কক্সবাংলা ডটকম(২২ সেপ্টেম্বর) :: চালের বাজার অস্থিতিশীল করে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে ২১ হাজার কোটি টাকা। গত পাঁচ মাসে এ পরিমাণ অর্থ লুটে নিয়েছে একটি সিন্ডিকেট।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোসহ (বিবিএস) সরকারি-বেসরকারি একাধিক সংস্থার তথ্যমতে, দেশে দৈনিক চালের চাহিদা ৯০ হাজার টন। ওই হিসাবে এক মাসে চালের প্রয়োজন ২৭ লাখ টন। পাঁচ মাস ধরে চালের বাজার অস্থিতিশীল। দফায় দফায় বেড়েছে দামও। আমদানি শুল্ক দুই দফা কমানোর পরও চাল-বাজারের লাগাম টানা যায়নি।
বর্তমান সরকারের (২০০৯-২০১৩) মেয়াদে বেশকিছু নিত্যপণ্যের দাম ওঠানামা করলেও চালের বাজার মোটামুটি স্থিতিশীল ছিল। মোটা চালের কেজি ছিল ৩০ থেকে ৩৫ টাকা, আর সরু চাল ৪০ থেকে ৪২ টাকা। টানা কয়েক বছর বাম্পার ফলনে ওই সময় বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে। মূল্যস্ফীতি নেমে আসে ছয় শতাংশের নিচে। কিন্তু কয়েক মাস ধরেই চালের বাজার অস্থির। নিয়মিত বাড়ছে দাম।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজার দরের তথ্যানুযায়ী, গত এক বছরে সরু চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ১৫ থেকে ১৭ টাকা। মিনিকেট চালের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ১৮-১৯, নাজিরশাইল ১৫-১৬ টাকা, মাঝারি চাল ১২-১৩, পাইজাম/লতা (সাধারণ মানের) ১২-১৩, পাইজাম/লতা (উন্নতমানের) ১২-১৩ এবং মোটা চাল ১৮-২০ টাকা।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রতিমাসে কমপক্ষে ২৭ লাখ টন চালের ওপর সিন্ডিকেট সদস্যরা অতিরিক্ত মুনাফা করেছেন। সরকার ৩৪ টাকা কেজিতে মোটা চাল কিনে, যার বাজারমূল্য এখন ৫০ টাকা। অর্থাৎ কেজিতে ১৬ টাকা ও টনে ১৬ হাজার টাকা বাড়তি মুনাফা হয়েছে সিন্ডিকেট সদস্যদের। সে হিসাবে এক লাখ টন চালে ১৬০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন সিন্ডিকেট সদস্যরা। এই হিসাবে মাসে চার হাজার ৩২০ অর্থাৎ পাঁচ মাসে এই চক্রের পকেটে গেছে ২১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। তবে অতিরিক্ত অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন আড়তদাররা।
সূত্র মতে, দেশে প্রতিবছর চালের চাহিদা আনুমানিক দুই কোটি ৩১ লাখ ৫৮ হাজার টন। এখন প্রতিকেজি মিনিকেট ৬০-৬২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। নাজিরশাইল ৬৮-৭০, মাঝারি মানের চাল বিআর-২৮ ও লতা ৫০-৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দেশি ও আমদানি করা মোটা চাল ৪৭-৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম একাধিকবার বলেছেন, দেশে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে এক কোটি টন চালের মজুদ আছে। উদ্দেশ্যমূলকভাবে চাল নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ও ভীতি সৃষ্টির অপচেষ্টা চলছে। এক শ্রেণির ব্যবসায়ী ও মিল মালিক চাল নিয়ে এ চালবাজি করছেন অভিযোগ করে কামরুল বলেন, আমরা চালবাজি ও ষড়যন্ত্রের মধ্যে আছি। কারণ বাংলাদেশেই এক কোটি টন চাল আছে।
তার পরও এই অবস্থা। আমি মজুদদার, আড়তদার, মিল মালিকসহ সবার প্রতি আহ্বান জানাব, এখনই ভালো হয়ে যান, সময় আছে। আপনারা যেভাবে (চালের) দাম বাড়াচ্ছেন, যেভাবে সিন্ডিকেট করে দেশে চালবাজি শুরু করেছেন, বিভ্রাট সৃষ্টির চেষ্টা করছেন, তা কোনো অবস্থাতেই বরদাশ্ত করা হবে না।
বাবুবাজারের চাল ব্যবসায়ী যথাক্রমে মো. আমিন, রফিকুল ইসলাম, জাহের আলীরা এমন অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চালের দাম বাড়ানো হয়নি। দেশে হাওর বিপর্যয় ও বন্যার কারণে দাম বেড়েছে। বন্যায় ফসল নষ্ট হয়েছে বলে দাম বেড়েছে। চাল মজুদ করে রাখা হয়নি। সরবরাহ কম, আগের মতো মিলারের কাছ থেকে এ বছর চাল পাইনি। যা পেয়েছি তা আগের থেকে অনেক বেশি দামে।
খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেন, অসাধু ব্যবসায়ীদের চাল মজুদই বাজারে চালের মূল্য বৃদ্ধির একমাত্র কারণ। হাওর অঞ্চলে বন্যা হওয়ার পর থেকেই তারা মজুদ শুরু করেছিল। আমরা যে (বোরোর) ক্রয় মূল্য ৩৪ টাকা দিয়েছিলাম, বাজারের দামের সঙ্গে এর বিরাট ফারাক ছিল। ফলে আমরা (বোরো) সংগ্রহ করতে পারিনি।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এসআরও নং ১১৩-আইন/২০১১ অনুযায়ী, খাদ্য লাইসেন্স ছাড়া কোনো পাইকারি চাল ব্যবসায়ীর তিনশ টনের বেশি চাল সর্বোচ্চ এক মাসের বেশি মজুদ রাখার সুযোগ নেই। কোনো কারণে নির্ধারিত সময় পার হলে পরবর্তী তিন দিনের মধ্যে কারণ ব্যাখ্যাসহ মজুদের পরিমাণ সরকারকে অবগত করার কথা। চাল সংকট নিয়ে সরকারেরই বক্তব্য কিছু পাইকারি চাল ব্যবসায়ী, বিশেষ করে চালকল মালিক একজোট হয়ে আইন ভঙ্গ করে চাল মজুদ রাখায় এই কৃত্রিম সংকট। অথচ বিদ্যমান আইন প্রয়োগ করা হলে চাল সিন্ডিকেট গঠনের কোনো সুযোগই পেত না অসাধুরা।
সূত্র জানায়, নওগাঁ, দিনাজপুর, আশুগঞ্জ, ময়মনসিংহ, সান্তাহার (বগুড়া), রাজশাহী, কুষ্টিয়াসহ বিভিন্ন জেলায় তিন শতাধিক চালকল মালিক রয়েছেন। এর মধ্যে প্রায় ৩০ জন বড় মাপের মিল মালিক ও ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে বর্তমানে ধান-চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন। তথ্য-প্রমাণ রয়েছে চালের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে একটি ‘দুর্ভিক্ষ’ সৃষ্টির অপচেষ্টার মাধ্যমে সরকারকে বিব্রত করার চেষ্টা করা হয়েছে।
চিহ্নিত ওইসব মজুদদারদের গুদামে হানা দিয়ে খাদ্য লাইসেন্সের ধারা অনুযায়ী সমুদয় চাল বাজেয়াপ্ত করছে সরকার। খাদ্য বিভাগ জানায়, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চলতি অর্থবছরে ২২ হাজার ৪৬৩ চালকল মালিকের সঙ্গে বোরো চাল সংগ্রহের জন্য চুক্তি করে সরকার। শর্ত ছিল, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তারা সরকারি গুদামে আট লাখ টন চাল সরবরাহ করবে। কিন্তু সরকারে আহ্বানে তারা সাড়া দেননি। সিন্ডিকেটের অভিযোগের তীর মূলত তাদের দিকেই।
জানা গেছে, সরকারি-বেসরকারি একাধিক সংস্থার পর্যবেক্ষণ, এ মুহূর্তে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের কিছু বড়মাপের চালকল মালিক ও ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। বোরো ও আমন মৌসুমে কৃষকদের কাছ থেকে কম দামে চাল কিনে গুদামজাত করেছেন। এসব অবৈধ চাল মজুদদারদের আটক করতে জেলা প্রশাসন ও পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ।
Posted ১২:০৭ অপরাহ্ণ | শুক্রবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta