স্বপন চক্রবর্ত্তী
নিউইয়র্ক,যুক্তরাষ্ট্র থেকে(৩০ মে) :: কোথা থেকে কেমন করে যে কী সব হয়ে যায়, বোঝার আগেই, জানার আগেই কত কী যে ঘটে যায়, কত কথাই থাকে অজানা, কত কিছুই এড়িয়ে যায় চোখের দৃষ্টি, কত কী-ই যে হারিয়ে যায় জীবনের অলক্ষ্যে । সময় হারিয়ে যাচ্ছে খুউব দ্রুত, তবু মনে হয় এইতো সেইদিন । দেশের প্রতি এমন গভীর ভালোবাসা মনে হয়, বিদেশে না এলে টেরই পেতাম না ।
ছাত্র জীবনে মা’কে ছেড়ে, বাবাকে, ভাই বোনকে ছেড়ে শহরে যখন পড়তে এসেছি, প্রথম প্রথম কোন খাবারই তো গলা দিয়ে নামতো না । এতই বিস্বাদ সবই । মায়ের হাতের রান্নার কী তুলনা হয় ! ঘুম হতো না – এক্কেবারেই । সকালে উঠতে হবে – ভার্সিটি যেতে হবে, কাজে যেতে হবে, তবু ঘুম যে আসেই না ।। ঘুম না হওয়ার সেই যে বাতিক চেপে বসলো, তা’ আর এই জীবনে ছেড়ে গেলো না ।
সেই কবে এসেছিলাম সাত সমুদ্দুর তেরো নদী পার হয়ে, বুকের ভেতর সেই আমার প্রিয় স্বদেশ বয়ে বয়ে বেড়াই আজো । কত ব্যস্ততার জীবন এই প্রবাসে । তবুও কোন অবকাশের ক্ষীণ মুহুর্তে – দেশের খবরে চোখ বুলিয়ে যাই । কত খবরে বুক ফুলে ওঠে গর্বে, আবার এমন কিছু খবরে মন ভরে যায় বিষন্নতায় । সে বিষন্নতা জেগে থাকে – দিনের, রাতের প্রহর পেরিয়েও; – এক অনাদিকালের পথে চলতে চলতেই যেনো জীবনের এই বিষাদমাখা সময়টুকু বড্ড সত্য হয়ে দেখা দেয় ।
ক’দিন আগে আমার বাল্যবন্ধু গিয়াস দেশ থেকে ফিরে এসে বললো, আমাদের আরেক বাল্যবন্ধু দীপক বড়ুয়া আমাদের ছেড়ে গেছে । বুকের ভেতর এমন যন্ত্রণা শুরু হলো যে, সারারাত আর দু’চোখের পাতা এক হলো না । কত স্মৃতি আমাদের সেই বাল্যজীবনে, কত মধুর দিনের কথকতা ! দীপকের বাবা মা আমাকে তাঁদের সন্তানের মতই ভালোবাসতেন, দীপকের বড়ো বোন মুকুল দি’র কথা মনে পড়ে । আমার কাছে মুকুল দি’ ছিলো আমারও বড়ো দিদি । কত বেলা যে দুপুরের খাবার দীপকের সাথে মাসির হাতে খেয়েছি তার কোন ইয়ত্তা নেই । আইনজীবী পেশায় এসে প্রথম যখন দীপকের বাবা মাকে প্রণাম করতে যাই, দু’জনের সে কী আনন্দ । আমার মাথায় মুখে স্নেহের অমিয় পরশ বুলিয়ে কতো আশীর্ব্বাদ করেছেন, মনে পড়লে আজো মনটা আদ্র হয়ে আসে । শৈশবের সেই স্মৃতির ঢেউ দমকে দমকে এসে চোখের কোল ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে নিজেরই অজান্তে । গাঢ় স্বরে মনে মনে বলি, ‘কী এমন তাড়া ছিলো বন্ধু তোর, এমন করে যাবার; ভালো থাকিস যেখানেই গেছিস – ভালো থাকিস !!
কাল সকালেই এমনই বিষাদ জাগানো আরেকটা খবরে গভীর দুঃখে মনটা ভরে গেলো । আমাদের অতি প্রিয় আশীষ দা’ আর নেই । স্বনামধন্য কবি, গীতিকার, লেখক আশীষ বড়ুয়া; আমরা আশীষ দা’ ডাকি । আমাদের চেয়ে তিন চার বছরের বড়ো হবেন। স্পষ্ট মনে আছে আমার, আমরা যখন ষষ্ট শ্রেণীতে আমাদের প্রিয় খিজারী স্কুলে ভর্তি হই, তখন আশীষ দা’ রা অষ্টম শ্রেণীতে । সারা স্কুলে কী দাপট তখন আশীষ দা’ দের সেই জমজমাট দলটির । সারা স্কুল মাতিয়ে রাখতেন । এতো ভালো কবিতা লিখতেন, এতো ভাল লিখতে পারতেন যে, সবার কাছেই তখনই তিনি কবি নামে পরিচিত । এমন মেধাবী মানুষটি শহরমুখী হলে যে সারা দেশে অনেক সুনাম অর্জন করতে পারতেন, তা’তে কোন সন্দেহ নেই । এমন ভালো লেখার হাত ছিলো যে, যে কোন বিষয় নিয়েই তিনি অনবদ্য লিখতে পারতেন । এই কিছু বছরে কত প্রিয় মানুষ হারিয়ে গেলো । দীপক নেই, আশীষ দা নেই, ছালেহ ভাই নেই ।
আমার জীবনে যে মানুষটির অসীম অবদান, আমার পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক, আমার পিতৃসম ব্যক্তিত্ত্ব মনোমোহন স্যার চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে। আমি তাঁর বড়ছেলে ছিলাম, তাঁর ছেলে মেয়েরা আমাকে আজো তাদের বড়ো ভাইয়ের আসনে রেখেছে, যদিও আমি বড়ভাইয়ের কোন কর্তব্যই আজো করতে পারিনি । আমি যে স্যারকে আর দেখতে পাবো না এ’কথা মনে হলেই বুকের ভেতর এক তীব্র বেদনার স্রোত টের পাই ।
আর নেই আমার বাবার কিছু ঘনিষ্ট বন্ধু, মফজল চাচা, হেডম্যান আলী চাচা । যাদের আশিস আমার জীবনের অনেক বড়ো পাথেয় হয়ে আছে । মনে পড়ে, আইনজীবী হিসাবে চট্টগ্রাম বার-এ যোগদানের ক’দিন পরেই দেখি, কোর্টের দ্বিতীয় তলার বারান্দায় উৎকর্ণ হয়ে হেডম্যান আলী চাচা কাউকে খুঁজছেন । আমি কাছে গিয়ে সালাম দিতেই, বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘আঁই তোঁয়ারে চাইত আসসি যে অবাজী, আঁর পোয়া উকিল অয়ে, আঁর যে কী আনন্দ আজিয়া’ !! ( আমি তোমাকে দেখতে আসছি বাবাজী, আমার ছেলে উকিল হয়েছে, আমার যে কী আনন্দ আজ) । উনি এসেছেন ৯০ মাইল দূরত্বের বাঁধ ভেঙে সারাদিন বাসে চড়ে শুধু আমাকে দেখতে, উকিলের পোশাকে আমাকে দেখে চোখ জুড়াবেন বলে । এমন স্নেহের, এমন ভালোবাসার কী মূল্য দেবার ক্ষমতা আমার আছে ! সেই হেডম্যান আলী চাচা নেই । শুনে আমার নব্বই বছর বয়সী বাবার ভাঙাচোরা মুখের কোণে গাঢ় বেদনার ছায়া দেখতে পেলাম, দেখতে পেলাম, জলের ধারা চোখের কোলে । বাবাকে শুধু আলতো জড়িয়ে ধরলাম, কিছু বলার নেই, এই প্রগাঢ় বেদনা লাঘবের ভাষা আমার জানা নেই ।
বন্ধু দীপক, ছালেহ ভাই, আশীষ দা, মফজল চাচা, হেডম্যান আলী চাচা, আমার শ্রদ্ধেয় মনোমোহন স্যার, অধ্যাপক দীপক দা’, সবার প্রিয় শিক্ষক মনোহরী দা’, কক্সবাজার বারের এডভোকেট শাহাবুদ্দিন ভাই,সরোয়ার ভাই, খুরশিদ ভাই এঁদের কাউকে আর দেখতে পাবো না সশরীরে ! কিন্তু, তাঁরা সবাই জীবন্ত হয়ে আছেন আমার মনের পাতায়, থাকবেন- যতদিন এই শরীর বেঁচে থাকে ।
লেখক : স্বপন চক্রবর্ত্তী,নিউইয়র্ক,যুক্তরাষ্ট্র থেকে (কক্সবাজারের রামু প্রবাসী)
Posted ৪:২৯ অপরাহ্ণ | শনিবার, ৩০ মে ২০২০
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta