কক্সবংলা ডটকম(৭ জানুয়ারি) :: রাত পোহালেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বহুল প্রতীক্ষিত ভোটগ্রহণ । বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মধ্যেই সারাদেশে অনুষ্ঠিত হচ্ছে আজকের এই ভোটানুষ্ঠান। এবারের নির্বাচন যেন অংশ গ্রহণমূলক হয়, সে লক্ষ্যে বরাবরই দৃৃশ্যমান ছিল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তৎপরতা, বিশেষ করে পশ্চিমা বিশে^র। যদিও শেষ পর্যন্ত রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও তাদের সমমনা ১৬ দল এ নির্বাচন বর্জন করেছে। শুধু তাই নয়, ভোটারদেরও আহ্বান জানিয়েছে ভোট বর্জনের।
এরই ধারাবাহিকতায় ভোটের আগে ও পরে ৪৮ ঘণ্টার হরতালও ডেকেছে সরকারবিরোধী দলগুলো। এর মধ্যে যোগ হয়েছে যাত্রীবাহী যানবাহনে বিশেষ করে বাসে ও ট্রেনে নাশকতা। ট্রেনে দেওয়া আগুনে গত শুক্রবারও মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে পাঁচ যাত্রীর। ২৮ অক্টোবরের পর যানবাহনে অগ্নিকাণ্ড; দগ্ধ হয়ে যাত্রী-শ্রমিকের মৃত্যুর একের পর এক কাণ্ডে নিরাপত্তা নিয়ে যারপরনাই শঙ্কিত সাধারণ মানুষ।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কেন্দ্রে ভোটার টানাও একটা বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। উপরন্তু বড় বিরোধী দল না থাকলেও নির্বাচন কেন্দ্র করে দুপক্ষের সংঘর্ষে প্রাণহানি, ভোটকেন্দ্রে আগুন, ক্যাম্প ভাঙচুর, প্রতিপক্ষের প্রার্থী-কর্মী-সমর্থকের ওপর হামলার মতো সহিংস ঘটনাও ঘটছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। এমন নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যেই এগিয়ে গেছে নির্বাচনী ট্রেনÑ গন্তব্য আজকের ভোটানুষ্ঠান। তাই দেশবাসীও তাকিয়ে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে আজকের ভোট কেমন হয়, সেটি দেখার অপেক্ষায়।
আজ ২৯৯ আসনে সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত একটানা ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। একটি আসনে নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে একজন প্রার্থী মারা যাওয়ার কারণে। সুষ্ঠু ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠানে সার্বিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে ইসি। আজ সকালে ৯৩ শতাংশ কেন্দ্রে ব্যালট পাঠানো হবে। দুর্গম ও চরাঞ্চলের ৭ শতাংশ কেন্দ্রে গতকাল রাতেই ব্যালটসহ নির্বাচনী সরঞ্জাম পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া নিরাপত্তা নিশ্চিতে সশস্ত্র বাহিনীসহ নৌবাহিনী, পুলিশ, র্যাব, আনসারসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাড়ে সাত লাখ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।
একটি পক্ষের ভোট বর্জনের কারণে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন শান্তিপূর্ণ অনুষ্ঠানের বিষয়ে সংকট দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল।
রবিবার ভোটের আগের দিন বিকালে বিদেশি পর্যবেক্ষক, সাংবাদিকসহ সবাইকে সার্বিক প্রস্তুতি জানানোর সময় সিইসি বলেন, সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। তবে কোনো একটা বিরোধী পক্ষ ভোট বর্জনের পাশাপাশি প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে প্রতিহত করার চেষ্টা করছে। এতে নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে উঠিয়ে আনার ক্ষেত্রে কিছুটা সংকট দেখা দিতে পারে। তিনি বলেন, বড় দল ভোটবিরোধী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। ভোটারদের কেন্দ্রে না যাওয়ার জন্য বলছে, সেটি অপরাধ। সেটি আমাদের চ্যালেঞ্জও।
নির্বাচনের আগের দিন বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলনকেন্দ্রে আয়োজিত মিট দ্য প্রেসে দেশি-বিদেশি সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষকদের ভোটের প্রস্তুতি জানানোর পাশাপাশি বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন সিইসি।
মার্কিন ভিসানীতির কথা তুলে ধরে জাপানি এক সাংবাদিকের প্রশ্নে হাবিবুল আউয়াল বলেন, এটি কমিশনের দায়িত্ব নয়, কে অংশ নেবে। কমিশন সবাইকে আহ্বান জানাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য। নির্বাচন হতে হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য। তারা (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন বিশ্বাস করে। যারা এ ক্ষেত্রে বাধা তাদের ওপর এই নীতি প্রয়োগ করবেন। আমরা নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করছি না। আমরা জানি না কারা আগুন দিচ্ছে, মানুষকে হত্যা করছে। আমরা আমাদের জায়গা থেকে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের চেষ্টা করছি।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন জানতে চেয়েছে এই নির্বাচনের পর বিরোধী দল কে হবে? এমন পরিস্থিতিতে কমিশন বিব্রত কিনা? এমন প্রশ্নের উত্তরে হাবিবুল আউয়াল বলেন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন বা কেউ হয়তো প্রশ্ন করেছিলÑ আমাদের আসন্ন নির্বাচনে বিরোধী দল কে হবে? এই প্রশ্নে আমার সরাসরি উত্তর হচ্ছেÑ এটি মোটেই আমাদের জন্য বিবেচ্য বিষয় নয়। এটি রাজনৈতিক ইস্যু। সংসদ কীভাবে গঠিত হবে, সংসদের ট্রেজারি বেঞ্চ কে হবে, বিরোধী দল কে হবে। সেখানে নির্বাচন কমিশনের কিছু বলার এখতিয়ার নেই। আমরাও সেটিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি না যে, সংসদ কীভাবে গঠিত হবে। নির্বাচন হলে তারাই সংসদে সিদ্ধান্ত নেবে। আমরা এ জন্য মোটেই বিব্রত নই।
একদিকে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার অনুরোধ, অন্যদিকে বর্জনের ডাক। বিএনপি-জামায়াত ও সমমনারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করায় আজকের নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কেমন হবে, এ নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। এবার স্বতন্ত্র প্রার্থীদের উৎসাহ দিয়ে বহু আসনে প্রচার জমিয়ে তুলেছে আওয়ামী লীগ। এর পরও শতাধিক আসনে ভোটের ময়দান একতরফা বলে জানা গেছে। এর মধ্যেও অনেক এলাকায় ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। পাশাপাশি ভোট বর্জন বিএনপির ডাকা তিন দিনের (গতকাল ভোর ৬টা থেকে কাল ভোর ৬টা পর্যন্ত ৪৮ ঘণ্টা) হরতাল চলছে। এদিকে তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচনী সহিংসতায় ১১ জন নিহত হয়েছে; আহত হয়েছে শতাধিক। এ নিয়ে সাধারণ ভোটারদের মধ্যে কিছুটা আতঙ্ক বিরাজ করছে।
মোট প্রার্থী ১৯৭০ জন
জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে রবিবার ২৯৯ আসনে নির্বাচন হচ্ছে। নওগাঁ-২ আসনের এক স্বতন্ত্র প্রার্থীর মৃত্যু হলে বিধি অনুযায়ী আসনটির ভোট স্থগিত করেছে ইসি। এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি প্রার্থী রয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের। দলটির প্রার্থীর সংখ্যা ২৬৬ জন। এ ছাড়া জাতীয় পার্টির ২৬৫ জন, তৃণমূল বিএনপির ১৩৫, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির ১২২, বাংলাদেশ কংগ্রেসের ৯৬, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ৫৬ জনসহ নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ২৭টি রাজনৈতিক দলের মোট প্রার্থী সংখ্যা ১ হাজার ৫৩৪ জন। আর স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছেন আরও ৪৩৬ জন। ফলে এবারের নির্বাচনের চূড়ান্ত প্রার্থী সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৯৭০ জনে। এর মধ্যে ৯০ জন নারী প্রার্থী ও ৭৯ জন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রার্থীও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
নির্বাচনে অন্য দলগুলোর মধ্যে ইসলামী ফ্রন্ট বাংলাদেশ, ইসলামী ঐক্যজোট, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, গণফোরাম, গণফ্রন্ট, জাকের পার্টি, জাতীয় পার্টি, জাতীয় পার্টি (জেপি), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), তৃণমূল বিএনপি, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি, বিকল্পধারা বাংলাদেশ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, বাংলাদেশ কংগ্রেস, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশন, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ), বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, গণতন্ত্রী ও বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এমএল) প্রার্থী দিয়েছে। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৪৪ রাজনৈতিক দলের মধ্যে দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ ১৬ দল এ নির্বাচন বয়কট করেছে।
ভোটের নিরাপত্তা রক্ষায় মাঠপর্যায়ে পুলিশ, র্যাব, আনসার-ভিডিপি, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ডসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রায় ৮ লাখ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। এ ছাড়া ভোটগ্রহণের কাজে ৮ লাখ কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োজিত থাকবেন। এ ছাড়া স্ট্যান্ডবাই থাকবেন ১ লাখ কর্মকর্তা-কর্মচারী। ৩ হাজার ম্যাজিস্ট্রেট ও বিচারক মাঠে থাকছেন। তারা যে কোনো অপরাধে তাৎক্ষণিক শাস্তি দিতে পারবেন। এবার ভোটে রিটার্নিং অফিসার হিসেবে ৬৬ জন দায়িত্ব পালন করছেন। এর মধ্যে দুজন বিভাগীয় কমিশনার এবং ৬৪ জন জেলা প্রশাসক।
সর্বশেষ প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী, এবারের নির্বাচনে মোট ভোটার ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৮৯ হাজার ২৮৯ জন। যার মধ্যে পুরুষ ভোটার ৬ কোটি ৭৬ লাখ ৯ হাজার ৭৪১ এবং নারী ভোটার ৫ কোটি ৮৯ লাখ ১৮ হাজার ৬৯৯ জন। এ ছাড়া সারাদেশে এবার তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার আছেন ৮৪৯ জন। মোট ৪২ হাজার ২৪ ভোটকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এসব কেন্দ্রে ভোটকক্ষ ২ লাখ ৬১ হাজার ৯১২টি।
নির্বাচন উপলক্ষে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে ২২ সদস্যের মনিটরিং সেল গঠন করেছে কমিশন। মনিটরিং সেল শনিবার সকাল ৮টা থেকে ৯ জানুয়ারি সকাল ৮টা পর্যন্ত ৭২ ঘণ্টা পরিচালনা করা হবে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যয় বেড়ে দাঁড়াচ্ছে প্রায় ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এ নির্বাচনে আসনপ্রতি ৭ কোটি টাকার বেশি ব্যয় করবে ইসি। বিশাল এ বাজেটের বেশির ভাগ অর্থই ভোটের দায়িত্বে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পেছনে ব্যয় হবে। জানা গেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে প্রাপ্ত চাহিদা অনুযায়ী সম্ভাব্য ব্যয় প্রায় ১ হাজার ২২৫ কোটি ৬২ লাখ টাকা এবং নির্বাচন পরিচালনা খাতে সম্ভাব্য ব্যয় ১ হাজার ৫০ কোটি ৬০ লাখ টাকা।
Posted ১২:১৮ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ০৭ জানুয়ারি ২০২৪
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta