কক্সবাংলা রিপোর্ট(২৮ অক্টোবর) :: কক্সবাজারের সীমান্তবর্তী দুই উপজেলা উখিয় ও টেকনাফে স্থানীয়দের চেয়ে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা দ্বিগুণ হওয়ায় সরকারের সব মনোযোগ এখন রোহিঙ্গাদের ওপর। তাই এই অঞ্চলের স্থানীয়রাই এখন আছেন মারাত্মক সংকটের মুখে।
সর্বশেষ সরকারী পরিসংখ্যান অনুয়াযী রোহিঙ্গা অধ্যূষিত এলাকা উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় ভোটার সংখ্যা দুই লাখ ৪৩ হাজার ৮৯৩ জন।এর মধ্যে উখিয়ায় এক লাখ ১০ হাজার ৫৭৯ জন এবং টেকনাফে এক লাখ ৩৩ হাজার ২৯৬ জন।
আর আর্ন্তজাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ আগস্ট রাখাইনে সেনা অভিযান শুরুর পর থেকে এপর্যন্ত বাংলাদেশে ছয় লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে।
বেসরকারি হিসাবে, অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের এই সংখ্যা আরও বেশি। আর আগে থেকেই বাংলাদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গারাসহ এখন টেকনাফ ও উখিয়ায় প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
জানা গেছে,অনেক স্কুলে লেখাপড়া বন্ধ রয়েছে দুই মাস ধরে,বেড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম। যানবাহনের ভাড়া বেড়েছে দ্বিগুণ-তিনগুণ। নষ্ট হয়েছে কয়েকশ’ একর ফসলি জমি ও চিংড়ি ঘের। বিলীন হয়ে গেছে হাজার হাজার একর বনভূমি। মিয়ানমারে চলমান সহিংসতার কারণে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে এরকম আরও অনেক ধরনের ক্ষয়ক্ষতি ও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে টেকনাফ ও উখিয়ার স্থানীয় বাসিন্দাদের।
উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী দাবি করেন, ‘নতুন ও পুরাতন মিলিয়ে টেকনাফ ও উখিয়ায় এখন কমপক্ষে ১০ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছে। প্রতিদিন অসংখ্য রোহিঙ্গা এখনও সীমানা পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আসছে। তাদের কারণে প্রতিনিয়ত আমাদের বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।’
স্থানীয় বাসিন্দাদের এই সংকটের বিষয়টি কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের তথ্যেও স্পষ্ট হয়েছে।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের হিসাব অনুযায়ী, ২০১১ সালে টেকনাফের জনসংখ্যা ছিল দুই লাখ ৬৪ হাজার ৩৮৯ জন। আর উখিয়ার জনসংখ্যা ছিল দুই লাখ সাত হাজার ৩৭৯ জন। গত ছয় বছরে দুই উপজেলার জনসংখ্যা আরও বেড়েছে। তবে সব মিলিয়ে দুই উপজেলার জনসংখ্যা পাঁচ লাখের বেশি হবে না বলে জানিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।
অতিরিক্ত রোহিঙ্গার চাপে স্থানীয় বাসিন্দারা শুধু সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন তা নয়, তাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে তারা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে, অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে যাতায়াত করতে হচ্ছে, শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছেন পাঠ কার্যক্রম থেকে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ায় টেকনাফ ও উখিয়ায় সব ধরনের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে এই বৃদ্ধির হার দ্বিগুণ-তিনগুণ। আগে যে সবজি ২০ থেকে ৩০ টাকায় কেনা যেতো এখন সেটি কিনতে হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকায়। যাতায়াত খরচও বেড়েছে কয়েকগুণ।
আগে যেখানে কক্সবাজার থেকে টেকনাফ যেতে সিএনজি ভাড়া নিতো আড়াইশ থেকে তিনশ’ টাকা, এখন সেখানে ওই দূরত্বে গুনতে হচ্ছে ৬শ’ থেকে ৭শ’ টাকা। বাসে যাতায়াত করতে গিয়েও বাড়তি ভাড়া দিতে হচ্ছে।
শুক্রবার (২৭ অক্টোবর) দুপুরে কথা হয় স্থানীয় অটোরিকশাচালক আব্দুর রহিমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গারা আসায় বাজারে সব কিছুর দাম বেড়ে গেছে। এখন বাজারে কোনও সবজি ৫০টাকার নিচে পাওয়া যায় না। চাল, ডাল, তেল সবকিছুর দাম বাড়তি।’
একই অভিযোগ করলেন স্থানীয় বাসিন্দা নুরুল আলম। তিনি বলেন, ‘ত্রাণ পেয়ে রোহিঙ্গারা হাসতে হাসতে ক্যাম্পে ঢোকে। আর বাজারে গিয়ে আমাদেরকে হা-হুতাশ করে মরতে হয়। কিছু কিনলেই তাতে বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে। কোথাও যাবো, সেই ক্ষেত্রেও বাড়তি ভাড়া দিতে হচ্ছে।’রোহিঙ্গাদের কারণে নষ্ট হয়ে গেছে কয়েকশ’ একর ফসলি জমি।
কক্সবাজার জেলা কৃষিবিভাগ জানিয়েছে, রোহিঙ্গাদের কারণে ৯০ একরের বেশি সবজির মাঠ ও ১০ একরের বেশি ধানক্ষেত নষ্ট হয়েছে। এছাড়া ৫০ একরের বেশি চিংড়ি ঘের নষ্ট হয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা মৎস্য অফিস।
অন্যদিকে, রোহিঙ্গা সংকটের কারণে উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার শিক্ষা কার্যক্রম চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। দীর্ঘ দুই মাস ধরে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ এই এলাকার ১৪টি মাধ্যমিক স্কুল ও ১৩টি প্রাথমিক সরকারি স্কুলে, ফলে স্কুলে যাচ্ছে না ১৩ হাজার শিক্ষার্থী। আগামী ১ নভেম্বর শুরু হতে যাওয়া জেএসসি ও সমমানের পরীক্ষা নিয়ে শঙ্কা বিরাজ করছে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মনে।
কক্সবাজার জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ছালেহ আহমেদ চৌধুরী জানিয়েছেন, ‘রোহিঙ্গা সংকটের কারণে দুই উপজেলার বেশ কিছু বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ত্রাণসহ বিভিন্ন কাজে স্কুল ভবন ব্যবহার করায় এসব বিদ্যালয়ে পাঠকার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না।’
তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমরা লিখিতভাবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। গত ৮ অক্টোবর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক এস এম ওয়াহিদুজ্জামান এসব স্কুল পরিদর্শন করেছেন। কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
কক্সবাজার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক আ ক ম শাহরিয়ার বলেন, ‘সম্প্রতি বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা যুক্ত হওয়ায় টেকনাফ ও উখিয়া এলাকায় কৃষিতে নতুন অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। উখিয়ার থ্যাইংখালী, উলবুনয়াপাড়া, উনচিপ্রাং, তমব্রুসহ বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় করলা, বাঁধাকপি, বরবটি, কাঁচামরিচ, টমেটোসহ বিভিন্ন সবজি ক্ষেতের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।’ রোহিঙ্গাদের কারণে দুই উপজেলায় প্রায় ১৫০ একর ফসলি জমি নষ্ট হয়ে গেছে বলে তিনি জানান।
Posted ১২:৫১ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ২৯ অক্টোবর ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta