বুধবার কথা হয় রাখাইন রাজ্যের মংডু জেলার মগনিপাড়ার রমিজা বেগম(৪২) এর সঙ্গে।তিনি থাকছেন কক্সবাজারের উখিয়ার লম্বাশিয়া আশ্রয়শিবিরের পাহাড়ের ঢালুতে বাঁশের খুঁটি আর ত্রিপলের ছাউনি ও বেড়ার তৈরি ছোট্ট ঝুপড়িতে।
তিনি জানান,আজকের এই খুশির দিনটিতেও রমিজা বেগম ভুলতে পারেননি গত বছরের এ দিনের কথা। নিজের ভাষায় রমিজা বলছিলেন, ‘গত বছর কোরবানের এই দিনে স্বামীকে হারিয়েছি, হারিয়েছি ছোট দুই ভাইকে। সেনাবাহিনীর সদস্যরা রাখাইন রাজ্যের মগনিপাড়ায় ঢুকে গুলিবর্ষণ শুরু করলে প্রাণ বাঁচাতে রোহিঙ্গারা যে যেদিকে পারে, দৌড়াচ্ছিলেন। এ সময় গুলিতে তাঁদের মৃত্যু হয়। লাশের দাফনও হয়নি। আজকে ঈদের দিনে তাঁদের কথা খুব মনে পড়ছে, তাঁদের জন্য মন জ্বলছে। কিন্তু কী করব?’কথা বলতে গিয়ে রমিজার চোখে ঝরে পানি।
রমিজার গত ১১ মাস ২৩ দিন ধরে তিনি এই শিবিরে আছেন তিনি। সঙ্গে তাঁর মা ও চার ছেলেমেয়ে। জাতিসংঘের সহযোগিতায় তিনি চাল, ডাল, তেল, লবণসহ আনুষঙ্গিক সব সহযোগিতা পাচ্ছেন। ঈদের দিন মাংসও পেয়েছেন কয়েক কেজি। তবুও মনে শান্তি নেই তাঁর।
রমিজা বেগম বলেন, ‘গত বছর কোরবানের ঈদে (রাখাইন রাজ্যে) ছেলেমেয়েদের নতুন জামা কিনে দিয়েছিলাম। ঘরে পালিত তিন মণ ওজনের একটি গরু কোরবানি দিয়েছিলাম। সে গরুর মাংস গ্রামের অনেকে খেয়েছে। এখন রোহিঙ্গা বস্তিতে কয়েক কেজি মাংসের জন্য হাত পাততে হচ্ছে। কী করব, ছেলে মেয়েরা তো আর লজ্জা-শরম বুঝে না।’
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইন রাজ্যের কয়েকটি সীমান্ত চৌকিতে হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। এ সময় ১৮ ব্যক্তির মৃত্যু হয়। ওই দিন থেকে সেখানকার সেনাবাহিনী, বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) ও মগ সম্প্রদায়ের লোকজন মিলে রোহিঙ্গাদের ওপর ব্যাপক নির্যাতন শুরু করে। গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চলতে থাকে। এরই মধ্যে আসে কোরবানির ঈদ।
রাখাইন রাজ্যের কোনো রোহিঙ্গা ঈদ করতে পারেননি। লাখো রোহিঙ্গার ঈদ কেটেছে টেকনাফের পথে পথে, টেকনাফ-কক্সবাজার সড়কের দুই পাশে, বন-জঙ্গলে। এক বেলা, দুই বেলা অভুক্ত থেকেও তাঁদের মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজতে হয়েছিল সে সময়।
এক বছর আগের সেই কোরবানির ঈদের দুঃখগাথা তুলে ধরে উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা (মাঝি) জাকির হোসেন বলেন, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাত থেকে কোরবানির তিন দিন পর্যন্ত ছয় দিনে লাখো রোহিঙ্গা হারিয়েছেন তাঁদের প্রিয় ছেলেমেয়ে, মা-বাবা, স্ত্রী, সন্তান-স্বজনকে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছে শত শত রোহিঙ্গা। ধর্ষণের শিকার হাজারো মা-বোন। এক বছরেও তার বিচার হয়নি।
বুধবার ঈদের দিনে তাঁদের কথা মনে পড়ছে, তাই প্রতিটা ঘরে কান্না আর আহাজারি চলছে নিখোঁজ ও পরিস্থিতির শিকার হয়ে মারা যাওয়া স্বজনদের জন্য। এই ঈদ লাখো রোহিঙ্গার বেদনার ঈদে পরিণত হয়েছে।
বুধবার দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত উখিয়ার ৫ এবং টেকনাফের ৪ আশ্রয়শিবির ঘুরে উপদ্রুত ও আশ্রিত এসব মানুষের দুঃখ ভুলে থাকার প্রয়াস চোখে পড়েছে। ছোট শিশু-কিশোরেরা দল বেঁধে এ বাড়ি-ও বাড়ি যাচ্ছে। যতটুকু পারে রান্না করা মাংসের সঙ্গে চালের রুটি, সেমাই, হালুয়া, চা-বিস্কুট, ভাত খেতে দিয়ে আপ্যায়ন করছেন তাঁরা। যুবকেরা শিবিরের অলিগলি, দোকানপাট আর সড়কের পাশে আড্ডা জমাচ্ছে।
কেউ খেলছেন ক্যারম-লুডু। কম-বেশি সবার গায়ে নতুন জামা, গেঞ্জি ও লুঙ্গি। মাথায় টুপি। নারীদের পরনে থামি (লুঙ্গির মতো) ও ব্লাউজ, মাথায় ওড়না। তবে কিছু তরুণীকে দেখা গেছে বাংলাদেশিদের মতো সালোয়ার কামিজ পরা, চোখে কালো চশমা, হাতে মুঠোফোন। তারাও দল বেঁধে এক শিবির থেকে আরেক শিবিরে যাচ্ছেন।
বালুখালী আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গা আছে প্রায় ৮০ হাজার। কমবেশি সবার ঘরে মাংস-রুটির আপ্যায়ন ছিল। এই শিবিরের রোহিঙ্গা আজম উল্লাহ বলেন, আশ্রয়শিবিরের বাসিন্দারাও সামর্থ্য অনুযায়ী গরু-ছাগল কোরবানি দিয়েছেন। এদের আত্মীয়স্বজন আছেন সৌদি আরব, মালয়েশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। অনেকে সরকারি ও এনজিও থেকে মাংস পেয়েছেন।
রাখাইন রাজ্য থেকে আজ যাঁদের ঠাঁই হয়েছে রোহিঙ্গা শিবিরে তাঁদের অনেকের অবস্থা একসময় ভালো ছিল। এখন এই শিবিরের দুঃসহ জীবনের মধ্যে অতীতের সুখের স্মৃতির রোমন্থন করেন কেউ কেউ। এদের একজন রোহিঙ্গা সলিম উল্লাহ। বলছিলেন, ‘২০ বছর ধরে রাখাইন রাজ্যে ৪ থেকে ৫ মণ ওজনের গরু জবাই করে কোরবানি দিয়ে আসছি। গ্রামের কত লোক ঘরে এসে চালের রুটির সঙ্গে রান্না করা গরুর মাংস খেয়েছে। আর এখন এক-দুই কেজি মাংসের জন্য অন্যের কাছে হাত পাততে হচ্ছে। এটা বড়ই লজ্জার ব্যাপার।’
সলিম উল্লাহর বাড়ি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের খেয়ারিপ্রাং গ্রামে। তিনি থাকেন উখিয়ার মধুরছড়া আশ্রয়শিবিরে, স্ত্রী ও পাঁচ ছেলেমেয়ে নিয়ে।
রোহিঙ্গারা বলেন, তখন সেনাবাহিনীর দমনপীড়ন, অগ্নিসংযোগ ও গণহত্যার কবলে পড়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশ পালিয়ে আসে। কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ার ৩০টি আশ্রয়শিবিরে বর্তমানে অবস্থান করছে ১২ লাখ রোহিঙ্গা। এসব পরিবারে এখনো ১২ থেকে ১৫ হাজার রোহিঙ্গা রাখাইন রাজ্যে নিখোঁজ আছে।
জাতিসংঘের তথ্যমতে, আশ্রয়শিবিরগুলোতে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লাখ ১৮ হাজার ৫৫৮। এর মধ্যে সলিম উল্লাহর মতো ধনাঢ্য ব্যক্তিরাও রয়েছেন।
বেলা তিনটার দিকে জুমশিয়া শিবিরের রোহিঙ্গা করিমন বিবি নাতিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন বালুখালী আশ্রয়শিবিরের দিকে। হাতে টিফিন ক্যারিয়ার। তাতে মাংস আর চালের রুটি।
করিমন বিবি (৫৫) বললেন, বালুখালী শিবিরে তাঁর এক মেয়ে ও দুই নাতি থাকে। তারা মাংস পায়নি। তাই তাদের জন্য অল্প রান্না করা মাংস আর কয়েকটা চালের রুটি নিয়ে যাচ্ছেন তিনি। ভিন দেশের আশ্রয়শিবিরে মা-মেয়ের পৃথক বসবাস হলেও ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেওয়ার রেওয়াজ তিনি ধরেই রেখেছেন।
আজ সকাল থেকে আকাশটা পরিষ্কার ছিল। কিন্তু কোরবানির ঈদের নামাজ শেষ হওয়ার পর থেমে থেমে কয়েক দফা বৃষ্টি হয়েছে। কয়েকটি মাঠে ঈদের বড় জামাত হলেও টেকনাফ ও উখিয়ার ৩০টি শিবিরে ঈদের নামাজ আদায় হয়েছে ১ হাজার ৩০০ মসজিদ ও মক্তবে। সকাল ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে ঈদের নামাজ সম্পন্ন হয়েছে। সব নামাজে রোহিঙ্গা জাতির পাশে দাঁড়ানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতিসংঘ, বিভিন্ন দাতা সংস্থা, দেশি-বিদেশি এনজিওসহ কক্সবাজারবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে কোরবানির ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে রোহিঙ্গাদের জন্য কয়েক হাজার পশু সরবরাহ করা হয়েছে। আরও কয়েক হাজার পশু সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, এনজিও ও সরকারের পক্ষ থেকে পশুগুলো কেনা হয়েছে। পাশাপাশি রোহিঙ্গা বসতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয়দের (বাংলাদেশি) জন্যও ছয় শতাধিক কোরবানির পশু সরবরাহ হয়েছে।
উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নিকারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, আজ সকালে উখিয়ার বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে ১ হাজার কোরবানির পশু (গরু ও মহিষ) জবাই হয়েছে। গরুর মাংস প্রতিটা রোহিঙ্গা পরিবারে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।
টেকনাফের নয়াপাড়া আশ্রয়শিবিরের ক্যাম্প ইনচার্জ (উপসচিব) সাইফুল ইসলাম বলেন, এই শিবিরের ৭০ হাজার রোহিঙ্গা আছে। রোহিঙ্গাদের জন্য ২৫টি গরু জবাই হয়েছে। টেকনাফের শালবন, পুটিবনিয়া, চাকমারকুল আশ্রয়শিবিরেও সরবরাহ দেওয়া হয়েছে ১৫০টি কোরবানির পশু। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে মাংসগুলো রোহিঙ্গাদের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। ঈদের দ্বিতীয় দিন কালও বেশ কিছু পশু জবাই হবে। এতে রোহিঙ্গারা খুশি।
বিকেল চারটার দিকে ক্যাম্প থেকে ফিরে আসার সময় দেখা হলো রোহিঙ্গা শিক্ষক আবুল কাশেমের সঙ্গে। জিজ্ঞেস করলাম, ঈদ কেমন যাচ্ছে? মুচকি হেসে বললেন, ‘রোহিঙ্গাদের আবার কিসের ঈদ? রোহিঙ্গাদের ঈদ এক বছর আগেই রাখাইন রাজ্যে কবর দিয়েছে সেখানকার সামরিক জান্তা। এখন শরীরটা নিয়ে বাংলাদেশে পড়ে আছি। এই ঈদের মৃত মা-বাবার কবরটাও জিয়ারত করতে পারলাম না। তাঁরা শায়িত আছেন রাখাইন রাজ্যে।’
আবুল কাশেম থাকেন উখিয়ার কুতুপালং ডি-৪ আশ্রয়শিবিরে। রাখাইন রাজ্যের বলিবাজার হাইস্কুলের শিক্ষক ছিলেন তিনি। প্রতিবছর কোরবানির ঈদে তিনি একাধিক পশু কোরবানি দিয়েছেন, এখন সেই সুযোগ নেই।
মাস্টার আবুল কাশেম বললেন, ‘আমরা চাই দ্রুত প্রত্যাবাসন শুরু হোক। নিজের জন্মভূমিতে ফিরে যাক রোহিঙ্গারা। গণহত্যা, ধর্ষণের বিচার হোক। তাতেই আনন্দ ফিরে পাব। এ জন্য বাংলাদেশ সরকার, জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মহলের হস্তক্ষেপ ও সহযোগিতা দরকার।’
তবে প্রিয় জন্মভূমিতে সত্যিই কি ফেরা হবে—এমন সংশয় এখনো গভীর রোহিঙ্গাদের ভেতরে। তারা কী বিভিন্ন দেশ আর সংস্থার অনুকম্পার পাত্র হয়েই থাকবে দিনের পর দিন। আবার কবে ফিরে পাবে হারানো দিনের সুখের ঈদ—এমন প্রশ্ন এখন তাদের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে প্রতিদিন।
উখিয়ার মধুরছড়া আশ্রয়শিবিরে আজম উল্লাহ বলেছিলেন ‘গত বছর ২৭ আগস্ট হাজারো রোহিঙ্গার কোরবানির ঈদ কেটেছে টেকনাফের পথে পথে। কারও আবার নদীতে। এখন দ্বিতীয় কোরবানির ঈদ কাটছে উখিয়া ও টেকনাফের পাহাড় জঙ্গলে ঝুপড়িতে। আগামী ঈদ কোথায় কাটবে, কেউ জানে না।’