সরকার যদি একপক্ষীয়ভাবে নির্বাচনের আয়োজন করে তাও প্রত্যাখ্যান করবে দলটি। নির্বাচন প্রতিহত করার ডাক দিয়ে মাঠে নামবে। সে নির্বাচন হতে দেবে না। আন্দোলন যে পর্যায়ে পৌঁছালে নির্বাচন প্রতিহত করা যায় সে পর্যায়ে নিয়ে যেতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাবে বিএনপি।
আর সরকার যদি বিএনপি সঙ্গে আলোচনায় রাজি হয়, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন মেনে নেয় এবং খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে চলমান মামলা স্থগিত রাখে তাহলে কোনো আন্দোলনে যাবে না বিএনপি। বরং আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। নিরপেক্ষ নির্বাচনে জনগণ ভোট দিয়ে যে ফলাফল দেবে তাই মেনে নেবে বিএনপি। এতে যদি আওয়ামী লীগের ক্ষমতার ধারাবাহিকতা বজায় থাকে তাতেও আপত্তি থাকবে না দলটির।
এ জন্য দলটির মধ্যে ইতোমধ্যেই ব্যাপক প্রস্তুতি চলছে। ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলসহ অঙ্গ সংগঠনগুলোকে প্রস্তুত করা হচ্ছে আন্দোলনের জন্য। বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসনেও কাজ চলছে। নেতায় নেতায় বিরোধ মেটাতে খোদ খালেদা জিয়া হস্তক্ষেপ করছেন। নেতাদের ডেকে আলাদাভাবে কথা বলছেন। দলের ঐক্য নষ্ট হয় এমন তৎপরতা থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দিচ্ছেন।
দলের নিষ্ক্রিয় নেতাদের সক্রিয় হওয়া এবং দলের বাইরে থাকাদের দলীয় কাঠামোতে আনতে যোগাযোগ চলছে। এ জন্য দ্রুতই দলের স্থায়ী কমিটির ৪ শূন্য পদ, নির্বাহী কমিটির ছাত্র ও সহছাত্রবিষয়ক সম্পাদক, ২ জন আন্তর্জাতিক সম্পাদক, ২ জন বিশেষ সম্পাদকের নিয়োগ প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত। বর্তমান কমিটির পরিধি আরো বাড়ানো হচ্ছে। এতে স্থান দেয়া হচ্ছে কমিটির বাইরে থাকা যোগ্য নেতাদের।
নিজের জেলে যাওয়ার প্রস্তুতিও রয়েছে খালেদা জিয়ার। মানসিকভাবে তিনি প্রস্তুতি সেরে ফেলেছেন। এ জন্য দলের মধ্যম ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাদের ওপর তিনি ভরসা রাখছেন বেশি। প্রায়ই এসব নেতাকে একান্তে ডেকে কথা বলেন। তিনি বলেন, তোমাদের ওপর আমার ভরসা বেশি। আমাকে জেলে যেতে হলে তোমাদেরই দলের জন্য কাজ করতে হবে।
সক্রিয় করা হচ্ছে ২০ দলীয় জোটকে। সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে জোট নেতাদেরও। সরকারের কোনো ফাঁদে পা দিয়ে জোটে ভাঙন ধরানোর প্রক্রিয়ায় না জড়াতে অনুরোধ করা হয়েছে। জোটের পরিধি বাড়ানোর জন্য কয়েকটি দলের সঙ্গে আলোচনা চলছে। এরা যোগ দিলে জোটের নামেও পরিবর্তন আসতে পারে। পাশাপাশি জোটের সমমনা দল বা সরকারবিরোধী জোটের সঙ্গে চলছে আলোচনা। যারা হবেন আন্দোলন ও নির্বাচনী মিত্র।
বিএনপি নেতাদের মতে, আগামীতে একটি ফলপ্রসূ নির্বাচন চায় বিএনপি। যাতে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে। কিন্তু সরকারের মতিগতি তেমন নয়। সরকার যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় থেকে যেতে চায়। সরকারের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে চায়। এ জন্য খালেদা জিয়াসহ বিএনপির কয়েক সিনিয়র নেতাকে টার্গেট করে নির্বাচনের বাইরে রাখতে চায়। যাতে বিএনপিতে হাতাশা ও অনৈক্য তৈরি হয়। ২০১৪ সালের মতো বিএনপি আবারো নির্বাচন বর্জনের পথে হাঁটে।
বিষয়টি আঁচ করতে পেরেই দল ও জোটের বন্ধন অটুট রাখতে অব্যাহত প্রচেষ্টা চলছে বিএনপি হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে। সরকারের আচরণ ও আদালতের তৎপরতা সম্পর্কে নিয়মিত অবগত করানো হচ্ছে দেশের উন্নয়ন সহযোগীদের। ঢাকায় নিযুক্ত এসব দেশের রাষ্ট্রদূত ও আবাসিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করা হচ্ছে।
বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থন করে দেয়া বক্তব্য ও মামলার নথিপত্রও সরবরাহ করা হচ্ছে। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে চলমান মামলা মিথ্যা, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য এ মামলা দায়ের করা হয়েছে- এটা বোঝানোর জন্য লবিং চলছে।
পাশাপাশি সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় ভূমিকা রাখতে উদ্যোগ নেয়ারও আহ্বান জানানো হচ্ছে রাষ্ট্রদূতদের। বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, বিএনপির সঙ্গে সরকার কোনো সমঝোতায় আসতে চায় না। সরকার নানা কৌশলে বিএনপি ভাঙার চেষ্টা করছে। পাশাপাশি দলের বাইরে থাকা নেতাদের দিয়ে আলাদা বিএনপি দাঁড় করানোর উসকানি দিচ্ছে। ইতোমধ্যে এসব নেতা রাজধানীর একটি হোটেলে বৈঠক করেছেন। বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলে এসব নেতা জিয়ার আদর্শের বিএনপি নামে একটি দল গঠন করে সরকারের সঙ্গে ৩০০ আসনেই নির্বাচনে যাবে।
সব প্রতিক‚লতা মোকাবেলা করে যদি খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি নির্বাচনে যায় তবে ধানের শীষের প্রার্থীকে পরাজিত করতে এসব প্রার্থীকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করানো হবে, যা বিএনপির জন্য বিব্রতকর ও আগামী নির্বাচনে দলটিকে জটিল পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়ার ষড়যন্ত্রের অংশ বলেই মনে করে বিএনপি।
অন্যদিকে ২০ দলীয় জোটে ভাঙন ধরানোর প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। এমন নালিশও করা হচ্ছে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে।
সরকারের সব কৌশলকে টেক্কা দিতে মামলার রায় হওয়ার আগেই জনগণের কাছে পৌঁছতে চান খালেদা জিয়া। প্রথমে তিনি সব বিভাগীয় শহরে জনসভা ও গণসংযোগে যাবেন। এরপর বড় জেলাগুলোতে সফর শুরু করবেন। আগামী ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের পর থেকেই এ সফর শুরু হচ্ছে বলে দলের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। দলীয় নেতাকর্মী, সমর্থক ও ভোটারদের চাঙ্গা রাখতে এবং আন্দোলন ও নির্বাচনমুখী করতেই তার এ সফর বলে দলীয় সূত্রের দাবি।
বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ও খালেদা জিয়ার আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, মামলার কার্যক্রমের গতিপ্রবাহ দেখে মনে হচ্ছে সরকার একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নতুন করে কোনো ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে।
নির্বাচন নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমরা স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। সব রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। খালেদা জিয়াকে সপ্তাহে সপ্তাহে হাজিরা দিতে হবে, আমাদের সব নেতাকর্মীকে হাজিরা দিতে হবে- এভাবে নির্বাচন হবে না। লেভেল প্লেইং ফিল্ড এখন থেকেই করতে হবে। বর্তমান সংসদ ভেঙে দিতে হবে। সত্যিকার অর্থে একটি ফলপ্রসূ ও একটা কার্যকরী নির্বাচন দিতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনে আনতে হবে।
ফখরুল বলেন, সরকার জগদ্দল পাথরের মতো ক্ষমতায় বসে রয়েছে। এই জগদ্দল পাথরকে আমরা যদি সরাতে না পারি, আমরা একটা ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হব। স্বাভাবিক সাধারণ পদ্ধতিতে আমরা এই পাথর সরাতে পারব তা মনে হয় না। একে সরাতে হলে লোহার হাতুড়ি লাগবে। জোর করে তাদের সরাতে হবে, এমনিতে যাবে না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে সমঝোতা না হলে রাস্তায় ফয়সালা হবে। তিনি বলেন, আমরা একাদশ জাতীয় নির্বাচন করব। আমাদের নেত্রী উপযুক্ত সময়ে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের রূপরেখা দেবেন। এরপরে আমরা সরকারের আচরণ দেখব, সরকার সে রূপরেখায় আসে কিনা- সেটা দেখে প্রয়োজনে আমরা জনগণের কাছে যাব। আমরা বিশ্বাস করি, জনগণের অধিকার জনগণই রাস্তায় নেমে প্রতিষ্ঠা করবে। আমরা জনগণের সঙ্গে থাকব। জনগণ তাদের ভোটের অধিকারের দাবি আদায় করেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করবে।
তিনি বলেন, ২০১৪ সালে সরকার জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করে নির্বাচন করেছেন। তারপরেও তারা সাহস করছেন আরেকবার প্রতারণা করতে। যারা মনে করেন, আগের মতো জনগণকে প্রতারিত করে, নানা রকম ছলচাতুরি করে, বিদেশিদের ভুল বুঝিয়ে আরেকবার ক্ষমতায় আসবেন, এটা আর জনগণ হতে দেবে না।
তিনি বলেন, মানুষের জোয়ার শুরু হয়েছে। এই জোয়ারকে বাস-ট্রাক আর লঞ্চ বন্ধ করে ঠেকানো যাবে না। এই জনজোয়ারকে আমাদের নেতৃত্ব দিয়ে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে।