কক্সবাংলা ডটকম(১৫ ফেব্রুয়ারি) :: করোনাভাইরাসে চিনে মৃতের সংখ্যা ইতিমধ্যে ১৫৩৩ জনে দাঁড়িয়েছে। সংক্রামিত রোগীর সংখ্যা ৬৬ হাজার ৪৯২ জন ছাড়িয়েছে। বিবিসি রিপোর্টে বলা হয়েছে, মৃতের তালিকা হংকং, ফিলিপাইন্সের নাগরিকরাও রয়েছেন। প্রতিদিন বাড়ছে নভেলা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মৃতের সংখ্যা। তবে কিছুটা হলেও আশার খবর শোনাচ্ছে সে দেশের হাসপাতালগুলি। স্থানীয় প্রশাসন জানাচ্ছে, এই ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের অনেকেই সুস্থ হয়ে বাড়িও ফিরছেন।
চিন থেকে ইতিমধ্যে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। এমন পরিস্থিতিতে একমাসেই চিনের অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব পড়েছে।
স্থানীয় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে, একেবারে তলানিতে পৌঁছে গিয়েছে চিনের অর্থনীতি। বলা হচ্ছে, ৩০ বছরের ইতিহাসে সবথেকে তলানিতে দেশের অর্থনীতি। যা চিনের অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা। জানা গিয়েছে, গত চার বছরের মধ্যে চিনের সংস্থাগুলিতে হঠাত করেই কমে গিয়েছে লাভের পরিমাণ। ভাইরাসের আতঙ্কে বাইরের বিভিন্ন সংস্থাও চিনে থাকা অফিসগুলির ঝাঁপ বন্ধ করে দিয়েছে। সমস্ত কর্মীদের ফিরিয়ে আনছে সেখান থেকে। কমিউনিস্ট চিনের শেয়ার বাজারেও বড় পতন লক্ষ্য করা গিয়েছে।
অর্থনীতির কারবারিরা বলছেন, গত একমাসে শুধুমাত্র করোনাভাইরাসের জন্যে ৪২০ বিলিয়ন ডলার যা টাকার মূল্যে ৪০ লক্ষ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। যা চিনের জন্যে যথেষ্ট মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কীভাবে বিশাল এই ক্ষতি মোকাবিলা করা যায় তা রীতিমত চ্যালেঞ্জের কমিউনিস্টদের কাছে।
প্যানথিয়ন ইন লন্ডনের এশিয়াবিষয়ক প্রধান অর্থনীতিবিদ ফ্রেয়া বেয়ামিশ বলেন, ভাইরাসের সংক্রমণ ও সংবরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে চীনের যে কী পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হবে, সে বিষয়ে কেউই কিছু স্পষ্ট করে বলতে পারছে না। পরিসংখ্যানের অস্পষ্টতার কারণে আমরা সম্ভবত এ বিষয়ে নিশ্চিতও হতে পারব না। তবে আমরা ধারণা করছি, প্রথম প্রান্তিকে দেশটির প্রকৃত জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২ শতাংশেরও নিচে নেমে আসবে। তাছাড়া চতুর্থ প্রান্তিকে চীনের প্রকৃত জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৪ শতাংশ, সরকারিভাবে পূর্বাভাসকৃত ৬ শতাংশের অনেক কম।
তিনি আরো বলেন, এখন পর্যন্ত উৎপাদন খাতে যে ক্ষতি হয়েছে তা হয়তো বছরের অবশিষ্ট সময়ে পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা হবে। কিন্তু সেবা খাতে যে ক্ষতি হয়ে গেছে, তা আর পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে না। কারণ ভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত ভোক্তারা যেসব সেবা গ্রহণ করেননি বা করতে পারেননি, তা তারা আগামীতে বাড়িয়ে গ্রহণ করবেন না।
মূলত চান্দ্র নববর্ষের সময় থেকেই চীনের হুবেই প্রদেশের উহানসহ কয়েক ডজন শহর ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া রোধে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়, বন্ধ করে দেয়া হয় যোগাযোগ। এর পর থেকেই এসব শহরের বাসিন্দারা জনসমাগম এড়িয়ে চলছে। এমনকি তারা ঘর থেকেও বের হতে পারছে না। কিন্তু তার পরও চীনা সরকার নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া রোধে হিমশিম খাচ্ছে। ফলে দেশটির সার্বিক ব্যবসা-বাণিজ্য দীর্ঘদিন ধরে থমকে আছে। ব্যাপক মন্দার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে নববর্ষের পুরো ছুটির মৌসুম।
এ পরিস্থিতিতে কর্তৃপক্ষ ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে ব্যর্থ হলে চীনের অর্থনৈতিক পরিণতি কী হবে জানতে চাইলে রয়টার্সের জরিপে অংশ নেয়া চীনা অর্থনীতিবিদরা উত্তর দিতে রাজি হননি। তবে বেইজিংয়ের ব্যাংক অব চায়না ইন্টারন্যাশনালের সামষ্টিক অর্থনীতির জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক বিংনান ইয়ে বলেন, আমার মনে হয় আগামী এপ্রিল নাগাদ ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসবে। যদিও প্রথম প্রান্তিকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ২-৩ শতাংশে নেমে আসবে, পুরো বছরে যা গিয়ে দাঁড়াবে ৫ শতাংশে।
হংকংয়ের আইএনজির বৃহত্তর চায়নাবিষয়ক অর্থনীতিবিদ আরিস প্যাং বলেন, আমরা দ্রুত অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবন আশা করছি না। ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়ানো রোধের পরও চীনা অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়াতে অন্তত চারটি প্রান্তিক লাগবে।
বিবিসি জানিয়েছে, করোনাভাইরাসে এখনও পর্যন্ত ১৫৩৩ জনেরও বেশি মৃত্যু হয়েছে। এছাড়াও এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ৬৬ হাজার ৪৯২ জন ছাড়িয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি চিনে। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে জাপান।
চিন মৃত্যুপুরী। ডিসেম্বরে চিনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। এরপর চিন সহ প্রায় ২৭টির বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এই ভাইরাস। বিশ্ব জুড়ে সতর্কতা জারি করেছে হু। হু জানিয়েছে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা এবং প্রাণহানি আরও বাড়বে বলেই আশঙ্কা। এদিকে চিনের স্থল সীমান্ত সংলগ্ন ১৪টি দেশে করোনাভাইরাস সতর্কতা প্রবল।
চিনের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে ভারতের। আবার ভারতেরই প্রতিবেশি পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, মায়ানমারের সঙ্গেও চিনের সীমান্ত।নেপাল, ভারতে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীর সন্ধান পাওয়ায় দুটি দেশেই জারি বিশেষ সতর্কতা। যদিও পাকিস্তান সরকার তাদের নাগরিকদের চিন থেকে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে গড়িমসি করায় বিতর্ক প্রবল। আর বাংলাদেশ সরকার চিন থেকে আসা সব বাংলাদেশীদের কড়া পরীক্ষা করার কাজ চালাচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, মন্দঋণের সীমা বাড়ানোর ফলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে যে প্রভাব পড়বে তা আমরা সামলে নিতে পারবো। কারণ চীনের মন্দঋণের অনুপাত তুলনামূলক কম। একই সংবাদ সম্মেলনে চায়না ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স রেগুলেটরি কশিনের ভাইস চেয়ারম্যান লিয়াং তাও বলেন, প্রধান বিনিয়োগ প্রকল্পগুলোতে ঋণ প্রদান ও অর্থ ছাড়ে গতি আনা হবে।
অপরদিকে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় নিয়ন্ত্রণ সংস্থার উপপ্রধান সুয়ান চাংনেং সাংবাদিকদের বলেছেন, বৈদেশিক বাণিজ্যের সামান্য উদ্বৃত্ত সামাল দেয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক দায়দেনার মৌলিক ভারসাম্য রক্ষা করা যাবে।
আজ শনিবার চীনের স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানিয়েছে, মেইনল্যান্ডে ২ হাজার ৬০০ জনেরও বেশি নতুন করে ভাইরাস আক্রান্ত হয়েছে। সারা বিশ্বে এ ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বর্তমানে ৬৩ হাজার ৮৫২ জন। এর বেশিরভাগই চীনে। এ মহামারীতে এরই মধ্যে মারা গেছেন ১ হাজার ৪০০ জন। গতকাল শুক্রবার নববর্ষের ছুটি শেষে ঘরে ফেরা বেইজিংবাসীদের ১৪ দিন স্বেচ্ছা বিচ্ছিন্ন থাকার নির্দেশ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত সংবাদ সংস্থাতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে সরকারি থিঙ্কট্যাঙ্কের অন্তত দুজন অর্থনীতিবিদ বলেছেন, করোনাভাইরাসের কারণে চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এ বছর ১ শতাংশীয় পয়েন্ট কমে যেতে পারে। যেখানে ভাইরাস সংক্রমণের আগে থেকেই দেশটির অর্থনীতিতে মন্দা চলছে। গত বছর চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ১ শতাংশ, ১৯৯০ সালের পর এটিই সবচেয়ে ধীর প্রবৃদ্ধি।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, চীনের ঋণের বোঝা করোনাভাইরাস মহামারী পরবর্তী অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার সামর্থ্যকে দুর্বল করে দিতে পারে।
সূত্র: আল জাজিরা