কক্সবাংলা ডটকম(১৯ এপ্রিল) :: বিশ্ব বাণিজ্য বলয়ে যুক্তরাষ্ট্র-চীন ঠাণ্ডা লড়াইয়ের কারণে বাংলাদেশের সামনে বড় কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ আসছে। ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিক নীতি বাস্তবায়নে বাংলাদেশকে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে পাশে পেতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের সামনে যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রত্যাশা বড় কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে।
কূটনৈতিক সূত্র জানায়, ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিক নীতি বাস্তবায়নে এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের বড় মিত্র এখন ভারত। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি বাস্তবায়নে ভারতের দিক থেকেও বাংলাদেশের প্রতি প্রচ্ছন্ন চাপ রয়েছে।
অন্যদিকে এ মুহূর্তে চীন বাংলাদেশের অন্যতম বড় উন্নয়ন অংশীদার। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সক্রিয়ভাবে অংশ নিলে চীনের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েন হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশকে গভীরভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং নিজেদের স্বার্থসংশ্নিষ্ট বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিয়ে বাস্তবতার নিরিখে দক্ষ কূটনৈতিক কৌশল নিতে হবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানাচ্ছে, বাংলাদেশ এ চ্যালেঞ্জের ক্ষেত্রে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নির্দেশিত পররাষ্ট্রনীতি ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’ নীতিতেই এগিয়ে যাবে।
গত মার্চ মাসে ঢাকা সফরে এসে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্র সরকারের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক উপ-সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিসা কার্টিস যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিক নীতি বাস্তবায়নে বাংলাদেশের সক্রিয় সহযোগিতা প্রত্যাশা কামনা করেন। এরপর দুই দেশের মধ্যে গত এক মাসে একাধিক কূটনৈতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে প্রতিবারই যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রসঙ্গটি মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ভারতের পক্ষ থেকেও এ ব্যাপারে বাংলাদেশের মনোভাব নানাভাবে জানতে চাওয়া হয়েছে। ফলে বিষয়টি এক ধরনের কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে সামনে চলে এসেছে।
সূত্র জানায়, বিশ্ববাণিজ্যে চীনের সঙ্গে ঠাণ্ডা লড়াই মোকাবেলার কৌশলগত উপায় হিসেবেই মূলত এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করেছে। এ নীতিতে এ অঞ্চলের দেশগুলোতে সুশাসন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, বঞ্চিত জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং নিরাপত্তা-সংক্রান্ত
সহযোগিতার কথা বলা হলেও এর নেপথ্যে রয়েছে নতুন বাণিজ্যিক বলয় সৃষ্টির উদ্দেশ্য। সাইবার নিরাপত্তা এবং প্রযুক্তিগত বাণিজ্যনীতির ক্ষেত্রে গত এক বছরে যুক্তরাষ্ট্রে বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে।
এ নীতি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা এবং প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপারে রক্ষণশীল নীতি নিয়েছে। এতে চীনা প্রযুক্তি পণ্য উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোর দূরত্ব ক্রমশ দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে।
বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে পরিবর্তিত নীতি বাস্তবায়নের কৌশল থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিক নীতি নিয়েছে। এ নীতি বাস্তবায়নে যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশের মতো বিকাশমান অর্থনীতির দেশগুলোর প্রতি।
চীনের সঙ্গে দীর্ঘ স্নায়বিক টানাপড়েনের কারণে এক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সহজ সহযোগিতার সমঝোতাও হয়েছে শুরু থেকেই। আর স্পষ্টতই চীন এ ব্যাপারে বতর্মানে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। চীন তার নিজস্ব কৌশলে যুক্তরাষ্ট্রের এ বাণিজ্যিক কূটনৈতিক কৌশলকে মোকাবেলা করতে চাইছে। এক্ষেত্রে চীনের কৌশল হচ্ছে বাংলাদেশের মতো দ্রুত পরিবর্তনশীল অর্থনীতির দেশকে বেশি করে ঋণ সহায়তার জালে আবদ্ধ করে ফেলা।
এদিকে, বাংলাদেশের স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার হিসেবে এ মুহূর্তে ভারতের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। তবে পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থনও দরকার বাংলাদেশের। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অর্থনৈতিক অগ্রগতিসহ অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগিতার প্রয়োজনে এই সমর্থন প্রয়োজন।
এ মুহূর্তে বাংলাদেশের বড় বাণিজ্যিক সম্পর্ক আবার চীনের সঙ্গে। একইসঙ্গে একাধিক মেগা প্রকল্পে ঋণ দিচ্ছে চীন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চীনের কঠিন শর্ত মেনে নিয়েই এ দেশকে ঋণচুক্তি করতে হয়েছে। ফলে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রয়োজনে চীনকেও বিশেষ গুরুত্ব দিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।
সাম্প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গা সংকট ঘিরে আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক কূটনীতিও বাংলাদেশের সামনে চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। এটা স্পষ্ট যে রোহিঙ্গা সংকটে চীনের অবস্থান ঘুরেফিরে মিয়ানমারের পক্ষেই রয়েছে।
ফলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করাসহ এ সংকটের স্থায়ী সমাধানের জন্য বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি বাস্তবায়নের নীতির অংশীদার হওয়ার বিষয়টিও গুরুত্বহীন নয়।
এ ব্যাপারে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ওয়ালিউর রহমান বলেন, অনেকবারই বাংলাদেশের সামনে এ ধরনের কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ এসেছে, যা মোকাবেলায় ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’ বঙ্গবন্ধু নির্দেশিত এ নীতিই সবচেয়ে কার্যকর।
তিনি বলেন, ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি ঘিরে যে কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ সামনে এসেছে তা অপেক্ষাকৃত জটিল। অবশ্যই এ মুহূর্তে বাংলাদেশকে বিষয়টি গভীরভাবে নজরে রাখতে হবে এবং অপেক্ষা করতে হবে। ‘ওয়েট অ্যান্ড সি ফর টেকিং দ্য বেস্ট পলিসি’ এটাই হওয়া উচিত এখনকার কৌশলগত অবস্থান।
তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ওয়ারশ প্যাক্ট এবং ন্যাটো কোনোটিতে যোগ না দিয়ে সে সময় রোমানিয়া বিশ্ব কূটনীতিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। এ উদাহরণও এ মুহূর্তে বাংলাদেশের জন্য ভালো উদাহরণ।
সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং কূটনীতি বিশ্নেষক হুমায়ুন কবীর বলেন, বাংলাদেশের সামনে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বিভিন্ন মাত্রায় সমান গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে সবার সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষার কৌশলটিই নিতে হবে। এ মুহূর্তে কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নৈতিক অবস্থানের পাশাপাশি বাস্তব অবস্থা এবং দেশের নিজস্ব স্বার্থসংশ্নিষ্ট বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে দক্ষ কূটনৈতিক কৌশল নিতে হবে।
তিনি বলেন, সমধর্মী অন্যান্য দেশ কীভাবে এ ধরনের কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে সেটাও পর্যবেক্ষণ করতে হবে। সবার উপরে দেশের স্বার্থরক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।
Posted ১:৫০ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৯ এপ্রিল ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta