রবিবার ২৮শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শিরোনাম

রবিবার ২৮শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

শিরোনাম

মাইকেল মধুসূদন দত্ত আমাদের গর্ব, ঐতিহ্য

রবিবার, ২৬ জানুয়ারি ২০২০
1361 ভিউ
মাইকেল মধুসূদন দত্ত আমাদের গর্ব, ঐতিহ্য

কক্সবাংলা ডটকম(২৫ জানুয়ারী) :: মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবন ও কাব্যজগৎ নিয়ে অসামান্য রচনা ‘আশার ছলনে ভুলি’র লেখক গোলাম মুরশিদ। শ্রমসাধ্য মেধাবী এই সৃষ্টি মহাকবিকে পূর্ণাঙ্গ অবয়বে উপস্থাপন করে। মধুকবির জন্মদিন সামনে রেখে কালের খেয়ার এ আয়োজন উপলক্ষে কথা হয় প্রখ্যাত এই প্রাবন্ধিক-গবেষক ও মাইকেল জীবনীকারের সঙ্গে। আলাপচারিতায় উঠে এসেছে মাইকেল মধুসূদনের জীবন ও সাহিত্যের জানা-অজানা নানা অধ্যায়।

কেমন আছেন?
শরীর খুব একটা ভালো না।
যতদূর জানি, আপনি বেশ স্বাস্থ্যসচেতন একজন মানুষ।

হ্যাঁ, আমি স্বাস্থ্য সম্পর্কে খুবই সচেতন ছিলাম। কিন্তু গত এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে আমার একটা স্ট্রোক হয়। এটিই আমার জন্য কাল হয়েছে। এর পর আমি আর নিজেকে সুস্থ বলতে পারি না। বেশি ক্ষতি করতে না পারলেও ক্ষতি হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, দুর্বল হয়ে পড়েছি। কিছু আঙুল এখনও অবশ। বোতাম লাগানো বেশ কঠিন হয়। আর লেখা আমি সব সময় কম্পিউটারে লিখি। তাই লিখতে পারছি, তবে ডান হাতটা দিয়ে অত সচলভাবে লিখতে পারছি না।

আপনি দীর্ঘদিন ধরে মধুসূদন দত্তকে নিয়ে কাজ করেছেন। তার জীবন নিয়ে আপনার কাজ সম্পর্কে বলবেন?

‘আশার ছলনে ভুলি’ গ্রন্থটি আসলে মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনকে রিকনস্ট্রাক্ট করে লেখা। তার কারণ এর আগ পর্যন্ত যারা মাইকেলকে নিয়ে লিখেছেন, তারা খুবই ভুল তথ্য দিয়ে লিখেছেন। আমি প্রথম ৪৬টা ডকুমেন্ট পেলাম, যে সমস্ত জিনিস এর আগে কেউ দেখেনি।

মাইকেলের জীবনী এ যাবত যা লেখা হয়েছে সবই কিংবদন্তিমূলক। শোনা কথা। তার কোনো ভাই-বোন ছিল না। তার স্ত্রীরা কেউ জীবিত ছিল না। সবই বন্ধুদের কাছে শোনা। এই হচ্ছে যোগেন্দ্রনাথ বসুর লেখা জীবনী। অবশ্য যোগেন্দ্রনাথ বসুর লেখা জীবনী না থাকলে আমরা লিখতেও পারতাম না। তার কারণ ওর মধ্যে মৌলিক ধারণাগুলো দেওয়া ছিল। অনেক চিঠির সংগ্রহ ছিল তাতে। তারপর নগেন্দ্রনাথ সোম যখন লিখলেন, তাতে তিনি আরও কিছু নতুন তথ্য জোগাড় করেছেন; সাথে আরও কিছু কিংবদন্তিও জোগাড় করেছেন। সেগুলো দিয়েই সবাই লিখেছেন। পরবর্তীকালে সুরেশচন্দ্র মৈত্র লিখলেন। উনি মাদ্রাজে গিয়েছিলেন। সেখানে পত্রিকা দেখে কিছু তথ্য জোগাড় করেছিলেন। তারপর আমি এই তথ্যগুলো পেলাম।

এগুলো কোথায় পেলেন?

এগুলো পেলাম অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিতে। ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে। ব্রিটেনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে। যেমন মাইকেলের সন্তানাদির জন্ম সম্পর্কে কেউ কিছু বলতে পারেনি। আমি সন্তানদের নাম, জন্মতারিখ সবই পেয়েছি। মাইকেলের স্ত্রী হেনরিয়েটা সম্পর্কে ধারণা ছিল যে, সে ফরাসি। আসলে সে ছিল ইংরেজ। তার বাবার নাম জর্জ হোয়াইট, একজন খাঁটি ইংরেজ। জর্জ হোয়াইট মাইকেলের সহকর্মী ছিলেন মাদ্রাজের স্কুলে। দু’জন এক সাথে শিক্ষকতা করতেন। জর্জ হোয়াইট ছিলেন ফার্স্ট টিউটর, মধুসূদন ছিলেন সেকেন্ড টিউটর। মাইকেল ও হেনরিয়েটার কী করে প্রেম হলো, সেসব পর্যন্ত আমি লিখেছি।

মাইকেল মধুসূদনের প্রতি আপনার এ গভীর আগ্রহের কারণ কী ছিল?

আসলে মাইকেলকে আমি পড়েছি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন পাঠ্য কবি হিসেবে। সেদিক থেকে মাইকেলের প্রতি আমার বিশেষ কোনো আগ্রহ ছিল না। ১৯৮৬ সালে রবীন্দ্রনাথের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এক আয়োজনে লন্ডনে গেলেন শিবনারায়ণ রায়। তিনি আমার বাড়িতে উঠেছিলেন। ওখান থেকে তিনি অক্সফোর্ডে বেড়াতে যান। তিনি ছিলেন তার বন্ধু তপন রায় চৌধুরীর ওখানে। সেখান থেকে ফিরে এলেন দু’দিন পরে। ফিরে এসে একদিন খাবার টেবিলে বললেন, অক্সফোর্ডে মাইকেল সম্পর্কে উইলিয়াম র‌্যাডিচে নামে একজন কাজ করছেন- তার কাজটা দেখে এলাম। র‌্যাডিচে লিখেছেন মাইকেলের সাহিত্য সম্পর্কে। শিবনারায়ণ রায় তখন বললেন, মাইকেলের সাহিত্য সম্পর্কে আর কী নতুন আলোচনা হবে! বরং যদি জীবনী লিখতেন তবে একটা নতুন কাজ হতে পারত। কারণ আমার ধারণা, লন্ডনে মাইকেলের জীবনী সংক্রান্ত কিছু উপাদান থাকলেও থাকতে পারে। আমি তখন ভাবলাম, সত্যি তো! তাহলে তো একবার দেখা যেতে পারে এক্সপ্লোর করে।

উনি যেদিন ভারতে চলে এলেন, তার পরদিন সকালেই আমি গেলাম ‘ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি’তে। সেখানে প্রথম দিনই পেয়ে গেলাম মাইকেলের বিয়ের তারিখটি। তার তিনটি সন্তানের জন্ম তারিখও পেলাম। এগুলো তখনও কোনো জীবনীতে ছিল বলে আমার ধারণা নেই। ছিল না। এগুলো পেয়ে আমি বেশ উৎসাহ বোধ করলাম। ভাবলাম, প্রথম দিনেই যদি নতুন তথ্য পাওয়া যায়, তাহলে আরও নতুন তথ্য পাওয়া যাবে। এই নিয়ে আমি কাজ শুরু করলাম এবং তারপর আট বছর কাজ করেছি।

সে উৎসাহেই কি মাইকেলকে নিয়ে কাজ করলেন, নাকি অন্য কোনো বিষয় আপনাকে এ কাজে উদ্বুদ্ধ করেছিল?

একটা কাজ করার তাগিদেই কাজটা শুরু করেছিলাম। আর তখন আমার অঢেল সময় ছিল। আমি তখন বিবিসিতে কাজ করি। তখন বিবিসির দুটো ট্রান্সমিশনের মাঝখানে সাড়ে তিন ঘণ্টা সময় পেতাম। এই সময়টায় আমি ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে চলে যেতাম। বিবিসিতে বিভাগের যিনি প্রধান তাকে বললাম, আমাকে শনি-রোববারে কাজ দিলে ভালো হয়। তাহলে এই দুটো দিনের বদলে সপ্তাহে যে দুটো দিন ফাঁকা থাকবে সে দু’দিন আমার গবেষণার কাজটা করতে পারি। ‘প্রবাহ’ নামে যে অনুষ্ঠানটা হতো, তার পরে যেতাম; আর সন্ধ্যার অনুষ্ঠানটার আগে ফিরে আসতাম। অন্য দু’দিন সারাদিন কাজ করতাম। প্রতিদিনই বলতে গেলে আমি নতুন তথ্য নিয়ে ফিরতাম। প্রতিদিনই মনে হতো যেন আমি ডুব দিয়ে কোনো না কোনো ঝিনুক পেতাম। যে ঝিনুকের মধ্যে মুক্তা আছে। আসলে ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি যে কী জিনিস; সেটা কেউ না দেখলে বুঝবে না। আমার ‘বাংলা গদ্যের ইতিহাস’ লিখতে গিয়েও আমি এই লাইব্রেরিটা ব্যবহার করেছি। নজরুলের জীবনী লিখতে গিয়েও ওই লাইব্রেরিটা ব্যবহার করেছি। এটা একেবারে সোনার খনি। যেমন ধরা যাক, লর্ড কর্নওয়ালিশের সই ওখানে আমি দেখেছি। ইংরেজরা ভারত থেকে চলে যাবার পর সব পুরোনো ডকুমেন্ট ওখানে নিয়েই রেখেছে।

মাইকেলকে নিয়ে আপনার কাজের সম্পর্কে আরও কিছু জানতে চাই।

তারপর আমি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির রোডস্‌ লাইব্রেরিতে কাজ করতে গিয়ে বিশপস্‌ কলেজ সম্পর্কে নানান তথ্য পেলাম। মাইকেলের জীবনীতে এর আগে বিশপস্‌ কলেজ সম্পর্কে যা কিছু লেখা হয়েছে, তা এক প্যারাগ্রাফের বেশি হবে না। তার কারণ কেউ জানত না তেমন কিছু। খালি জানত, মাইকেল সেখানে এত সালে ভর্তি হন। কতদিন পড়লেন, কী পড়লেন কিচ্ছু জানা ছিল না। আমি তার পরীক্ষার খাতা পর্যন্ত পেয়েছি। ১৮৪৬ সালে উনি পরীক্ষা দিয়েছিলেন; রোডস্‌ লাইব্রেরিতে আমি সেই খাতা পেলাম। তারপর মাইকেল আর হেনরিয়েটার যে পরিচয়- হেনরিয়েটা কার মেয়ে, এই পরিচয়টা আমি উদ্ঘাটন করি ফ্রান্সে গিয়ে।

রু দ্য সাঁতিয়েরের সেই বাসায় গিয়ে?

হ্যাঁ, ভার্সাইয়ের রু দ্য সাঁতিয়েরের সেই বাসায় আমি গিয়েছি। বাসাটা দেখার মধ্যে কোনো কৃতিত্ব নেই। তবে আমি সেখানকার মিউনিসিপাল অফিসে গিয়ে- মাইকেল আর হেনরিয়েটার দুটো সন্তান হয়েছে ফ্রান্সে; সেই দুই সন্তানের বার্থ সার্টিফিকেট নিয়ে আসি। আমার সাথে ছিলেন কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক। ফ্রান্সে সেই মিউনিসিপাল অফিসে গিয়ে ভাঙা ভাঙা ফ্রেঞ্চে আমি বললাম, এখানে অমুক বাসায় একজন বাঙালি কবি থাকতেন। তার দু’জন সন্তান হয়েছিল এখানে, এত তারিখ আর এত তারিখে। আমি কি তাদের বার্থ সার্টিফিকেটগুলো পেতে পারি? ভদ্রলোক ভেতরে চলে গেলেন এবং ১০ মিনিটের মধ্যে একটা বাঁধানো খাতা নিয়ে এলেন। ১৮৬৩ আর ১৮৬৭ সালের দুটো বার্থ সার্টিফিকেট। বললাম, আমি কি এর ফটোকপি পেতে পারি? আমি কপি পেয়ে গেলাম। আমিই প্রথম আবিস্কার করলাম, হেনরিয়েটার নাম হচ্ছে এমিলিয়া হেনরিয়েটা সফাইয়া হোয়াইট। বাবার নাম জর্জ জাইলস্‌ হোয়াইট।

এই সফাইয়া কি সোফিয়ারই অন্য উচ্চারণ?

হ্যাঁ, সেইটারই উচ্চারণ সফাইয়া। যাই হোক, আমি যখন এটা পেলাম, তখনই জর্জ জাইলস্‌ হোয়াইটের নামটা চিনতে পারলাম। এ নাম তো আমি আগে থেকেই জানি। তারপর আমরা লন্ডনে চলে এলাম। পরদিন সকাল বেলা হাসান আজিজুল হক থাকলেন বাড়িতে, আমি চলে গেলাম ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে। লাইব্রেরির রেজিস্টারে গিয়ে দেখলাম, এই নামটা আছে। সেই তারিখ অনুসারে মূল দলিলটা দেখলাম। সে দলিলে তার পুরো নাম দেওয়া আছে, বাবার নাম দেওয়া আছে। বাবা কী করেন তাও দেওয়া আছে। ‘মধুর খোঁজে’ নামে আমার একটা বই আছে। সে বইয়ে এ ঘটনা এবং দলিলের উল্লেখ আছে।

তারপর-

তারপর আমি দেখলাম যে, অঙ্কটা মিলে গেল। দুইয়ে দুইয়ে চার হয়ে গেল। জর্জ জাইলস্‌ হোয়াইটের মেয়ের কেন প্রেম হলো মধুসূদনের সাথে! মধুসূদন বিবাহিত পুরুষ। তার বউয়ের নাম রেবেকা। তবু তার সঙ্গে প্রেম হলো কেন? দেখলাম যে, জাইলস্‌ হোয়াইটের স্ত্রী মারা যান ১৮৫৩ সালে। পরের বছর তিনি আবার বিয়ে করেন। বিয়ে করেন যে মেয়েটিকে তার বয়স হচ্ছে হেনরিয়েটার চেয়ে কম। সে ক্ষেত্রে তাদের সম্পর্ক কেমন হতে পারে সেটা আমি কল্পনা করে নিলাম। বুঝলাম যে সংসারে নিশ্চয়ই কান্নাকাটি হতো; নিশ্চয়ই মধুসূদন সহানুভূতি দেখাতেন। সেই সহানুভূতি থেকেই প্রেম।

মাদ্রাজে এক স্ত্রীকে রেখে তখন মাইকেল আবার বিয়ে করে ফেললেন?

মাইকেল ১৮৫৬ সালে মাদ্রাজ ছেড়ে কলকাতা চলে এলেন। আসার সময় হেনরিয়েটাকে তিনি নিয়ে আসেননি। কিন্তু সেখান থেকে চলে আসার পর ঘটনাটা ফাঁস হয়ে যায়। তবে পরবর্তী জীবনেও মাইকেল আর হেনরিয়েটার বিয়ে হয়নি। তারা একে অপরের সঙ্গী হিসেবেই জীবন যাপন করেছেন।

আর রেবেকা ও তার চার সন্তান?

স্ত্রী রেবেকা ও চার সন্তানকে মাদ্রাজেই ফেলে এসেছিলেন তিনি। সে কারণে তিনি আর মাদ্রাজে ফিরে যেতে পারলেন না। এই ঘটনা আর কেউ না, আমিই আবিস্কার করেছি। এ নিয়ে প্রথমে ‘দেশ’ পত্রিকায় লিখলাম। ধারাবাহিকভাবে মাইকেলের জীবনীটা বেরুলো। তারপর ১৯৯৪ সালের জানুয়ারিতে বই আকারে বেরিয়ে গেল।

সেটাই ‘আশার ছলনে ভুলি’?

সেটাই আশার ছলনে ভুলি।

মাইকেল মধুসূদনকে বাংলা সাহিত্যের প্রথম বিদ্রোহী কবি বলা হয়ে থাকে। এর কারণটি আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করেন?

এটা বলার অনেক কারণ আছে। মাইকেল প্রথম ‘রত্নাবলি’ নামে যে নাটকটা অনুবাদ করলেন; সেটি অনুবাদ করতে গিয়ে মাইকেল দেখলেন, এটা তো আসলে কিছু হয়নি। তাই পরবর্তী সময়ে তিনি নিজেই লিখলেন নাটক ‘শর্মিষ্ঠা’। ‘শর্মিষ্ঠা’র ভূমিকায় লিখলেন- ‘নিরখিয়া প্রাণে নাহি সয়’। মানে নাটকের এমন দুর্দশা আমাদের দেশে, তা দেখে মাইকেলের প্রাণে সহ্য হচ্ছে না। আমাদের দেশে তখনকার নাটক ছিল পুরোনো ধরনের নাটক। মাইকেলই প্রথম আধুনিক নাটক লিখলেন। তা ছাড়া এতদিন আমরা জানতাম যে, মাইকেল হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি নিয়ে লিখেছেন, দেব-দেবীদের কাহিনি নিয়ে লিখেছেন। কিন্তু তিনি যে এগুলো দিয়ে নিজের জীবনের কথাই বলছেন- এটা জানা ছিল না। এটা জানা ছিল না; তার কারণ মাইকেলের জীবনটা জানা ছিল না। তার জীবনটা যখন আমি উদ্ঘাটন করলাম; তখন দেখা গেল, এগুলো আসলে তার নিজের কথা। যেমন ‘শর্মিষ্ঠা’। ‘শর্মিষ্ঠা’র কথা আছে মহাভারতে। শর্মিষ্ঠা হচ্ছে গুরু বৃহস্পতির কন্যা। দেবযানী হচ্ছে আরেক দেবতার কন্যা। দেবযানীকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে শর্মিষ্ঠার বাবা শর্মিষ্ঠাকে বললেন দেবযানীর দাসী হয়ে থাকতে। দেবযানীর সঙ্গে বিয়ে হলো যযাতির। এখন এই বিয়ের পরে যযাতির সন্তান হলো দেবযানীর গর্ভে। এদিকে যযাতিকে পছন্দ করল শর্মিষ্ঠা। শর্মিষ্ঠা একদিন এক কূপের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। যযাতি তাকে তুলেছে। এ কারণে শর্মিষ্ঠা যযাতিকে বলল, তুমি আমার পাণি গ্রহণ করেছ। গোপনে তাদের সম্পর্ক হলো। সেই ঘরে দুটি সন্তান হলো। দেবযানীর হাত ধরে চলেছেন যযাতি; একদিন এই দৃশ্য চোখে পড়ল শর্মিষ্ঠার সন্তানদের। তারা এসে দেবযানীকে বলল, আমার বাবার হাত ধরে তুমি যাচ্ছ কেন! গোপন কথাটা ফাঁস হয়ে গেল। একদম একই ঘটনা ঘটেছিল মাইকেলের নিজের জীবনে। রেবেকার সন্তানেরা ফাঁস করেছিল কি-না জানা যায় না, কিন্তু রেবেকার চারটি সন্তান ছিল। পুরাণের সেই কাহিনির মধ্য দিয়ে নিজের জীবনের প্রেক্ষাপট তিনি বলে গেছেন। সুতরাং মাইকেল যে বিদ্রোহী, তার কারণ মাইকেল পৌরাণিক ঘটনাগুলোকে শুধু যে নতুনভাবে দেখেছেন; পুরাণের দেবতাদের মানুষ হিসেবে চিত্রিত করেছেন, তাই না- তিনি আরও একটা কারণে বিদ্রোহী। সেটা হচ্ছে তিনি ফর্মগুলো নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। কাব্য ও নাটকের ফর্ম নিয়ে কাজ করেছেন। ভারতীয় ও গ্রিক পুরাণকে একত্রিত করে কাজ করলেন। ভাষাকে উনি আধুনিকতা দিলেন। ভাষা ও আঙ্গিকের পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং কাহিনির নতুন ইন্টারপ্রিটেশন তিনি করলেন। যেমন ধরা যাক সনেট- বাংলায় এর আগে কেউ সনেট লেখেননি। উনিই প্রথম লিখলেন এবং তার সনেট এখন পর্যন্ত বাংলার সবচেয়ে ভালো সনেট। এ কারণেই তাকে বিদ্রোহী বলা হয়। উনি সাহিত্যের বিদ্রোহ করেছিলেন। নজরুল ইসলামকে বিদ্রোহী বলা হয়। সাহিত্যের বিদ্রোহ উনি করেননি। উনি বিদ্রোহ করেছিলেন ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা, সামাজিক-রাজনৈতিক ঘটনাবলির বিরুদ্ধে। সেদিক থেকে নজরুল ইসলাম বিদ্রোহী অন্য অর্থে। বাংলায় সাহিত্যের বিদ্রোহী একজনই- মাইকেল মধুসূদন দত্ত।

বাংলা সাহিত্যের এমন বিদ্রোহী প্রবণতার কবি হয়েও তার প্রথম কাব্যগ্রন্থটি তিনি কেন ইংরেজিতে লিখলেন?

তার কারণ তিনি তখন পর্যন্ত বাংলা কিছুই লেখেননি। তিনি ভান করতেন যে, তিনি বাংলা ভুলে গেছেন। প্রথম সেই ইংরেজিতে লেখা ‘ক্যাপটিভ লেডি’; সেটাও তার নিজের কাহিনি। তখন থেকেই উনি নিজের কাহিনি সব সময় লিখেছেন। মাইকেল ‘রিজিয়া দ্য এম্প্রেস অব ইন্ডি’ এই নামে একটা নাটকও লেখার চেষ্টা করেছিলেন। অসমাপ্ত থেকে গেছে। আসল কথাটা হচ্ছে, উনি সাহিত্য হিসেবে যা যা লিখেছেন, সবই নতুন। যেমন পত্রকাব্য নতুন। পদাবলি লিখলেন নতুন ধরনের। নাটক লিখলেন নতুন ধরনের। উনি বীরাঙ্গনা লিখলেন নতুন ধরনের। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে ভাষা। ভাষাটা উনি নির্মাণ করলেন। এই যে জিনিসগুলো তিনি করলেন- এ সবকিছুর জন্যই তিনি বিদ্রোহী। এবং সত্যিকার অর্থে সাহিত্যের বিদ্রোহী তিনিই; নজরুল ইসলাম নন। নজরুল ইসলামের ক’টা কবিতা আছে বিদ্রোহের! সেগুলো ইংরেজদের বিরুদ্ধে, সামাজিক গোঁড়ামির বিরুদ্ধে।

এই আধুনিক নাটকের তুলনা ও তাগিদ তিনি কোত্থেকে পেয়েছিলেন?

তিনি ইংরেজি সাহিত্যের মস্ত বড় পণ্ডিত ছিলেন। কিছুই বাদ দেননি। কাজেই উনি ইংরেজি নাটকের ধরনে এ নাটকটি লিখলেন। নাটকটির ভূমিকাতেও তিনি এ কথাটি বলেছেন, ‘কুনাট্য দেখে মজে লোক রাঢ়ে বঙ্গে/ নিরখিয়া প্রাণে নাহি সয়’। তারপর মাইকেল নাটক লিখলেন- কৃষ্ণকুমারী, পদ্মাবতী এবং সবশেষে মায়াকানন। এ ছাড়াও তিনি দুটো প্রহসন লিখলেন। এই যে প্রহসন, নাটক; যা কিছুই লিখলেন- সবই নতুন।

নতুন কিছু লেখার জন্যই কি তিনি এসব কাজে হাত দিয়েছিলেন?

আসলে এসব কাজে হাত দেওয়ার মূল কারণ ছিল পাইকপাড়ার জমিদার দুই ভাই ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ ও প্রতাপচন্দ্র সিংহ। এরা মাইকেলকে উৎসাহ দিয়েছিলেন যে, নাটক লিখলে টাকা দেবেন। এরা নাটক মঞ্চস্থ করছিলেন, সেই নাটক ইংরেজ সাহেবরা দেখবেন। সেই জন্য বাংলা নাটক ইংরেজিতে অনুবাদ করতে গিয়েই তার মনে হয়েছে যে, বাংলা নাটক লেখা উচিত। সে জন্যই তিনি বাংলা নাটক লিখলেন এবং তার জন্য পুরস্কারও পেয়েছেন জমিদারদের কাছ থেকে। এই নতুন লেখাটা বিদ্রোহের কাজ। রামায়ণ, মহাভারত- এগুলো পুরাণ কাহিনি। রামায়ণের কাহিনিতে রামকে দেখা যায় দেবতা হিসেবে। রাবণ হচ্ছে রাক্ষস। কিন্তু মধুসূদন যে নতুন রামায়ণ লিখলেন, সেই রামায়ণে রাবণ হচ্ছে নায়ক। যদিও তিনি নায়ক করতে চেয়েছিলেন মেঘনাদকে। কিন্তু আসলে রাবণের প্রতিই তার সহানুভূতি বেশি ছিল। আর রামকে সেখানে উপস্থাপন করলেন দুর্বল চরিত্র হিসেবে। এটা একটা বিদ্রোহের ব্যাপার।

মাইকেলের রামায়ণের পৌরাণিক আখ্যানের এমন বিপরীত ভাষ্য রচনার সাহস বা চিন্তার পটভূমি কী?

তার সে সাহস ছিল। আর সাহসের চেয়েও বড় কথা, তিনি মানুষ হিসেবে দেখেছেন তাদের। সত্যি বলতেও তাই।

তারপর তিনি রাধা-কৃষ্ণের কাহিনি লিখলেন, যার নাম ‘ব্রজাঙ্গনা কাব্য’। ১৮টি কবিতা। সেখানে উনি রাধাকে বলছেন মিসেস রাধা। সেখানেও তিনি তাদের দেবতা হিসেবে দেখেননি। তার মানে তিনি রাধা-কৃষ্ণের প্রেমকে দেখলেন দু’জন মানব-মানবীর প্রেম হিসেবে। নতুনভাবে দেখলেন। এটা বিদ্রোহের ব্যাপার। বীরাঙ্গনা- তার মধ্যে উনি নিজের কাহিনি লিখলেন। নিজের কাহিনি কেন? দুষ্ফ্মন্তের প্রতি শকুন্তলা, দশরথের প্রতি কৈকেয়ি এইসব যে লিখলেন- তার প্রত্যেকটার ভেতরে আসলে নিজের কাহিনি। রেবেকা কী বলতে পারত এদের বা তাকে কী বলত রেবেকা; কারণ রেবেকাকে বিনা অপরাধে তিনি ফেলে এসেছেন মাদ্রাজে, চারটা বাচ্চাসহ।

সেই অন্তর্দাহ থেকে তিনি এভাবে লিখেছেন?

ঠিক তাই। তার ভেতরে সারাজীবনই একটা অন্তর্দহন ছিল রেবেকা ও সেই সন্তানদের জন্য।

সরাসরি এই অন্তর্দাহ কোথাও লিখেছিলেন তিনি?

হ্যাঁ! এই তো ‘আশার ছলনে ভুলি কী ফল লভিনু হায়’।

‘আশার ছলনে ভুলি’- এই পঙ্‌ক্তি অংশকেই কেন আপনি আপনার মাইকেল জীবনীগ্রন্থের নাম হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন?

সমস্ত মাইকেলকে আমি সামারাইজ করেছি এই তিনটা শব্দ দিয়েই- ‘আশার ছলনে ভুলি’। মাইকেলের জীবনটা ছিল অত্যন্ত দুঃখের। জীবনে যা কিছু আশা করেছিলেন, কোনোটাই ফলবতী হয়নি।

মাইকেল কি একজন নিয়তিতাড়িত কবি?

ভাগ্যের দোষে- এটা বলা হয়। উনি ভাগ্যান্বেষণেই মাদ্রাজে গেছেন। ভাগ্যান্বেষণেই বিলেতে গেছেন। ভাগ্যান্বেষণেই ভার্সাই গেছেন। সবখানেই তিনি ভাগ্যের খোঁজে পাড়ি জমিয়েছিলেন। তবে যখনই যেখানে গেছেন, ভালো একটা বাড়িতে উঠতেন। টাকা না থাকলে ভাঙা বাড়িতে উঠতেন। খুবই খরুচে ছিলেন। দেনায় দেনায় জর্জরিত হয়ে শেষদিকে না খেয়েও থেকেছেন। এগুলোই হয়তো তার নিয়তি।

শুনেছি, তিনি বই বিক্রি করে মাদ্রাজ গিয়েছিলেন-

সেটা আমি জানি না। পাইনি কোথাও। তবে রওনা দেওয়ার তারিখটা আমি বের করেছিলাম। ডিসেম্বরের ১৯ তারিখ তিনি রওনা করেছিলেন একটা কোস্টাল শিপে করে। চার দিন লাগত তখন মাদ্রাজ যেতে। কিন্তু উনি তখন গেছেন ১৮ কি ১৯ দিনে। তার কারণ কোস্টাল শিপে কম ভাড়ায় তিনি গিয়েছিলেন। পরিচয় লিখেছেন এম. এম. ডাট। সেখান থেকেই না ধরলাম। আমি যে এসব আবিস্কার করেছি- সেটা শিপিং লিস্ট থেকে বের করে।

শিপিং লিস্ট কেন খুঁজতে গিয়েছিলেন?

ডাইরেক্টরির মধ্যে দেখলাম, নৌযাত্রীদের নাম বের হয়। লন্ডন মিউজিয়ামে তখনকার সেই ডাইরেক্টরিগুলো আছে। আমি সেখানে তারিখ ধরে ধরে খুঁজে পেয়ে গেলাম। এবং সেখান থেকেই বের করতে পারলাম মাইকেল লন্ডনে এসে কোন বাড়িতে উঠলেন। ভার্সাই থেকে ফিরে যে বাড়িতে উঠেছিলেন লন্ডনে, এখন সে বাড়ির জায়গাটাতে বিবিসির প্রধান দপ্তর।

আপনি তো তার চিঠিপত্র নিয়ে কাজ করেছেন। সেগুলো নিয়ে একটি বইও আছে। সেখানে তাকে কেমন পেয়েছেন?

মাইকেল তো কোনো আত্মজীবনী লিখেননি। তাকে আমরা মূলত জানতে পারি তার চিঠিতে। একমাত্র চিঠিতেই মাইকেলের মনটা পাওয়া যায়। সেই জন্যই আমি বইটার নাম রেখেছি ‘দ্য হার্ট অব অ্যা রেবেল পয়েট’। এ ছাড়া কোথাও তিনি সরাসরি নিজের কথা বলেননি। আরেকটা; আমি মাইকেলের চিঠিপত্র সম্পাদনা করেছি মূল চিঠি দেখে; আন্দাজে কপি করে নয়। চিঠিপত্রে মাইকেলের ব্যক্তিত্বকে চেনা যায়। তিনি বেশ হাস্যরসিক ছিলেন। চিঠিগুলোতে তার তীব্র অভাবের কথাও জানা যায়। একজন মানুষ হিসেবে তার সফলতা এবং বিফলতার কথাও এই চিঠিপত্র ছাড়া অন্য কোথাও পাওয়া যাবে না। মাইকেল সম্পর্কে আমার আরও দুটো বড় লেখা রয়েছে। একটা লেখাকে ‘দেশ’ পত্রিকা কভার স্টোরি করেছিল। আরেকটা বেরিয়েছিল ‘অনুষ্টুপ’-এ।

মাইকেলের মহাকাব্য রচনার পটভূমি ও সফলতা সম্পর্কে আপনার অভিব্যক্তি জানতে চাই।

বাংলা সাহিত্যে মাইকেলই প্রথম মহাকাব্য লেখলেন। তার পরে আর কেউ এখন পর্যন্ত বাংলায় মহাকাব্য লিখতে পারেননি। মাইকেল তার সব রচনার আগেই জানান দিতেন যে, উনি এ রকম কিছু লিখছেন। কিন্তু ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ সম্পর্কে উনি কাউকে জানাননি যে উনি এটা লিখছেন। যখন দ্বিতীয় সর্গ লিখেছেন, তখন প্রথম জানালেন বন্ধু রাজনারায়ণ বসুকে। মহাকাব্য লেখার এখানকার বৈশিষ্ট্য ছিল যে, অন্তত দশটা সর্গে বিভক্ত একটা বৃহৎ কাব্যকে বলা হবে মহাকাব্য। মাইকেলও দশটি সর্গ লিখবেন বলে ঠিক করেছিলেন। কিন্তু নবম সর্গে ‘মেঘনাদবধ কাব্য’র কাহিনী শেষ হয়ে গেল। এটা আবার ইংরেজিতে মহাকাব্য লেখার যে আঙ্গিক আছে, সে আঙ্গিকের সঙ্গে মেলে।

এখন বিষয়টা হলো, মাইকেল ছিলেন অনেক লেখাপড়া জানা পণ্ডিত কবি। বিশ্বসাহিত্য পাঠে তার ছিল গভীর বিচরণ। উনি ইংরেজিতে মহাকাব্য পড়েছেন। বিশেষ করে মিলটনের। মিলটনও শয়তানকে করেছিলেন নায়ক। মাইকেল দান্তের ইনফার্নো থেকে শুরু করে হোমার, ভার্জিল- অনেকের মহাকাব্যই পড়েছেন। মহাকাব্য লেখার ব্যাপারে তার আগ্রহও ছিল। কিন্তু লিখতে পারবেন কি-না সেটা উনি জানতেন না। মাদ্রাজে থাকতে মাইকেল অনেক ভাষা শেখেন। তার দৈনিক রুটিনের কথা তিনি লিখেছেন যে, এতটা থেকে এতটা তেলেগু পড়ছি। এতটা থেকে এতটা সংস্কৃত পড়ছি। এতটা থেকে এতটা হিব্রু পড়ছি। এক জায়গায় উনি ‘আমি কি মাতৃভাষার সেবা করার জন্য যথেষ্ট তৈরি হচ্ছি না?’ এই বলে প্রশ্নও করেছেন। তার এই পাণ্ডিত্যকেই তিনি কাজে লাগালেন ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ লিখতে গিয়ে। মেঘনাদকে উনি নায়ক করলেন। এবং মেঘনাদের যখন অকালমৃত্যু হলো; মহাকাব্যে সেই মৃত্যুর সহানুভূতিটা গেল রাবণের প্রতি। রাবণকে উনি রাক্ষস হিসেবে দেখেননি। দেখেছেন একজন দেশপ্রেমিক রাজা হিসেবে। উনি রাবণকে দেখেছেন একজন আদর্শ পিতা হিসেবে, আদর্শ রাজা হিসেবে। বরং দূর থেকে এসে রামই তার দেশে আক্রমণ করেছে। এখন অনেকে মনে করেন, মাইকেল এই আইডিয়াটা পেয়েছিলেন গ্রিক উপাখ্যান থেকে। কিন্তু মাইকেল সমস্ত ঘটনাকেই বর্তমানে নিয়ে এলেন। সমস্তটাকেই মানুষের ঘটনা হিসেবে অঙ্কন করলেন। যেমন উনি ‘পদ্মাবতী’ কি ‘শর্মীষ্ঠা’ নাটকে করেছেন।

মাইকেলকে কেন এ আইডিয়াটি নির্মাণে গ্রিক উপাখ্যান থেকে অনুকরণ করতে হবে? ভারতীয় পুরাণেই কি সেসব ধারণা পর্যাপ্ত নেই?

হ্যাঁ, অবশ্যই আছে। তিনি কেবল সেসবের ইন্টারপ্রিটেশনটা দিয়েছেন ভিন্ন। এ ছাড়া আরেকটি দিক উল্লেখ করা যায়। ইংরেজরা ভারতবর্ষ আক্রমণ করেছিল। ভারতবর্ষে তারা রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল। এদিকে তখন সিপাহি বিপ্লব ঘটে গেছে ১৮৫৭ সালে। দেশীয়দের মধ্যে একটা চেতনা জাগছে- আমরা পরাধীন। এই যে জাতীয় চেতনা; রামায়ণের এই বিপরীত ভাষ্য নির্মাণে সেই জাতীয় চেতনা দ্বারাও তিনি প্রভাবিত হয়েছেন বলে অনেকে মনে করেন।

তার খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহণের কারণ কী ছিল বলে আপনি মনে করেন?

তিনি হিন্দু ধর্মকে সর্বদাই খ্রিষ্টিয়ানিটির তুলনায় নিকৃষ্ট মনে করতেন। ১৮৫৪ সালে মাদ্রাজে তিনি একটা বক্তৃতা করেছিলেন। পরে আরও বক্তৃতা করার কথা থাকলেও তা আর হয়নি। পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত মাদ্রাজের সেই একমাত্র বক্তৃতাতে তিনি বলেছিলেন, খ্রিষ্টানরা ভারতবর্ষে এসেছেন ভারতীয়দের উদ্ধার করার জন্য। কিন্তু জাতীয় চেতনাগত দিক দিয়ে তিনি যে পরাধীন- সে ব্যাপারেও তিনি সচেতন ছিলেন। সে জন্যই উনি পরদেশি রামকে বড় করতে পারেননি। তিনি স্বদেশের রাবণকেই বড় করেছেন।

মাইকেল পড়াশোনা করতে গিয়েছেন ডেভিড রিচার্ডসনের ছাত্র হিসেবে। পড়তে গিয়ে আসলে তিনি ইউরোপিয়ানাইজড্‌ হয়ে পড়েছিলেন। সেই মোহ থেকে উনি কাউকে না জানিয়েই খ্রিষ্টান হয়ে গেলেন। তাকে প্রোটেকশন দিল চার্চ। তবে খ্রিষ্টানিটির ওপর তার ভক্তি আগে থেকেই ছিল।

আপনি বলেছেন যে, মাইকেল ভাবতেন, তিনি একদিন মস্ত বড় কবি হবেন, কেবল একবার যদি তিনি বিলেতে যেতে পারেন। কেন তিনি এমনটা ভাবতেন?

কারণ তার যারা প্রিয় কবি, তারা তো সবাই বিদেশি। এবং ওখানে গেলে তার কবিতাকে অ্যাপ্রিশিয়েট করার মতো লোক পাওয়া যাবে। ১৬ বছর বয়স থেকেই তিনি এ ধরনের ভাবনা ভাবতেন। তার ধারণা ছিল, বঙ্গদেশে কবিতা লিখলে সেটা কেউ বুঝতে পারবে না। এ জন্য তিনি একটা কবিতায় লিখেছিলেন, কোথায় সেই অ্যালবিয়নস্‌ ল্যান্ড? সেখানকার পাহাড়রাজি সম্পর্কেও বলেছেন সে কবিতায়। কিন্তু ইংল্যান্ডে আসলে পাহাড় নেই। ১৬ বছর বয়সে লেখা সেই কবিতা।

[খানিক বিরতির পর]

মাইকেল সারাজীবনে যা সঞ্চয় করেছিলেন, সেটা তিনি দিয়ে যেতে চেষ্টা করেছিলেন মেঘনাদবধ কাব্যে। সেই মহাকাব্য যখন লেখা হয়ে গেল, উনি একটা আত্মপ্রসাদ অনুভব করলেন। ভাবলেন যে, বাংলায় যথেষ্ট হয়ে গেছে। এর পর আমি লক্ষ্মীকে সাধনা করব। সরস্বতীকে তো জয় করা গেছে, এবার লক্ষ্মীকে জয় করতে হবে। সে কারণে উনি ইউরোপে চলে গেলেন।

তাহলে লক্ষ্মী সাধনাই কি মাইকেলের ইউরোপে যাবার প্রধান কারণ?

একমাত্র কারণ। কারণ তিনি দেশে ছিলেন পুলিশ অফিসের কেরানি। সেখানে দেখলেন মামলা-মোকদ্দমায় ভালোই আয় করা যাচ্ছে। আর মামলা-মোকদ্দমা তো নিজের বাবাকেই করতে দেখেছেন। সুতরাং তিনি ওকালতির পরীক্ষা দিতে গেলেন। পরীক্ষা দিতে গিয়ে দেখলেন, পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়ে গেছে।

এই প্রশ্ন ফাঁসের রেওয়াজ তাহলে তখন থেকেই?

হ্যাঁ। তখনও প্রশ্ন ফাঁস হতো। যা হোক, তারপর মাইকেল আরেকবার পরীক্ষা দিতে গেলেন। সে পরীক্ষাও বাতিল হয়ে গেল। তার কারণ যে টাউন হলে পরীক্ষা হবার কথা, সেটার মেরামত কাজ চলছে। কলকাতায় এভাবে দু’বার চেষ্টা করেও পরীক্ষা দিতে পারলেন না যখন, তখন ভাবলেন, তাহলে ওকালতি না করে আমি ব্যারিস্টারই হবো। তাহলে আরও আয় করতে পারব। তিনি তখন পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়ে বিলেতে চলে যাবার কথা ভাবলেন। কলকাতার বাড়ির লাগোয়া একটা জমি বিক্রি করলেন এবং দুটো জমিদারি বন্ধক দিলেন মহাদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। মাইকেল হিসাব করে দেখলেন, মহাদেব তার স্ত্রী হেনরিয়েটাকে দেড়শ’ টাকা দেবেন মাসে। আর আড়াইশ’ টাকা বিলেতে পাঠাবেন। আড়াইশ’ টাকা দিয়ে উনি বিলেতে থাকবেন আর দেড়শ’ টাকা দিয়ে হেনরিয়েটা এখানে থাকবেন। কিন্তু ক’দিন পরেই টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিলেন মহাদেব। ১৮৬২ সালের জুন মাসে উনি গিয়েছিলেন। ৬৩ সালের প্রথম দিক থেকেই টাকা বন্ধ। এ অবস্থায় হেনরিয়েটাও চলে গেলেন বিলেতে তার কাছে। মহাবিপত্তি বেধে গেল। এমনিতেই নিজের চলছিল না। উনি তখন ফ্রান্সের ভার্সাইতে চলে গেলেন। সম্ভবত শুনেছিলেন, ভার্সাইতে বসবাসের খরচ কম। কিংবা ভেবেছিলেন, ওখানে গিয়ে ফরাসি লোকদের ইংরেজি শিখিয়ে কিছু আয় করতে পারবেন।

রেবেকার পরে কী হয়েছিল?

আসলে আমি এই একটা জায়গাই পাইনি- রেবেকার পরবর্তী জীবনে কী হয়েছিল। তিনি মারা গেছেন ১৮৯২ সালে; সেই দলিল আমি পেয়েছি। তখনও তার নাম ছিল মিসেস রেবেকা ডাট। আমি তৎকালীন স্ট্রিট ডাইরেক্টরিতেও খুঁজেছি, পাইনি। আসলে ও রকম এক দরিদ্র মহিলার খবর কে রাখে!

বর্তমান সময় এবং সাহিত্যে মাইকেল মধুসূদন দত্তের প্রাসঙ্গিকতার দিকটি নিয়ে আপনার অভিমত কী?

তিনি অবশ্যই প্রাসঙ্গিক। এবং বহুকাল তিনি প্রাসঙ্গিকই থাকবেন। প্রথমে তাকে আমাদের নতুন করে জানার প্রয়োজন। তার কারণ মাইকেল মধুসূদনকে আমরা এ যাবত যা জেনেছি, সেটা ভুল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে, ভুল ইন্টারপ্রিটেশন দিয়ে। তাকে যদি আমাদের একজন পূর্বসূরি মস্ত বড় কবি হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চাই, তার জীবনকে জানতে হবে। এবং তার জীবনের আলোকেই তার সাহিত্যকর্মকে নতুন করে পর্যালোচনা করতে হবে। বাংলা সাহিত্যে প্রথম আধুনিক কবিই হলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তার আগ পর্যন্ত প্রায় সবাই দেব-দেবীকে নিয়ে লিখেছেন। মানুষের কথা তারা লিখেননি। যদিও তিনি মানুষের কথা লিখেছেন দেব-দেবীদের নাম দিয়ে। বাংলা সাহিত্যে মাইকেল হলেন একটা টার্নিং পয়েন্ট। তিনি নাটক লিখলেন, প্রহসন লেখলেন, কাব্য লেখলেন। তিনটাতেই তিনি আধুনিক। তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রথম বিদ্রোহী। ভাষার নির্মাণ করলেন।

সে জায়গা থেকে মাইকেল মধুসূদন তো আমাদের সাহিত্যের ‘আইকন’ হবার কথা। তবে কি তিনি উপেক্ষিত?

হ্যাঁ, তাকে উপেক্ষিতই বলব। উপেক্ষার একটা কারণ আমার ধারণা যে, আধুনিকতার একটা সীমাবদ্ধতাও আছে। কারণ আধুনিকতা একটা আপেক্ষিক শব্দ। আজকে যেটা আধুনিক, আমরা কালকে সেটাকে আধুনিক বলব না। কাজেই মাইকেলকে আমরা আধুনিক বলি যখন, তখন তার আগেকার সাহিত্যের কথা চিন্তা করেই বলি। তারপর মাইকেল বাংলা সহিত্যকে এক রকম ঢেলেই সাজালেন। নাটক, মহাকাব্য, পত্রকাব্য লিখলেন। নতুন করে বাংলা সাহিত্যের মোড় ঘুরিয়ে দিলেন। সেই মাইকেলকে আজ আমরা দুটো কারণে বুঝতে পারি না। এক হচ্ছে, তার লেখায় পৌরাণিক কাহিনী বা হিন্দু দেব-দেবীর রেফারেন্স থাকে; আমাদের ছাত্ররা তা জানে না। এবং তারা আরেকটা জিনিস পারে না, সেটা হচ্ছে মাইকেল যে ভাষায় লিখেছেন, যে ভাষা সেদিন ছিল আধুনিক; আজকে হয়ে গেছে পুরাতন। সে কারণে তিনি অনেকটা আড়ালে চলে গেছেন। এখনও তো বাংলা সাহিত্যের ছাত্র ছাড়া মাইকেলের ‘হে বঙ্গ ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন’- এটার বাইরে কেউ তেমন কিছু জানে না। কিন্তু মাইকেল আমাদের ভাষাকে, সাহিত্যকে নতুন করে তৈরি করেছিলেন। তিনি বিশ্বমানের সাহিত্য রচনা করে গেছেন। সেদিক থেকে মাইকেল আমাদের গর্ব। আমাদের ঐতিহ্য।

1361 ভিউ

Posted ৩:০৩ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ২৬ জানুয়ারি ২০২০

coxbangla.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

এ বিভাগের আরও খবর

Editor & Publisher

Chanchal Dash Gupta

Member : coxsbazar press club & coxsbazar journalist union (cbuj)
cell: 01558-310550 or 01736-202922
mail: chanchalcox@gmail.com
Office : coxsbazar press club building(1st floor),shaheed sharanee road,cox’sbazar municipalty
coxsbazar-4700
Bangladesh
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
বাংলাদেশের সকল পত্রিকা সাইট
Bangla Newspaper

ABOUT US :

coxbangla.com is a dedicated 24x7 news website which is published 2010 in coxbazar city. coxbangla is the news plus right and true information. Be informed be truthful are the only right way. Because you have the right. So coxbangla always offiers the latest news coxbazar, national and international news on current offers, politics, economic, entertainment, sports, health, science, defence & technology, space, history, lifestyle, tourism, food etc in Bengali.

design and development by : webnewsdesign.com