধ্বনিতে; দেখিবে তার অর্থ-

‘‘ক্ষেতে, মাঠে বৃষ্টি পড়ে আর ধ্যান করো।’’ -এই ভাবজগতের নি:শব্দ বিপ্লব যা অসৃষ্ট ও সৃষ্ট পৃথিবী আর সেখানেই নন্দনতত্ত্ব জরুরী হয়ে ওঠে । যা-

‘‘গ্রীষ্মের দগ্ধ অরণ্যে লুকিয়ে-পড়া এবং ধরা-পড়ে যাওয়া মানব মানবীর অতি চিৎকারের মতো, পাগল হাসির মতো, যে শব্দ- উপমা- অলঙ্কারের ধ্বনি বাতাসে ভেসে চলেছে’’-

(i)

‘‘তুমি ধ্যান করো এক অশান্ত বিন্দুকে যার নাম নেই

শুধু ক্ষুধা রূপ আছে।’’

(ii)

‘‘জলে ভেসে গেছে দেশ-

কার দেশ? কোথাকার জল? কোথায় চলেছে?

(iii)

‘‘দোলে সবুজ ধুতুরা গাছ।’’

(iv)

‘‘সবুজ ধুতুরা গাছ, অনাসক্ত, প্রতিটা প্রশ্নের

সঠিক উত্তর চায়-’’

(v)

‘‘উলঙ্গের অর্থনীতি, অন্ধের ভুগোল আর

বধিরের ইতিহাস

কে কাকে আশ্রয় দেবে?

উৎপল কুমারের ‘বন্যা’ কবিতাবিদ্যা পাঠে মস্তিষ্কে এই ধ্বনি আনুগত্য ও বোধের প্রশ্রয় অর্থাৎ উৎপলের কবিতার অনাবাদি শিল্পজমি দখলের উদাহরণ মুটামুটি এ ধরণের। নানা অৎানার উপস্থিতি ও জানা ঘটনাক্রমের উপনিবেশ থেকে ক্রমশ অতীন্দ্রিয় চাকায় করে- শিল্পবোধ সাম্রাজ্যের কেন্দ্রে নিয়ে যায় কবিতা।

‘‘ক্ষেতে, মাঠে বৃষ্টি পড়ে আর তুমি ধ্যান করো

এক অশান্ত বিন্দুকে যার নাম নেই-শুধু ক্ষুধা রূপ আছে।’’

‘বন্যা’র এই অনুসঙ্গ-এই কোডগুলি ক্ষুধা রূপ হয়ে, সবুজ ধুতুরা হয়ে ঝুলে থাকে আমাদের চেতনায়। উৎপলের এই বঙ্গকবিতাবিদ্যা পাঠে শিল্পের রুচি ও মান্যতা পাল্টে যায়; ভাষা ও পার্থিব ইনটিউশনের মধ্যে শুরু হয় যোগসূত্র। তারপারও এই সৃজন-রচনার মর্মার্থ আরোপ থেকে বেরিয়ে-অন্য এক অৎানা বাস্তবতার দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে দাাঁড়িয়ে যায়। তাই, এই কবির পদকাঠামো নিয়ে, তাঁর ভাবনা নিয়ে-ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ-ব্যাখ্যা দাবি রাখে।

যাহা উৎপল লেখে-তাহাই বঙ্গকবিতা বিদ্যা আর তাহাই এভাবে প্রকাশিত

‘‘ও-অস্তিত্বে বহুফাঁক, বহুপথিকের জলে পড়ে যাওয়া

জটাফুল তোমার ভক্ষণ-

ঐ বুজে আসা চোখে যে-আলোকে বিন্দুটুকু জলন্ত অঙ্গার

তা কি ক্ষুধার স্বরূপ নয়?

এই প্রশ্ন, বাস্তবতার বাতাবরণে ‘বন্যা’ নামের কবিতাবিদ্যাটি আমাদেরকে দাঁড় করিয়ে দেয় ‘‘প্লাবন সীমার মুখোমুখি।’’

ফলত: সৃষ্টি সূত্র দর্শন, নৃবিজ্ঞান আর বাস্তবতা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অব্যাখ্যাত শিল্প-বোধ-ম্যাজিককে নিয়ে ‘কাছিম দেবতা’ এসে হাজির হয়।

উৎপল কুমার ভেঙে দেয় সেই প্রশ্ন যাহা-‘‘প্রশ্নের রহস্য বোঝে না।’’

‘বন্যা’ নিয়ে, বিপর্যয় নিয়ে রচিত হয় অপ্রতিহত শূণ্যতা- ‘‘সমূহ ক্ষতির আগে আমরা এলাম জলে ভেসে গেছে দেশ’’- এই বোধ আর এমন ডানা নাড়া কবিতাকল্পনালতা সৃষ্ট হতে পাওে আর তা পদরচনায় উপস্থাপিত-বালাকবিতাবিদ্যা সে ব্যাকরণ ও প্রথাযুক্তির খবর আগে জানতো না? কবিতাকে কিভাবে তিনি ইন্দ্রিয় মেটাফরে রূপান্তরিত করেন। বলেন-

‘‘উলঙ্গের অর্থনীতি, অন্ধের ভুগোল আর বধিরের ইতিহাস কে কাকে আশ্রয় দেবে।’’

এই সবই উৎপল কুমার বসুর কবিতাবিদ্যা; যা অবকাঠামোগত বক্রোতিতে স্পেস বা ধ্যান ধারণার পটভূমিতে ব্যাখ্যা দান করে। ফলত: তাঁর কবিতা হয়ে ওঠে কিছু না বলা উদ্ভাসের উদাহরণ, আত্মপ্রকাশের খাতায় রঙের মানুষ পরিক্রমা।

বি:দ্র:– এই গদ্যে শঙ্খঘোষ, আব্দুল মান্নান সৈয়দ, জহরসেন মজুমদার, ফরিদ কবির- এঁদের ১টি করে লাইন উদ্ধৃতি করা হয়েছে অন্য সকল গদ্য ও পদের উদ্ধৃতি উৎপল কুমার বসু থেকে।

793 ভিউ

Posted ৩:০০ অপরাহ্ণ | শুক্রবার, ১০ আগস্ট ২০১৮

coxbangla.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

এ বিভাগের আরও খবর

Editor & Publisher

Chanchal Dash Gupta

Member : coxsbazar press club & coxsbazar journalist union (cbuj)
cell: 01558-310550 or 01736-202922
mail: chanchalcox@gmail.com
Office : coxsbazar press club building(1st floor),shaheed sharanee road,cox’sbazar municipalty
coxsbazar-4700
Bangladesh
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
বাংলাদেশের সকল পত্রিকা সাইট
Bangla Newspaper

ABOUT US :

coxbangla.com is a dedicated 24x7 news website which is published 2010 in coxbazar city. coxbangla is the news plus right and true information. Be informed be truthful are the only right way. Because you have the right. So coxbangla always offiers the latest news coxbazar, national and international news on current offers, politics, economic, entertainment, sports, health, science, defence & technology, space, history, lifestyle, tourism, food etc in Bengali.

design and development by : webnewsdesign.com