কক্সবাংলা ডটকম(১৩ ফেব্রুয়ারি) :: নানা পণ্যের জন্য চীনের ওপর নির্ভরশীল বাংলাদেশ। তাই দেশটিতে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের প্রভাব দেশের অর্থনীতিতেও পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। করোনাভাইরাস দেশের ভোক্তাদের উপরও চাপ ফেলতে শুরু করে দিয়েছে। কারণ খাদ্যপণ্য সহ ভোক্তার ব্যবহার্য অনেক পণ্য আসে চীন থেকে।
কিন্তু দেশটিতে নতুন এই ভাইরাস আক্রমণের পর তাদের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য হুমকির মুখে পড়েছে। ফলে চাহিদা অনুযায়ী চীন থেকে পণ্য আনা যাচ্ছে না। কিছু পণ্য এলেও সময় লাগছে অনেক। এই সুযোগ নিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা আদা, রসুন, পেঁয়াজ থেকে শুরু করে তৈরি পোশাক, মেশিনারি পণ্য ও ইলেক্ট্রনিক্স পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই এ সব পণ্য কিনতে ভোক্তার বাড়তি ব্যয় হচ্ছে।
বাংলাদেশে মেশিনারিজ, কাপড়, কেমিক্যালসহ পোশাক খাতের অনেক কাঁচামাল আসে চীন থেকে। দেশটিতে নতুন বছরের ছুটি ও করোনাভাইরাসের কারণে এসব পণ্যের আমদানির পরিমাণ অনেক কমে গেছে। এতে দেশীয় কারখানাগুলোতে উৎপাদনে ব্যাহত হচ্ছে।
উদ্যোক্তারা বলছেন, এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে রফতানি খাতে বড় ধরনের ধাক্কার শঙ্কা আছে। এ পরিস্থিতিতে সরকার বিকল্প বাজারের সন্ধান করছে। এজন্য ব্যবসায়িক সংগঠনগুলোর কাছে প্রস্তাব চাওয়া হয়েছে। এগুলো নিয়ে খুব শিগগিরই ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর সঙ্গে বৈঠকে বসার প্রক্রিয়াও চলছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্র জানায়, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে চীন থেকে পণ্য আমদানি হয় ৬ লাখ ৭২ হাজার ৯৫২ টন।
যা গত বছরের একই সময় (২০১৯ সালের জানুয়ারি মাস) আমদানি হয় ৮ লাখ ৫১ হাজার ২৫৫ টন। দেখা যায় গত বছরের একই সময়ের তুলনায় আমদানি কম হয়েছে এক লাখ ৭৮ হাজার ৩০৩ টন। এছাড়া চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের ৮ তারিখ পর্যন্ত চীন থেকে পণ্য আমদানি হয়েছে এক লাখ ৩৭ হাজার ৫৭৯ টন।
গত বছরের একই সময় আমদানি হয় ২ লাখ ১৯ হাজার ১৪৯ টন। সেক্ষেত্রে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় আমদানি কম হয় ৮১ হাজার ৫৭০ টন।
পাশাপাশি করোনাভাইরাস-সংকটে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে চীনা অর্থায়নে ১ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকার ১২টি প্রকল্প। অবকাঠামো, টেলিযোগাযোগ, প্রযুক্তি, বিদ্যুৎ-জ্বালানি ও রেলপথ খাতের এসব মেগা প্রকল্পে সরাসরি অর্থায়ন করেছে চীন। ঋণের শর্ত মোতাবেক এসব প্রকল্পের ঠিকাদারি, জনবল নিয়োগ ও প্রয়োজনীয় মালামাল চীনই দেবে। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে এসব প্রকল্পের জনবল ঘাটতিসহ প্রয়োজনীয় মালামাল আটকে গেছে। ফলে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
অন্যদিকে মাতারবাড়ী ও পদ্মা সেতুসহ বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্পে ঠিকাদার হিসেবে কাজ করছে চীনা কোম্পানি। এসব প্রকল্পে অনেক চীনা কর্মী গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত রয়েছেন। এ হিসাবে চীন সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের সংখ্যা আরও বাড়বে। প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনাভাইরাসের সমস্যা শিগগিরই সমাধান না হলে নির্দিষ্ট সময়ে প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ হবে না। ফলে বাড়বে প্রকল্প ব্যয়। এছাড়া চীনের ঋণ পরিশোধের সময়সহ অন্যান্য পাওনা পরিশোধমুক্ত সময় (গ্রেস পিরিয়ড) কম ও সুদের হার তুলনামূলক বেশি। ফলে উন্নয়নে বড় ক্ষতি মুখে পড়তে যাচ্ছে দেশ।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘ সময় থেকে বাংলাদেশে বিভিন্ন খাতে ঋণ ও অনুদান দিয়ে সহায়তা করে আসছে চীন। এর মধ্যে অবকাঠামো নির্মাণ, টেলিযোগাযোগ, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি, শিল্প, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, পরিবহন, রেলপথ, কৃষি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে তাদের প্রকল্প চলমান রয়েছে। প্রকল্পগুলোতে অর্থায়নে অনেক শর্ত জুড়ে দিয়েছে চীন। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ২ শতাংশ সুদহার, যা সার্ভিস চার্জসহ পরিশোধ করতে হবে ২ দশমিক ৪৫ শতাংশ। প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা ফি ধরা হয়েছে দশমিক ২ শতাংশ এবং প্রতিশ্রুতি ফি দশমিক ২৫ শতাংশ। ঋণ পরিশোধের সময় দেওয়া হয়েছে ২০ বছর (৫ বছর গ্রেস পিরিয়ডসহ)। এছাড়া চুক্তি কার্যকর হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে ব্যবস্থাপনা ফি পুরোটা পরিশোধ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এ সুদ ও শর্ত বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও জাপানের উন্নয়ন সংস্থার (জাইকা) চেয়ে অনেক কঠিন।
এদিকে চীনের করোনা ভাইরাসের কারণে ক্রয়াদেশ দেওয়া পণ্য যথাসময়ে পাওয়া নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে বাংলাদেশি পণ্যের বিদেশি ক্রেতাদের মধ্যে। বিশেষত সম্প্রতি ক্রয়াদেশ দেওয়া পণ্য যথাসময়ে ক্রেতার কাছে পৌঁছাতে পারবে কি না, এ বিষয়ে তারা নিশ্চিত হতে চাইছেন।
এদিকে চীন থেকে আমদানিনির্ভর কাঁচামাল, এক্সেসরিজ ও কেমিক্যালের মজুত ফুরিয়ে আসায় বিকল্প খুঁজছেন এখানকার উদ্যোক্তারা। তারা আশঙ্কা করছেন, এর ফলে বাড়তি দামে সেসব কিনতে হবে। আবার একই মানের পণ্য পাওয়া যাবে কি না, কিংবা সময়মতো সেসব পাওয়া নিয়েও সংশয় রয়েছে।একই ইস্যুতে ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য আন্তর্জাতিক পণ্য প্রদর্শনী একের পর এক স্থগিত হয়ে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, দু-একটি প্রদর্শনী হলেও সেগুলোতে চীনের নাগরিকেরা থাকছেন না। অথচ বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হওয়া আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীগুলোতে চীনের প্রতিষ্ঠান ও তাদের নাগরিকদের অনেকেই অংশগ্রহণ করত। এসব কারণে প্রদর্শনীর আয়োজনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে বড়ো অঙ্কের লোকসান গুনতে হচ্ছে। অন্যদিকে ব্যবসায়েও তা নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। নারায়ণগঞ্জের এমবি নিট ফ্যাশন্স ইউরোপ ও আমেরিকার কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের পোশাক তৈরি করে থাকে। প্রতিষ্ঠানটিকে ক্রয়াদেশ দেওয়া পণ্য যথাসময়ে পাওয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন বিদেশি ক্রেতারা।
প্রতিষ্ঠানের মালিক মোহাম্মদ হাতেম বলেন, তাদের পণ্য যথা সময়ে দিতে পারব কি না, এ বিষয়ে তারা আমাদের কাছে জানতে চাইছে। চীনের চান্দ্রমাসের দীর্ঘ ছুটি শেষ হওয়ার পর বেশ কয়েকটি রাজ্যে এ ছুটি দুই দফায় বাড়ানো হয়েছে। কোথাও কোথায় এটি আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। ফলে আমাদের বায়াররা পণ্য জাহাজীকরণে দেরি হবে কি না, তা জানতে চাইছে।
তিনি বলেন, ইতিমধ্যে চীনে ছুটি বাড়ানোয় সেখান থেকে বিভিন্ন পণ্য বাংলাদেশে আসতে দেরি হবে। এক্ষেত্রে বিদেশি ক্রেতারা ছাড় না দিলে আমাদের বড়ো অঙ্কের আর্থিক লোকসান গুনতে হবে। আবার মাস শেষে শ্রমিকের মজুরির অর্থ পরিশোধও কঠিন হবে অনেকের জন্য।
বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের কাঁচামাল, এক্সেসরিজ ও কেমিক্যালের বড়ো অংশই চীন থেকে আমদানি করতে হয়। ওভেন পোশাকের কাপড়ের প্রায় ৬০ শতাংশ আর গার্মেন্টসে ব্যবহার হওয়া এক্সেসরিজ, ডায়িং ওয়াশিংসহ কেমিক্যালের উল্লেখযোগ্য অংশ আসে চীন থেকে। চীন ইতিমধ্যে ছুটির সময়সীমা বাড়িয়েছে। আবার কিছু ক্ষেত্রে জাহাজীকরণ হলেও পুরোদমে হচ্ছে না।
বাংলাদেশ থেকে একক ব্র্যান্ড হিসেবে সবচেয়ে বেশি গার্মেন্টস পণ্য আমদানি করে সুইডেনভিত্তিক এইচঅ্যান্ডএম। এই প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশ অফিসের প্রধান জিয়াউর রহমান বলেন, এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি সহনীয়। তবে করোনা ভাইরাসের ইস্যুটি আরো দুই-তিন মাস দীর্ঘায়িত হলে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যে বিপর্যয় ঘটতে পারে। এইচঅ্যান্ডএম গত বছর বাংলাদেশ থেকে সাড়ে তিন শ কোটি (সাড়ে তিন বিলিয়ন) ডলার মূল্যের গার্মেন্টস পণ্য ক্রয় করেছে। বাংলাদেশের রপ্তানির ৮৪ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। তবে চলতি অর্থবছরে গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানি কমতির দিকে। করোনা ভাইরাস ইস্যুতে রপ্তানিতে প্রভাব পড়লে তা নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করবে।
সর্বশেষ চীনের হুবেই প্রদেশে প্রাণঘাতী নভেল করোনাভাইরাস সৃষ্ট রোগ ‘কভিড-১৯’ বৃহস্পতিবার একদিনেই কেড়ে নিয়েছে ২৪২টি প্রাণ। লাগামহীনভাবে বাড়ছে মৃতের ও আক্রন্তের সংখ্যা। এটি এখন পর্যন্ত রেকর্ড সংখ্যক মৃত্যু। এ নিয়ে বিশ্বব্যাপী মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৩৬৩ জনে।চীনের মূল ভূখণ্ডেই মৃত্যুর সংখ্যা কমপক্ষে ১৩৬১ জন।
Posted ১১:৩২ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta