বিশেষ প্রতিবেদক(১৩ জুলাই) :: কক্সবাজারের সাথে মিয়ানমার সীমান্তবর্তী উখিয়া-টেকনাফে অবস্থানরত নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আধিপাত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে চাঁদাবাজি, খুন, অপহরণসহ নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। মিয়ানমারের বিদ্রোহী সংগঠনের অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের কাছে নিরীহ রোহিঙ্গা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, গ্রামবাসী কেউ নিরাপদ নয় বলে মনে করছেন সচেতন মহলের দাবী।
ক্যাম্পের ভিতরে বাইরে আইনপরিন্থি পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। অবনতি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে রোহিঙ্গাদের সীমাবদ্ধতায় বাউন্ডারী গন্ডির ভেতরে নিয়ন্ত্রণে রাখার দাবি জানিয়েছেন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম পরিষদ।
কুতুপালং ক্যাম্পের নিবন্ধিত রোহিঙ্গা নেতা ডাক্তার জাফর আলম প্রকাশ ডিপো জাফর জানায়, সে ১৯৯২ সালে কুতুপালং ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে। বর্তমান সময়ে ক্যাম্পের ভয়াবহ পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ প্রসঙ্গে সে জানায়, মিয়ানমারের বিদ্রোহী সংগঠন আরএসও’র নেতাকর্মীরা সে সময় থেকে ক্যাম্পে অবস্থান করলেও খুন, গুম, অপহরণের মত অপ্রীতিকর কোন ঘটনা ঘটেনি।
ইদানিং আল-ইয়াকিন নামের একটি সংগঠনের আবির্ভাব হওয়ায় দুটি সংগঠনের নেতাকর্মীরা মাথা চড়া দিয়ে উঠেছে। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ঘায়েল করতে সমর্থক নেতাকর্মীদের অপহরণ করে হত্যা করছে। তাদের বিরুদ্ধে আচরণ করলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের হুমকি প্রদর্শন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
গত ১৩ জুন রাত ১২টায় আল-ইয়াকিনের ১৮/২০ জন সন্ত্রাসী কুতুপালং ক্যাম্পে হামলা ও বাড়ীঘরে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে আয়ুব মাঝি (৪৫) ও মোহাম্মদ সেলিম (২৮)কে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে নিয়ে যায়। গত ১৮ জুন তেলীপাড়া খাল থেকে সেলিমের জবাই করা লাশ ও ২৫ জুন সন্ধ্যায় আয়ুব মাঝির ক্ষতবিক্ষত গলাকাটা লাশ উদ্ধার করেন উখিয়া থানা পুলিশ।
এর আগে গত ২৩ মে কুতুপালং ক্যাম্পে ইমাম হোসেনের ছেলে মোঃ শফিকে আল-ইয়াকিনের সশস্ত্র সন্ত্রাসী অপহরণ করে ৫ লক্ষ টাকা চাঁদা দাবী করেন। চাঁদা না দেওয়ায় সন্ত্রাসীরা তাকে গুলি করে হত্যা করে। গত ২৫ মে সকালে মধুরছড়া জঙ্গল থেকে পুলিশ মোঃ শফির লাশ উদ্ধার করে।
গত ২৯ জুন কুতুপালং বস্তি ম্যানেজম্যান্ট কমিটির সভাপতি আবু ছিদ্দিক (৪৫) কে হত্যার উদ্দেশ্যে উপর্যুপুরি ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায় চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা। এক মাসের ব্যবধানে চাঞ্চল্যকর তিনটি হত্যাকান্ড ও অপহরণ করে নির্যাতন, ছুরিকাঘাতের ঘটনায় রোহিঙ্গাদের মাঝে বিরাজ করছে অজানা আতংক।
বালুখালী রোহিঙ্গা বস্তিতে সশস্ত্র আল-ইয়াকিনের সদস্যরা অবস্থান করছে এমন প্রশ্নের জবাবে সাধারণ রোহিঙ্গারা মুখ খুলতে নারাজ।
তবে স্থানীয় ইউপি সদস্য নুরুল আবছার জানান, রোহিঙ্গারা কারো জন্য নিরাপদ নয়। তারা যেকোন অপরাধ সংগঠিত করতে কোন প্রকার দ্বিধাবোধ করে না। তাই এসব রোহিঙ্গাদের যতদ্রুত সম্ভব মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন নয়তো বা যেকোন এক জায়গায় সীমাবদ্ধতার ভিতরে নজরদারিতে রাখা উচিত বলে ওই ইউপি সদস্য তার মতামত ব্যক্ত করেন।
কুতুপালং বস্তিতে আরএসও বা আল-ইয়াকিনের সশস্ত্র সদস্যদের দৌরাত্ম সম্পর্কে স্থানীয় ইউপি সদস্য বখতিয়ার আহমদ জানান, আল-ইয়াকিনের সদস্যরা চাঁদাবাজি, খুন, অপহরণসহ বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত। তাদের অপরাধ দমন করতে গিয়ে তাকেও মৃত্যুর হুমকি প্রদর্শন করা হচ্ছে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।
রোহিঙ্গা বস্তিতে চলমান নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উদ্যোগী হয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রোহিঙ্গা নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেন তার অফিস কক্ষে।
এসময় উপস্থিত রোহিঙ্গা নেতা শাহ আলম, মোহাম্মদ নুর, আবু ছিদ্দিক, আলী আহমদ, আব্দুর রহিম অভিযোগ করে জানান, আল-ইয়াকিন নামধারী সংগঠনের সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের ভয়ে রোহিঙ্গারা আতংকে দিনযাপন করছে। এসব সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার ও তাদের নৈরাজ্য দমনে কুতুপালং এলাকায় একটি স্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প স্থাপনের দাবি জানান রোহিঙ্গা নেতারা।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ও সংগ্রাম পরিষদের সদস্য সচিব নুর মোহাম্মদ সিকদার জানান, উখিয়ার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ও কুতুপালং, বালুখালীতে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের সহ টেকনাফ এলাকায় অবস্থানরত সমস্ত রোহিঙ্গাদের একটি স্থানে গন্ডির ভেতরে প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে রাখা না হলে অদূর ভবিষ্যতে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরো অবনতি হতে পারে।
টেকনাফ মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মাঈন উদ্দিন খান জানান, পুলিশের তাড়া খেয়ে আত্মগোপনে থাকা আল-ইয়াকিনের সদস্য হ্নীলা নয়াপাড়া শরণার্থী শিবিরের মৃত জমির আহমদের ছেলে দোস্ত মোহাম্মদ (৩৫) কে আটক করা হয়েছে।
কুতুপালং বস্তির সেক্রেটারী মোহাম্মদ নুর জানান, উখিয়া-টেকনাফে আল-ইয়াকিনের প্রায় সাড়ে ৩ শতাধিক সদস্য রয়েছে। যারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করে অপরাধ প্রবণতা চালিয়ে যাচ্ছে।
রোহিঙ্গা নেতা ডাক্তার ফয়সাল আনোয়ার জানান, রোহিঙ্গাদের সীমাবদ্ধতার ভিতরে প্রশাসনের কড়া নজরদারিতে রাখা না হলে ভবিষ্যতে স্থানীয়রাও রোহিঙ্গাদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়বে।
গত বুধবার রোহিঙ্গা সংক্রান্ত বিশেষ টাস্কফোর্স কমিটির সভায় জেলা প্রশাসক মোঃ আলী হোসেন বলেন, মানবিক বিপর্যয়ের কারণে সরকার মাহানুভবতার পরিচয় দিয়ে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় আইন শৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের নির্দিষ্ট একটি গন্ডির ভিতরে রাখার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এজন্য ৫০ একর ভূমি অধিগ্রহণ করার জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় উপস্থিত পুলিশ সুপার ড. একে এম ইকবাল হোসেন একমত পোষণ করে বক্তব্য রাখেন।
Posted ১২:৫৯ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ১৪ জুলাই ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta