কক্সবাংলা রিপোর্ট(৮ সেপ্টেম্বর) :: কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করা ইয়াবা সহ মাদকের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুদ্ধ ঘোষণার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নড়েচড়ে বসেছিল। এরপর সারাদেশের মতো কক্সবাজারেও মাদকবিরোধী অভিযানে বেশ কয়েকজন মাদক ব্যবসায়ী ধরা পড়ে এবং ৮ জনের মতো বন্দুকযুদ্ধে মারাও যায়। এসময় বেশিরভাগ শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী আত্মগোপনে চলে যায়। এতে টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে ইয়াবা পাচার কমে আসে। কিন্তু সম্প্রতি মাদকবিরোধী অভিযান কিছুটা শিথিল হয়ে পড়ায় আত্মগোপনে থাকা ব্যবসায়ীরা আবারও এলাকায় ফিরেছে। তাদের নির্দেশ ও তত্ত্বাবধানে ফের টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে দেশে মাদক প্রবেশের পরিমাণ বেড়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে,টেকনাফ সীমান্তে বিজিবি,র্যাব,পুলিশ,কোস্টগার্ড সহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সতর্ক অবস্থানের পরও প্রতিদিন কোনো না কোনো পয়েন্ট থেকে ইয়াবাসহ পাচারকারী বা পরিত্যক্ত ইয়াবা উদ্ধার হচ্ছেই। এভাবেই প্রতিনিয়ত ইয়াবা ব্যবসায়ীরা কৌশলে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা চালান নাফ নদী ও সমুদ্র পথে বাংলাদেশে নিয়ে আসছে।
আর চলমান মাদক বিরোধী অভিযানে টেকনাফ সীমান্তে জুলাই মাসে ইয়াবার চালান তুলনামূলক হারে কমে আসলেও আগস্টে কিছুটা বেড়ে য়ায়। কিন্তু চলতি সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে হঠাৎ করে বৃহৎ আকারের পরিত্যক্ত চালান আটকের ঘটনায় আবারো নতুন করে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়েছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ,টেকনাফ সীমান্তে ইয়াবাসহ মাদকবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত থাকলেও এ পর্যন্ত বড় কোনো ইয়াবা কারবারি আটকের খবরও পাওয়া যায়নি। সীমান্তের ইয়াবা গডফাদাররা রয়েছে বহাল তবিয়তেই। অথচ টেকনাফ বাংলাদেশের ‘ইয়াবার গেটওয়ে’ হিসেবে পরিচিত। মিয়ানমারের প্রায় ৪০টি ইয়াবা কারখানায় উৎপাদিত ইয়াবার চালান আসে একমাত্র টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি),কোস্টগার্ড,র্যাব,পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের দেওয়া তথ্যমতে, গত জুলাই-আগস্ট মাসে টেকনাফ বিজিবি (৬+২১) ২৭ কোটি টাকা ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ৩ কোটি টাকা। এছাড়া কোস্টগার্ড গত ৮ মাসে প্রায় ৮৫ লাখ ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদকদ্রব্যের চালান জব্দ করেছে।একই সময়ে আলাদা আলাদাভাবে পুলিশ র্যাবও গত তিন মাসে বেশ কিছু ইয়াবার চালান জব্দ করেছে। তবে টেকনাফ দিয়ে ইয়াবাসহ অন্য মাদকদ্রব্যের পাচাররোধে তাদের পাঁচটি নতুন ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে।এসময় আটক করা হয়েছে শতাধিক পাচারকারীকে।
এদিকে সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বিজিবি-র্যাব এর পৃথক অভিযানে প্রায় ৩০ কোটি টাকার ইয়াবা উদ্ধার করেছে। এসময় আটক করা হয় ৬ পাচারকারীকে। এরমধ্যে ৮ সেপ্টেম্বর শনিবার টেকনাফে বিজিবি’র পৃথক অভিযানে উদ্ধার করা হয়েছে ২৭ কোটি টাকার ৯ লাখ ইয়াবা।
বিজিবি সূত্র জানায়, মিয়ানমার থেকে ইয়াবার বড় চালান কক্সবাজারে টেকনাফে নিয়ে অাসা হয়েছে এমন গোপন সংবাদের খবর পেয়ে শনিবার ভোরে টেকনাফ ২ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. আছাদুদ-জামান চৌধুরীরর নেতৃত্বে বিজিবির একটি দল টেকনাফের নাজিরপাড়া আড়িয়াখাল এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে। এসময় ৮ লাখ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। তবে পাচারকারিরা পালিয়ে যায়।
একই দিন টেকনাফের সাবরাংয়ের হাড়িয়াখালী লমন মাঠে বিজিবির অারেকটি দল অভিযান চালিয়ে ১ লাখ ইয়াবা উদ্ধার করে। তবে এই দু’ অভিযানে কাউকে অাটক করতে পারেনি বিজিবি।
অপরদিকে র্যাব সূত্র জানায়,৬ সেপ্টেম্বর র্যাব-৭ কক্সবাজার সদরের লিংকরোড ও উখিয়ার চোয়ানখালী মেরিনড্রাইভ সড়কে পৃথক অভিযান চালিয়ে প্রায় ২কোটি টাকার ৩৮ হাজার ৫৭০ ইয়াবা সহ ৬জন মাদক ব্যবসায়ীকে আটক করে। ৬ সেপ্টেম্বর দুপুরে ও ৫ সেপ্টেম্বর রাতে পৃথক এ অভিযান চালানো হয়।
র্যাব-৭ কক্সবাজার ক্যাম্পের কোম্পানী কমান্ডার মেজর মোঃ মেহেদী হাসান জানান, ৬ সেপ্টেম্বর দুপুরে কক্সবাজার সদরের লিংকরোড থেকে ১৮ হাজার ৭৭০টি ইয়াবা সহ ৩ জন মাদক ব্যবসায়ী মো: তৌহিদ (২২), মো: সাদ্দাম (২০), মো: ফরিদুল ইসলাম (২৫) কে আটক করা হয়।
একই দিন অপর অভিযানে সকাল সাড়ে ১০টারদিকে টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কে র্যাব সদস্যরা অভিযান চালিয়ে ইয়াবাসহ অবসরপ্রাপ্ত ডাক্তার ও আইসিটি বিশেষজ্ঞ পরিচয়ী দুই মাদক কারবারীকে আটক করে।
টেকনাফ বাহারছড়া ক্যাম্পের কমান্ডার মেজর আনিসুজ্জামানের নেতৃত্বে মেরিন ড্রাইভ সড়কে বিশেষ চেকপোস্ট স্থাপন করে যাত্রীবাহী একটি সিএনজি তল্লাশী চালিয়ে ৯ হাজার ৮শ পিস নোয়াখারী জেলার বেগমগঞ্জ থানার লাকড়িয়া কান্দির বাসিন্দা বর্তমানে ঢাকা ডিএমপি মিরপুর-২, মনিপুর-৬৩৪ এর বসবাসরত মোঃ আব্দুল গণির পুত্র অবসরপ্রাপ্ত ডাঃ মেরাজ উদ্দিন (৩০) ও নরসিংদী জেলার রায়পুর থানার কড়ইপুরের বাসিন্দা মৃত ধন মিয়া ওরফে ফারুক মিয়ার পুত্র আইসিটি বিশেষজ্ঞ মোক্তার হোসেন (৩৬) কে আটক করে।
এর পুর্বে বুধবার দিবাগত রাতে উখিয়ার কোর্ট বাজার থেকে ১০ হাজার ইয়াবা সহ আজম মোল্লা (৪২) কে আটক করা হয়। ইয়াবা সহ আটক মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রন আইনে মামলা দায়ের করে কক্সবাজার সদর ও উখিয়া থানায় সোপর্দ করা হয়।
সীমান্তের লোকজন জানান, ইয়াবা গডফাদাররা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য আপাতত গা ঢাকা দিলেও চুনোপুঁটিরা ভয়ে দুবাই এবং সৌদি আরব পাড়ি দিতে বর্তমানে অবস্থান করছে চট্রগ্রাম সহ রাজধানী ঢাকায়। তাই টেকনাফ সীমান্ত এলাকার পরিস্থিতিতে এবার একেবারে ভিন্ন রূপ। ইয়াবাবিরোধী অভিযান চললেও সীমান্তের ইয়াবা গডফাদারদের মধ্যে কোনো ভীতি নেই। তাদের বেশির ভাগ ঘর-বাড়িতে না থাকলেও এলাকা ছেড়ে যায়নি। গডফাদাররা এমন পরিস্থিতিকে স্বাভাবিকভাবে নেওয়ায় এলাকাবাসীর মধ্যে নানা গুঞ্জন চলছে। আর চলমান মাদক বিরোধী অভিযানে যেখানে মানুষ প্রাণ বাঁচাতে বন-জঙ্গলে পালিয়ে বেড়াচ্ছে সেই পরিস্থিতির মধ্যেও সীমান্তে বৃহৎ আকারের মাদকের পরিত্যক্ত চালান উদ্ধারের ঘটনায় আবারো নতুন করে অজানা আতংক দেখা দিয়েছে।
এ ব্যাপারে কক্সবাজারের দায়িত্বপ্রাপ্ত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অদিফতরের সহকারী পরিচালক সৌমেন মণ্ডল জানান,সীমান্তে কোনো মূল্যে ইয়াবাসহ সব ধরনের মাদকের চোরাচালান বন্ধে কঠোর হচ্ছে সরকার। ইয়াবা পাচারকারীদের গ্রেপ্তারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সবসময় অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে।এখন ইয়াবা ও মাদকদ্রব্য পাচাররোধে শক্তভাবে নামতে হবে এবং সামাজিকভাবে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সে চেষ্টাই চলছে। যে কোনও উপায়ে মাদক পাচার বন্ধ ও পাচারকারীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।’
টেকনাফ ২ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. আছাদুদ-জামান চৌধুরী বলেন,ইয়াবা ঠেকাতে সীমান্তে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
উল্লেখ্য সম্প্রতি সরবারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ৬০ জন গডফাদারসহ ১১৫১ জন মাদক কারবারির তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। এর মধ্যে টেকনাফ সীমান্তেই রয়েছে ৯ শতাধিক ইয়াবা কারবারি।
Posted ৩:৪৬ অপরাহ্ণ | শনিবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta