ঐক্যে আগ্রহী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা বলছেন, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট আবারও ক্ষমতায় আসতে ‘মরিয়া’। আর এই ‘বেপরোয়া’ অবস্থানকে সমঝোতাভিত্তিক করতে পারে কেবল বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্য। গত আড়াই মাসে ক্ষমতাসীনদের দৃশ্যমান অবস্থাকে ‘স্বৈরতান্ত্রিক’ হিসেবেই দেখছেন এসব রাজনৈতিক দলের নেতারা। এ কারণেই নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করতে সর্বদলীয় ঐক্যের বিকল্প দেখছে না রাজনৈতিক দলগুলো।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্যের মত, অন্তত ১৬টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা চলছে প্রায় দেড় বছরের বেশি সময় ধরে। দলগুলো হচ্ছে, বিকল্প ধারা, গণফোরাম, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, নাগরিক ঐক্য, জেএসডি। এছাড়া বাম-গণতান্ত্রিক ধারার ৩টি দল, ধর্মভিত্তিক ঘরানার ৩টি দল ও নিবন্ধিত অন্তত ৫টি ছোট দলের মধ্যে আলোচনা হয়ে আছে।
এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘আমরা মনে করি, আলোচনা শুরু হয়েছে। কিছু দফাও দিয়েছি, যে দফাগুলোকে কেন্দ্র করে একটি ঐক্য গড়ে উঠবে। প্রথম হচ্ছে, সুষ্ঠু নির্বাচন। জবাবদিহিতামূলক শাসনব্যবস্থা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে কেন্দ্র করে সবাই যদি সম্মত হয়, সে প্রক্রিয়া গঠন করা যেতে পারে।’
বিএনপির সূত্রগুলো বলছে, গত বুধবার (২৯ মার্চ) ও বৃহস্পতিবার বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঐক্যসংক্রান্ত বিষয়ে আলাপ করতেই খালেদা জিয়ার সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়েছিলেন। যদিও দুই বারই ‘অসুস্থতার কারণে’ ওই সাক্ষাৎ আর হয়নি।
জানা গেছে, খালেদা জিয়ার সম্মতি ছাড়া বৃহত্তর ঐক্যের জন্য চূড়ান্ত সিন্ধান্ত নিতে পারছে না বিএনপি। বর্তমানে দলটি পরিচালিত হচ্ছে নেতৃত্বের তিনটি উইং থেকে। এগুলো হচ্ছে, কারাবন্দি চেয়ারপারসন, লন্ডনে থাকা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও মহাসচিবসহ স্থায়ী কমিটির সক্রিয় ৮-৯ জন সদস্য। বর্তমান নেতৃত্বের এই তিনটি স্তর থেকে যেকোনও বিষয়ে সিদ্ধান্ত বেরিয়ে আসা যেখানে কঠিন, সেখানে জাতীয় ঐক্যের চূড়ান্ত রূপ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়াটি আরও একটু জটিল।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আমাদের আন্দোলনের প্রধানতম ইস্যু আমাদের নেত্রীকে কত দ্রুত মুক্ত করতে পারি। এ লক্ষ্যে আইনি ও রাজপথে রাজনৈতিক লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। তবে খালেদা জিয়ার মুক্তির ওপর নির্ভর করছে নির্বাচন, জাতীয় ঐক্য।’
স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার বলেন, ‘জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হবে। সবাই এক্যবদ্ধ হবে। এটাই বড় কথা।’
দলের স্থায়ী কমিটির আরেকজন সদস্যের ভাষ্য, ‘সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐক্য হবে, তবে আসন ছাড় দিতে হবে বিএনপিকে। এক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার সিদ্ধান্ত জানা জরুরি। তবে জামিন বিলম্বিত হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটিই ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেবে। এক্ষেত্রে একটু সময় লাগবে।’
২০ দলীয় জোটের শরিক ও বিজেপির চেয়ারম্যান আন্দালিভ রহমান পার্থ বলেন, ‘সবকিছুর আগে জোটনেত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তি, এরপরই আমরা বাকি বিষয়গুলোকে নিয়ে সামনে এগুবো। জাতীয় ঐক্যের কথা খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান বলেছেন। আর জাতীয় একটি ঐক্য ইতোমধ্যেই গড়ে উঠেছে। সবাই সবার জায়গা থেকে একই সুরে কথা বলছি, শুধু একই সুতোয় গাঁথাটা বাকি আছে।’
রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা বলছেন, বৃহত্তর ঐক্যের কোনও সাংগঠনিক রূপরেখা বা এ নিয়ে আলোচনা এখনও হয়নি। তবে গত ৮ জানুয়ারি খালেদা জিয়া গ্রেফতার, হাইকোর্টে জামিন ও পরে সুপ্রিম কোর্টে জামিন স্থগিতের ঘটনায় ঐক্য নিয়ে নতুন করে ভাবতে হয়েছে দলগুলোকে। তবে তারা ‘নির্বাচন ও গণতন্ত্রের’ স্বার্থে বৃহত্তর ঐক্যের পক্ষে।
ঐক্য গড়তে রাজি রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা বলছেন, ঐক্য প্রতিষ্ঠিত করার আগে প্রথম শর্ত হচ্ছে, বিএনপিকে আগে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে। গণতন্ত্র, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, রাজনৈতিক দলগুলোর সহাবস্থান নিশ্চিত, আগামী নির্বাচনে আসনভিত্তিক সমঝোতা, নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার স্থায়ী সমাধান, নির্বাচন কমিশন শক্তিশালীকরণ ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোয় ন্যূনতম প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা বজায় রাখার সংকল্প থাকলেই কেবল ‘জোটভিত্তিক বা যূথবদ্ধ’ আন্দোলনে তাদের পাশে পাবে বিএনপি।
চারদলীয় যুক্তফ্রন্টের সমন্বয়ক ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘স্বৈরতন্ত্রের থাবা যেভাবে সর্বগ্রাসী হচ্ছে, এর বিরুদ্ধে একটা সর্বব্যাপক গণতান্ত্রিক ও জাতীয় ঐক্য গড়ে ওঠা উচিত। এর মানে গণতন্ত্র একদিনের বিষয় নয়, গণতন্ত্র যেন সর্বসাধারণের জন্য কল্যাণকর হয়, সে ব্যাপারে বিএনপিকে আরও ইতিবাচক কথা বলতে হবে।’ সময়ের সঙ্গে জাতীয় ঐক্য ইতিবাচক বলেও তিনি মনে করেন।
একটি শরিক দলের নাম উদ্ধৃত হতে অনিচ্ছুক একজন নেতা বলেন, ‘শুধু ক্ষমতায় যাওয়া বা খালেদা জিয়ার মুক্তি নিশ্চিত হলেই তো গণতন্ত্র ঠিক হয়ে যায় না।’
নাম প্রকাশ অনিচ্ছুক যুক্তফ্রন্টের একজন নেতা বলেন, ‘আমরা চেয়েছিলাম, একটি তৃতীয় ধারার রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তুলতে। কিন্তু দুই-আড়াই মাসে সরকারের স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ এত স্পষ্ট যে, তারা যেকোনও উপায়ে ক্ষমতায় আসতে চাইছে। এই জোটের এখনও সাংগঠনিক রূপ দেওয়া হয়নি।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে ঐক্য গড়ে উঠবে কিনা, এটা আগাম বলার কিছু নেই। কারণ আগাম বললে, অন্য ঘটনা ঘটে যায়। অনুমান করে বলতে চাই না।’ তিনি বলেন, ‘আমরা যে প্রস্তাবগুলো রেখেছি, এগুলোর মধ্য দিয়ে একটা সমন্বয় তো করাই যায়।’
ঐক্যের দৃশমান পরিণতি বিলম্বিত হচ্ছে কিনা, এমন প্রশ্নে বিএনপি-জোটের আন্দালিভ রহমান পার্থের ভাষ্য, ‘এটা একটা প্রসেসের ব্যাপার। অনেকের সঙ্গে অনেকের কথা হচ্ছে। কিন্তু বিষয় হচ্ছে, অনেকে এখন যদি আসে, তাহলে তাদের ওপর একটা মামলা-হামলা ঘটে যেতে পারে। অনেক কিছু হতে পারে। সারা বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে একই সুরে কথা বলছে।’
বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক সূত্রের ভাষ্য, এই বৃহত্তর ঐক্যের বিষয়টি এখন খালেদা জিয়ার হাতে। তিনি সব দলকে একসঙ্গে নিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে আন্দোলন গড়ে তুলতে বিএনপি নেতাদের পরামর্শ দেবেন কিনা, তার ওপর নির্ভর করছে সম্ভাব্য সর্বদলীয় যুক্তফ্রন্ট বা ঐক্যজোটের ভবিষ্যৎ।
দলটির সিনিয়র নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ভাষ্য, ‘নিরপেক্ষ-নির্দলীয় ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি, সংসদ ভেঙে দেওয়াসহ এসব ইস্যুতে যারা সমর্থন করছেন, তারা শান্তিপূর্ণ যুগপৎভাবে আন্দোলন করছেন। এটা আরও অগ্রসর হলে স্পষ্ট হবে, ঐক্য কী ধরনের হবে।’
জাতীয় ঐক্যের আলোচনার সূচনা হয়েছিল ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানে জঙ্গি হামলার পর। খালেদা জিয়া ৩ জুলাই সব দলের উদ্দেশে জাতীয় ঐক্যের ডাক দেন। যদিও তখন জামায়াত-প্রশ্নে ঐক্যের প্রক্রিয়াটি থেমে যায়।
ভবিষ্যতে ঐক্যের পথে জামায়াত বাধা হবে কিনা—এমন প্রশ্নে জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, ‘আগামী নির্বাচনকে সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ করতে ও গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে জাতীয় ঐক্যে জামায়াত বাধা হবে না।’