কক্সবংলা ডটকম(১৮ জানুয়ারি) :: এখন আমনের ভরা মৌসুম। এ মৌসুমে চালের দাম কেজিতে ৩ থেকে ৪ টাকা কমে যাওয়ার কথা। কিন্তু না কমে উল্টো কয়েক দিনেই চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ৫ থেকে ৬ টাকা। তা হলে এ চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে কে?
এ প্রশ্নের জবাবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খাদ্য অধিদফতরের এক কর্মকর্তা জানান, এ মৌসুমে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে দেশের ৪৬টি অটো মিলের মালিকরা। ধানের দাম বেড়ে যাওয়ার অজুহাতে তারা দাম বাড়িয়েছে। তবে এর পেছনে আরও যারা রয়েছেন তারা হলেন-মৌসুমি ব্যবসায়ী, মিলার আড়তদার, পাইকার ও অনলাইন কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। তিনি জানান, এদের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে অভিযান শুরু হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, পাইকারি থেকে শুরু করে একেবারে খুচরা পর্যায়ে চালের পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে। এরপরও দাম বাড়ানো হয়েছে প্রতি কেজি ৫ থেকে ৬ টাকা। খুচরা ও পাইকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবার আমন ধানের রেকর্ড উৎপাদন হয়েছে। দাম বৃদ্ধির কোনো কারণ নেই। তাদের সবার সন্দেহের আঙুল সিন্ডিকেটের দিকে। কারণ দেশে মোট যে পরিমাণ চাল উৎপাদন হয় তার ৪০ শতাংশ হচ্ছে আমন মৌসুমে।
ভোটের পর হঠাৎ করেই বেড়েছে চালের দাম। যদিও এখন বাজারে চালের কোনো সংকট নেই। মাসখানেক আগে বাজারে আমন ধান আসায় এখন চালের দাম কমার কথা। কিন্তু বাজারের চিত্র পুরোই উল্টো। ১০ দিনের ব্যবধানে খুচরা বাজারে প্রতি কেজিতে ৪ থেকে ৫ টাকা বেড়েছে চালের দাম। হঠাৎ এমন দাম বাড়ানোয় মিলারদের কারসাজিকে দায়ী করছেন খুচরা বিক্রেতারা।
এই দায় অস্বীকার করে মিলাররা বলছেন, বাজারে ধানের সরবরাহ কমে গেছে, সেই সঙ্গে বেড়েছে দাম। এ ছাড়া আবহাওয়ার কারণেও চালের দাম বাড়ছে বলেও দাবি করেন তারা। খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার অবশ্য মজুতদারির দিকেই ইঙ্গিত করেছেন। তিনি বলেছেন, যারা ধান স্টক করছে তাদের ছাড় দেয়া হবে না।
হঠাৎ করেই চালের দাম বাড়তে থাকায় বাজার নিয়ন্ত্রণে চারটি তদারকি দল মাঠে নামায় খাদ্য মন্ত্রণালয়।
তারা বিভিন্ন এলাকায় ওএমএসের ট্রাক ও দোকানে পরিদর্শনের পাশাপাশি বাজারও পরিদর্শন করে। গতকাল বাবু বাজার, কাওরান বাজার, মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট ও নিউ মার্কেটে তারা তদারকি করে।
তবে এসব বাজারে কোনো চালের দাম বৃদ্ধিতে কোনো অনিয়ম দেখা যায়নি উল্লেখ করে তদারকিতে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা জানান, খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতাদের কাছে চালের কোনো মজুত পাওয়া যায়নি। তাদের ক্রয়কৃত মূল্য ও বিক্রয়মূল্য তালিকা স্পষ্ট করে উল্লেখ করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
চালের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে খুচরা বিক্রেতারা মিলারদের কারসাজির কথা উল্লেখ করেছেন বলেও জানান তদারকের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা। খুচরা বাজারে এখন ভালো মানের সরু চাল বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৭২ টাকায়। তবে কিছু সরু চাল ৬৬ থেকে ৬৮ টাকায়ও পাওয়া যাচ্ছে। নাজির বা কাটারি নাজির নামে বিক্রি হওয়া চালের দাম ৭৮ থেকে ৮৫ টাকা পর্যন্ত।
১০ দিনের ব্যবধানে এসব চাল কেজিতে ৪ থেকে ৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। মাঝারি আকারে চালের দাম বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৫৪ থেকে ৫৬ টাকা কেজি দরে। আর মোটা চাল ১-২ টাকা বাড়িয়ে বিক্রি করা হচ্ছে ৫০ থেকে ৫২ টাকা।
রাজধানীর বাসাবো বাজারের নিউ নুরানী রাইস এজেন্সির মালিক রফিকুল ইসলাম বলেন, নির্বাচনের সুযোগ নিয়ে দাম বাড়ানো হয়েছে। নির্বাচনের পর থেকেই বাজারে বাড়তি দাম আছে। ফোরকান স্টোরের স্বত্বাধিকার ফোরকান বলেন, পাইকারি বাজারেই আমাদের ভালো মানের মিনিকেট চাল কিনতে হয় ৬৮ থেকে ৭০ টাকা দিয়ে। সেটা ৭০ থেকে ৭২ টাকার কম বিক্রি করা যায় না। অন্য চালের দামও আগের চেয়ে বেশি।
ভরা মওসুমেও চালের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে মিলাররা বলছেন, ধানের মওসুম হলেও বড় বড় মিল মালিক ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো ধান কিনে মজুত করে রেখেছেন। এতে বাজারে সরবরাহ কম হওয়ায় বৃদ্ধি পেয়েছে ধানের দাম। তাই চালের দামও বেড়েছে। তাছাড়া বর্তমান আবহাওয়ার কারণে সূর্যের তাপ না থাকায় চাতাল মালিকরা চাল শুকাতে পারছেন না। এজন্যও দাম বাড়তে পারে।
বগুড়ার মেসার্স রবিউল অটো রাইস মিলের স্বত্বাধিকারী রবিউল ইসলাম বলেন, দেশের বৃহত্তর রাইস মিল মালিকরা আমন ধান বাজারে নামার সঙ্গে সঙ্গে শত শত ট্রাক ধান বাজার থেকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে। ফলে বাজারে ধানের সংকট দেখা দিয়েছে।
এ ছাড়াও অবৈধ মজুতদাররাও ধান মজুতের মাধ্যমে বাজারে ধানের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেছে। বর্তমানে ১২০০ টাকার ধান ১৩৫০ থেকে ১৩৭০ টাকা পর্যন্ত দরে কিনতে হচ্ছে। এর ফলে বাজারে চালের দামও বৃদ্ধি পেয়েছে।
বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলা চাল কল মালিক সমিতির সভাপতি আমিনুল ইসলাম বলেন, আবহাওয়া খারাপ থাকার কারণে চাতাল মালিকরা ধান শুকাতে পারছে না, এর ফলে বাজারে চাল সরবরাহ কম হচ্ছে। এজন্য চালের দাম কিছুটা বৃদ্ধির পেয়েছে।
কুষ্টিয়ার খাজানগরের সুবর্ণ এগ্রো ফুডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর আরাফাত মামুন বলেন, আমাদের ধান বেশি দামে কিনতে হচ্ছে, ধানের আড়তদাররা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। ধানের দাম না বাড়লে চালের দামও বাড়তো না।
বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতি কুষ্টিয়া শাখার সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন প্রধান বলেন, ধানের দাম প্রতি মণে ১৮০ থেকে ২০০ টাকা বেড়েছে। মণপ্রতি মিনিকেট যে ধান আগে ছিল ১ হাজার ৪২০ টাকা সেই ধান এখন কিনতে হচ্ছে ১ হাজার ৬৮০ টাকায়। মিলাররা বেশি দামে ধান কিনছেন তাই চালের দামও বাড়তি।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি আমন মৌসুমে চালের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা র্নিধারণ করা হয় ১ কোটি ৭১ লাখ ৭৮ হাজার টন। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চালের উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৭০ লাখ ৯৩ হাজার টন। বরিশালে লক্ষ্যমাত্রার ২৫ ভাগ ধান-চাল সংগ্রহ হয়নি। তবে বিভিন্ন কারণে প্রায় ৪০ হাজার হেক্টর জমির ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে চলতি অর্থবছরে টিসিবিতে চাল দেওয়ার কর্মসূচি যুক্ত করা হয়েছে। এর ফলে অনেক কম দামে চাল পাচ্ছে স্বল্প আয়ের মানুষ।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে যে পরিমাণ চাল বিতরণ করা হয়েছে তা অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি। এখন পর্যন্ত বিদেশ থেকে চাল আমদানি করা হয়নি। তবে গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে প্রায় ১০ লাখ ৫৬ হাজার টন চাল আমদানি করা হয়। বর্তমানে প্রায় ১৪ লাখ টনের বেশি চাল মজুদ রয়েছে।
এদিকে অবৈধ আড়তদারদের উদ্দেশ্যে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেছেন, যারা হাজার-হাজার মণ ধান আড়তদারির নাম করে বিনা লাইসেন্সে স্টক করছে, তাদের ছাড় দেয়ার কোনো উপায় নেই। আপনি মিল মালিক হয়েও যদি আপনার কাছে ধান মজুত থাকে তাহলে আপনাকেও ছাড় দেয়ার কোনো উপায় নেই। আমার বাবা হলেও উপায় নেই। খাদ্য অধিদপ্তরের সম্মেলন কক্ষে ধান-চালের বাজার ঊর্ধ্বগতি রোধ করতে মতবিনিময় সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
ইতিমধ্যে বাজার মনিটরিংয়ের জন্য টিম করা হয়েছে জানিয়ে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, কন্ট্রোল রুম খুলেছি, আমাদের অভিযান চলছে। আজ দেশের ৮টি বিভাগে সকাল সাড়ে ১১টা থেকে অভিযান পরিচালনা করা হবে। এরইমধ্যে অভিযান চলছে। অভিযানে যার কাছে অবৈধ মজুত পাওয়া যাবে তাকে আইনের আওতায় আনা হবে।
সুলভ মূল্যে পণ্য বিক্রির কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে টিসিবি। নতুন বছরে নতুন করে নির্ধারিত কার্ডধারীদের মধ্যে টিসিবির পণ্য বিক্রির এই কার্যক্রম আগামীকাল বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হবে।
এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে টিসিবি এ তথ্য জানিয়েছে। বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বৃহস্পতিবার মোহাম্মদপুর তাজমহল রোডে এ কার্যক্রম উদ্বোধন করবেন বলে জানা গেছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সার্বিক নির্দেশনায় নিম্নআয়ের এক কোটি উপকারভোগী কার্ডধারী পরিবারের মধ্যে ভর্তুকিমূল্যে টিসিবির পণ্য যেমন- চাল, ভোজ্যতেল ও ডাল বিক্রয় কার্যক্রম চলমান। জানুয়ারি মাসে দেশব্যাপী এক কোটি ফ্যামিলি কার্ডধারী নিম্নআয়ের পরিবারের মধ্যে ভর্তুকিমূল্যে সয়াবিন তেল বা রাইসব্রান অয়েল, মসুর ডাল ও চাল বিক্রি করা হবে।
নির্দেশনা অনুযায়ী জানুয়ারি মাসে একজন ফ্যামিলি কার্ডধারী ৬০ টাকা কেজি দরে সর্বোচ্চ ২ কেজি মসুর ডাল, ৩০ টাকা কেজি দরে ৫ কেজি চাল ও ১০০ টাকা দরে ২ লিটার সয়াবিন তেল বা রাইসব্রান অয়েল কিনতে পারবেন।
এদিকে গত ডিসেম্বরে প্রাপ্যতা সাপেক্ষে দেশের কয়েকটি স্থানে চিনি ও পেঁয়াজ বিক্রি করলেও চলতি মাসে সেটি বিক্রি করছে না টিসিবি।
টিসিবির এই পণ্য বিক্রি কার্যক্রম নির্ধারিত ডিলারদের দোকান বা নির্ধারিত স্থায়ী স্থাপনা থেকে সিটি করপোরেশন, জেলা-উপজেলা প্রশাসনের সার্বিক সহযোগিতায় ও তাদের নির্ধারিত তারিখ ও সময় পরিকল্পনা অনুযায়ী পরিচালনা করা হবে। কার্ডধারী ভোক্তারা নির্ধারিত ডিলারের কাছ থেকে ফ্যামিলি কার্ডধারীদের পণ্য সংগ্রহ করতে পারবেন বলেও জানানো হয়েছে।
Posted ১২:৪৫ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৮ জানুয়ারি ২০২৪
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta