আব্দুর রাজ্জাক(৩১ ডিসেম্বর) :: ইংরেজি নবর্বষের প্রথম প্রহর থার্টি ফার্স্ট নাইটে এবার বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত পর্যটন নগরী কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে জনসমাগমের সময়সীমা রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত নির্ধারণ করে দিয়েছে পুলিশ প্রশাসন। ইংরেজী বর্ষ বরণ ও বিদায় নিয়ে সমুদ্র সৈকতে সন্ধ্যার পর কোন অনুষ্টান না থাকলেও সৈকত এলাকায় রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত জনসাধারণ প্রবেশ করতে পারবে। রাত সাড়ে ১২টার মধ্যে সবাইকে সমুদ্র সৈকত এলাকা ত্যাগ করতে হবে।
তবে তারকা হোটেলগুলোতে নববর্ষ উদযাপনের নানা আয়োজন থাকলেও সেখানে থাকবে পুলিশের কড়া নজরদারী। বিশাল খোলা প্রান্তের ১’শত ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ কক্সবাজার সৈকত হয়ে ওঠে সব উৎসবের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র। বর্ষ বরণ ও বিদায়ে উচ্ছ্বাসে মতোয়ারা হন স্থানীয়দের পাশাপাশি দেশি-বিদেশী পর্যটক। যে কোনো সার্বজনীন উৎসবে এখানে লাখ লাখ লোকের ভিড় জমে।
তবে ২০১৭ সালের বিদায়ের দিন। এবার কক্সবাজারের আকাশে দেখা মেলেনি ২০১৭ সালের শেষ সূর্য। বৈরী আবহাওয়ায় সন্ধ্যার পর থেকে ছিল গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি।
বিকেল থেকেই পর্যটকের স্রোত নামে সৈকতমুখী। কিন্তু সন্ধ্যার পর পাল্টে যায় আবহাওয়া। আকাশ ভেঙে নেমে আসে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। এমন বৈরি আবহাওয়া সত্ত্বেও পর্যটকরা অনাবিল আনন্দ আর উৎসাহ-উদ্দীপনায় পুরনো বছরকে বিদায় জানাতে ভিড় করেন সৈকতে। মন রাঙিয়ে ইংরেজি বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ করেছেন প্রায় তিন লাখ মানুষ।
এছাড়া ‘থার্টি ফার্স্ট নাইট’ ঘিরে সমুদ্রসৈকতে ছিল না কোনো আয়োজন। তবু কমতি নেই পর্যটকের। হোটেল-মোটেল, গেস্টহাউসসহ সর্বত্র পর্যটকে ঠাঁসা।ইংরেজি বর্ষবরণ ও বর্ষবিদায়ে অন্য বছরের মতো এবার কক্সবাজার সৈকতে দেশের প্রখ্যাত শিল্পীদের গান নেই। জনপ্রিয় ব্যান্ডদলের গিটারে বাজেনি সুর। বিশাল মঞ্চে দেখা মেলেনি কোনো দেশের তারকাশিল্পী। আলোকিত হয়নি সমুদ্রসৈকত। রাত ১২টা পর্যন্ত গানের তালে তালে নাচার কোনো সুযোগও ছিল না। রবিবার দীর্ঘদিনের চিত্র পাল্টে গিয়ে নীরবেই সৈকতে বসে হাজারো মানুষের মিলনমেলা।
অন্যান্য উৎসবের মতো গত কয়েক বছর আগেও ইংরেজী বর্ষ বিদায় এবং নববর্ষকে বরণ করার জন্য এখানে চলতো হরেক রকমের আয়োজন। কিন্তু দেশের বিভিন্ন স্থানে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটার পর থেকে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতেও এক ধরণের অলিখিত নিষেধাজ্ঞা জারী করে পুলিশ প্রশাসন। এবারও তার ব্যতিক্রম হচ্ছেনা।
এদিকে থার্টিফাষ্ট নাইটকে ঘিরে দেশী বিদেশী পর্যটকরা ভিড় করছেন বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত পর্যটন নগরী নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর অপার সম্ভবনাময় কক্সবাজার শহরে। জেলা সদর ছাড়াও বিভিন্ন উপজেলায় এর প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে।
বিশেষ করে উখিয়ার ইনানী, পাতুয়ার টেক, মহেশখালীর আদিনাথ মন্দির, বৌদ্ধ মন্দির, চকরিয়ার বঙ্গবন্ধু সাফারী পার্ক, রামুর বৌদ্ধ বিহার, টেকনাফ সদর ও দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সের্ন্টমার্টিনে। ফলে ঠাঁই নেই কোন হোটেল-মোটেল ও গেষ্ট হাউসে।
আবার কেউ কেউ আগাম বুকিং দিলেও পর্যটকদের চাপ সহ্য করতে না পেরে বিভিন্ন মহলের চাপে হোটেল মোটেল ব্যবসায়ীরা তাদের বুকিংকৃত রুমগুলো অন্যত্র ভাড়া দিয়ে ফেলেছেন এমন অভিযোগ আগত বেশকজন পর্যটকের। অনেক পর্যটক হোটেল-মোটেল, কটেজ, গেষ্ট হাউস গুলোতে জায়গা না পেয়ে আত্মীয় স্বজনের বাড়ি খূঁজতে দেখা গেছে। হঠাৎ করে আত্মীয়-স্বজনের খবরে স্থানীয়দের অনেকেই খুশি হতে দেখা গেছে।
অনেকেই জানান সারা বছর খোঁজ-খবর না থাকলেও অন্তত থার্টিফাষ্ট নাইটে সবার দেখা মেলাতে তারা খুশি। রবিবার দুপুর ১২ ঘটিকায় সমুদ্র সৈকতের লাবনী পয়েন্ট পরিদর্শনকালে দেখা যায়, দেশী-বিদেশী নারী পুরুষ পর্যটক আর শিশুদের ঢেউ। আস্তে আস্তে বাড়ছিল পর্যটকদের আনাগোনা।
এদিকে টেকনাফ, সেন্টমার্টিন, ইনানী আর কক্সবাজার শহরে অবস্থান করছেন তিন লক্ষাধিক পর্যটক। পর্যটকে টইটম্বুর কক্সবাজার। গেল কয়েকদিনে ঠাঁই নিয়েছেন তাঁরা। ২৫ ডিসেম্বর খ্রিস্টানদের বড়দিনের ছুটি, শীতকালীন অবকাশ, ইংরেজি বর্ষকে বিদায়-বরণসহ সরকারি বিভিন্ন ছুটি উপভোগ করতে কক্সবাজারে ছুটে এসেছেন তাঁরা। অনেকে হোটেলে রুম না পেয়ে উঠেছেন আত্মীয়-স্বজনের বাসায়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে এমন ব্যবসা পুরো জানুয়ারি জুড়ে থাকবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সময়ের পালাবদলে সমুদ্রের বালুচর পরিনত হল জনসমুদ্রে। অনাবিল সৌন্দর্য্য উপভোগে সৈকত তীর লোকে-লোকারণ্য হয়ে গেছে। যান্ত্রিক জীবনের কোলাহল পেড়িয়ে অবারিত টেউয়ের সুনীল জলরাশিতে ভাসছে লাখো মানুষ।
সাগরের গর্জনে ঘুম ভাঙ্গা শহরে একান্ত কিছু সময় কাটাতে পাড়ি জমিয়েছে দেশের আনাচে কানাচের র্পযটকসহ বিদেশীরা।
প্রিয়জনের সাথে প্রিয় কিছু মূূহুর্ত কাটাতে বেচে নিয়েছেন সাগর, পাহাড় আর দ্বীপ জেলা কক্সবাজারকে। ইংরেজী নববর্ষকে ঘিরে অসংখ্য হোটেল-মোটেল আগত অতিথিদের বরণ করতে নতুন সাজে সাজানো হয়েছে। পাশাপাশি পর্যটন স্পটগুলো সাজানো হয়েছে নবরূপে।
এদিকে কক্সবাজারের পর্যটনস্পট সমুদ্রসৈকত, ইনানী, সেন্টমার্টিন, হিমছড়ি, সোনাদিয়া, মহেশখালীর আদিনাথ মন্দির, ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক, গুদুম গুহা, রামুর রামকোট, ১০০ ফুট দীর্ঘ সিংহশয্যা বুদ্ধমূর্তি দেখতে পর্যটকদের ভিড় বেড়েছে। বার্মিজ মার্কেট, কলাতলীর শুঁটকির দোকান, বাজারঘাটার বিভিন্ন মার্কেটে বেড়েছে বিকিকিনি। গভীর রাত অবধি চোখে পড়ছে পর্যটকদের বিচরণ।
কক্সবাজার এর আবাসিক হোটেল-মোটেল, গেস্টহাউজ মালিক সমিতির অর্থ সম্পাদক আলহাজ্ব শফিকুর রহমান বলেন, কক্সবাজারে তারকা মানের হোটেল সহ চার শতাধিক হোটেল-মোটেল, কটেজ ও গেস্ট হাউস রয়েছে। রাজনৈতিক অচলাবস্থার কারণে গত কয়েক বছরে এসব হোটেল-মোটেলই লোকসান হয়েছে প্রায় হাজার কোটি টাকা। লোকসানে পড়ে অনেক মালিকই ঋণভারে জর্জরিত। দেশের পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক। পর্যটকরা আসতে শুরু করেছেন। এখানকার নিরাপত্তাও খুব ভালো।
সাগরপাড়ের তারকা মানের হোটেল সি গালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ ইমরুল ইসলাম ছিদ্দিকী রুমি বলছেন, পর্যটকেরা কক্সবাজার এলে কেবল শহরের সমুদ্র সৈকতেই ঘুরে বেড়ান না, পাশাপাশি ইনানীর পাথুরে বীচ, হিমছড়ির পাহাড়ি ঝড়না ও দরিয়ানগর পর্যটনপল্লী, টেকনাফের মাথিনকূপ, কুদুমগুহা, নেচার পার্ক, নাফ নদীর জালিয়াদ্বীপ, মিয়ানমার সীমান্ত, প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন, ডুলাহাজারা সাফারি পার্ক, রামুর বৌদ্ধপল্লী, মহেশখালীর আদিনাথ মন্দিরসহ বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ভ্রমণে যান।
এদিকে পর্যটকদের সার্বিক নিরাপত্তা দিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর রয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা পুলিশ সুপার এ কে এম ড.ইকবাল হোসেন। তিনি বলেন, পর্যটকদের নিরাপত্তা দিতে শহর ও সমুদ্র সৈকতে পর্যাপ্ত পুলিশ সদস্য মোতায়েন রয়েছে। পুলিশের পাশাপাশি র্যাবও কাজ করছে। আমরা পর্যটকদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিতে সব সময় প্রস্তুত রয়েছি।
কক্সবাজার ট্যুরিস্ট পুলিশের পুলিশ সুপার মোঃ জিল্লুর রহমান বলেন,গত কয়েক দিনের ছুটিতে অন্তত কয়েক লাখ পর্যটক কক্সবাজার ভ্রমণে আসবেন এমনটা ধরে নিয়েই কঠোর নিরাপত্তাবলয় তৈরি করা হয়েছে। যেকোনো মূল্যে কক্সবাজারকে পর্যটকদের জন্য নিরাপদ রাখার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন তাঁরা। তবে জনসাধারণকে আমি অনুরোধ করবো আপনারা রাত ১২টা থেকে ১২টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত সমুদ্র সৈকত এলাকায় থাকতে পারবেন, তারপর আর কাউকে সমুদ্র সৈকতে থাকতে দেয়া হবে না। যে কোন ধরণের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে আমরা এই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছি।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আলী হোসেন জানান,পর্যটকদের নিরাপত্তার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। কক্সবাজারে এসে পর্যটকরা যাতে বিড়ম্বনার শিকার না হন এবং হোটেল রেষ্টুরেন্টগুলো অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করতে না পারে সেজন্য বেশ কয়েকজন ম্যাজিষ্ট্রেটের নেতৃত্বে বিশেষ টিমও গঠন করা হয়েছে। তারা টহলে থেকে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করবেন।তাছাড়া শহরের হোটেল-মোটেল রেস্তোঁরা ও যানবাহনসহ রিকশায় অতিরিক্ত ব্যবস্থা রোধে মূল্য তালিকা টাঙ্গিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
Posted ১১:০২ অপরাহ্ণ | রবিবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta