কক্সবাংলা ডটকম(২৫ আগস্ট) :: অনেক আগেই দ্যুতি হারিয়েছে তুরস্কের রাজনৈতিক মডেল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অধীন আরেক খামখেয়ালি প্রশাসনের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান কূটনৈতিক সংকট দেশটির অর্থনীতিকে ঠেলে দিয়েছে পূর্ণমাত্রার এক মুদ্রা সংকটের দিকে। গত ১২ মাসে তুর্কি লিরার মান কমেছে অর্ধেকের কাছাকাছি। অন্যদিকে দেশটির ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদেশী মুদ্রায় দেনাও অনেক বেশি। এ কারণে লিরার এ ক্রমাগত অবমূল্যায়নে তুরস্কের ব্যক্তি খাতেও দেখা দিয়েছে পতনের শঙ্কা।
তুরস্কের সরকার ব্যবস্থার সংসদীয় থেকে প্রেসিডেন্সিয়ালে রূপান্তর ঘটে জুনে। এর পরে অনুষ্ঠিত প্রথম নির্বাচনে জয়লাভ করেন প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান। তুরস্ক এখন চলছে তার স্বৈরশাসনে। দক্ষতার বদলে আনুগত্যের (এবং নিজ পারিবারিক সম্পর্কের) ভিত্তিতে বেছে নেয়া মন্ত্রীদের ওপর নির্ভর করে দেশ চালাচ্ছেন তিনি।
এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আর্থিক বাজারের বেনিফিট অব ডাউট পেয়ে আসছেন এরদোগান (২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি)। তুরস্কের অর্থনীতিতে ঋণও এসেছে সহজে। স্থানীয় পর্যায়ে ভোগ এবং চটকদার আবাসন, সেতু, সড়ক ও বিমানবন্দরে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিদেশী অর্থায়নের মাত্রাও ছিল স্থিতিশীল। এর ওপরই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। তবে এ ধরনের অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের শেষটা সাধারণত খুব একটা ভালো হয় না। এ কারণেই তুরস্কের ক্ষেত্রেও মূল প্রশ্ন ছিল, এর শেষটা দেখা যাবে কখন?
এক্ষেত্রে একেবারে তাত্ক্ষণিক প্রভাবকের কাজ করেছে ট্রাম্প প্রশাসনের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্ত এবং এর মাত্রা বৃদ্ধির হুমকি। ইজমিরভিত্তিক মার্কিন ইভানজেলিক্যাল যাজক অ্যান্ড্রু ব্র্যানসনকে মুক্তি দিতে বাধ্য করতে দেশটির ওপর এ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ট্রাম্প প্রশাসন। ২০১৬ সালের জুলাইয়ে ট্রাম্পকে উত্খাতের জন্য সংঘটিত ব্যর্থ ক্যুর ধারাবাহিকতায় দমন-পীড়ন চলাকালে তাকে গ্রেফতার করে এরদোগান প্রশাসন। ক্যু-পরবর্তী এ দমন-পীড়ন চলাকালে গ্রেফতার হয়েছে ৮০ হাজার জন, গুলি ছোড়া হয়েছে ১ লাখ ৭০ হাজারবার। বন্ধ হয়ে গেছে তিন হাজার স্কুল, ডরমিটরি ও বিশ্ববিদ্যালয়। চাকরিচ্যুত হয়েছেন ৪ হাজার ৪০০ জন বিচারক ও প্রসিকিউটর।
এসব চরম পদক্ষেপ নেয়া হয় জরুরি অবস্থার আড়ালে। এর পেছনের আদেশ এসেছে মূলত এরদোগানের ঘনিষ্ঠ চক্রের মধ্য থেকেই। জনগণের মৌলিক স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হলেও প্রতিরোধ এসেছে সামান্য। কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে দেশটির গণমাধ্যম। দমন-পীড়ন ও আতঙ্কের পরিবেশ তৈরির মাধ্যমে নাগরিক সমাজকে করে ফেলা হয়েছে হীনবল। ২০১৬-পরবর্তী দমন-পীড়নে ব্র্যানসনের মতো কয়েক হাজার ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনা হয়েছে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ।
অস্থিতিশীল নীতিমালার কারণে যে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়, সেখান থেকে বেরোতে হলে তাত্ক্ষণিক ও মধ্যমেয়াদি— দুই ধরনেরই পদক্ষেপ প্রয়োজন। স্বল্পমেয়াদে আর্থিক বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে হলে আগে অর্থনীতিতে আস্থা ফেরানোর মতো পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে তুরস্কের কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সুদহার বাড়ানোর মতো পদক্ষেপ নিতে হতে পারে। যদিও এ ধরনের পদক্ষেপের প্রতি প্রবল বিতৃষ্ণা রয়েছে এরদোগানের। প্রয়োজন আর্থিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য বাস্তবমুখী ও বিশ্বাসযোগ্য কর্মসূচি হাতে নেয়া। একই সঙ্গে বেসরকারি খাতের ঋণ পুনর্গঠনও জরুরি। সাময়িক অর্থসহায়তার জন্য দ্বারস্থ হওয়া যেতে পারে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের।
কিন্তু তুর্কি অর্থনীতির দীর্ঘমেয়াদি ভঙ্গুর দশা মেরামতের ক্ষেত্রে এসব স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ পর্যাপ্ত নয়। এ সংকটের শেকড় নিহিত রয়েছে এরদোগানের ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরাচারিতার মধ্যেই।
তুরস্ক নিষ্কলুষ গণতন্ত্রের দেশ ছিল না কখনই। ২০০৩ সালে এরদোগান ক্ষমতায় আসার আগেই দেশটির গণতন্ত্রে সামরিক হস্তক্ষেপ হয়েছে চার-চারবার। কিন্তু এর মধ্যেও রাজনৈতিক ভারসাম্যের বিষয়টি ছিল। এ কারণে দেশটির সামরিক বাহিনীকেও ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছিল। দেশটিতে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে বহুবার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই দেশটিতে কোনো একক ব্যক্তির পক্ষে অবাধ ক্ষমতার অধিকারী হওয়া সম্ভবপর হয়নি। দেশটিতে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পত্তন ঘটে ১৯৪৬ সালে দুর্বল ভিত্তির ওপর। এরপর দেশটিতে নাগরিক সমাজ এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল যে, সরকারকেও বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংস্থা, ইউনিয়ন, শিক্ষাবিদ, গণমাধ্যম এবং অন্যান্য গোষ্ঠীকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করতে হয়েছে।
শুরুর দিকে, যখন এরদোগানের সামনে সামরিক বাহিনী এবং সেকুলারিস্ট এলিটদের কাছে নিজের অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার শঙ্কা ছিল, এরদোগান তখন গণতন্ত্র আর মানবাধিকারের প্রতি ভালোই সম্মান দেখিয়েছেন। দীর্ঘদিনের নিষ্পেষিত কুর্দি সংখ্যালঘুদের প্রতিও হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি। অন্যদিকে তার ‘ইসলামপন্থী গণতন্ত্রের’ বুলির ধাপ্পায় ধোঁকা খেয়ে যান পশ্চিমা বিশ্বের উদারপন্থী ও এরদোগান সমর্থকরা। এ ধরনের বুলিতে বিশ্বাস স্থাপন করতে রীতিমতো মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন তারা।
বিশাল অংকের কর আর জরিমানার মধ্য দিয়ে স্বাধীন গণমাধ্যমকে মেরে ফেলার প্রক্রিয়া শুরু করেন পশ্চিমা বিশ্বের প্রশংসাপুষ্ট এরদোগান। সামরিক বাহিনীর জেনারেল ও শীর্ষস্থানীয় সেকুলারিস্টদের প্রহসনমূলক বিচারের মধ্য দিয়ে ক্ষতি করেন আইনের শাসনের। রাজনৈতিক মিত্র এবং মার্কিনঘেঁষা ধর্মীয় নেতা ফেতুল্লাহ গুলেন ও তার অনুসারীদের সঙ্গে বিচ্ছেদের পরপরই কর্তৃত্ববাদী শাসনের ষোলোকলা পূর্ণ করেন এরদোগান। ব্যর্থ ক্যু প্রচেষ্টার পর এ কর্তৃত্ববাদ আরো জোরালো হতে থাকে।
এরদোগানের ভাষ্যমতে, জুনের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ‘নতুন তুরস্কের’ পথ করে দিয়েছে ‘পুরনো তুরস্ক’। নতুন এ তুর্কি প্রজাতন্ত্রে এরদোগানের কর্তৃত্বের প্রতি সামান্যতম চ্যালেঞ্জ জানানোটাও রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল।
যা কিছু ভালো ঘটে, নিঃসংকোচে তার সবকিছুরই কর্তৃত্ব দাবি করে বসেন এরদোগান। অন্যদিকে ব্যর্থতার দায়ভার জোটে কালো শক্তির, প্রায় ক্ষেত্রেই বেনামি বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীদের। তার আত্মকীর্তন, নিজেকে অমোঘ এক শক্তি হিসেবে প্রদর্শন এবং শেষ পর্যন্ত তাকে রাজনৈতিকভাবে টিকিয়ে রাখার মতো বিষয়গুলোই এখন তুরস্কের চূড়ান্ত লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে তার ক্ষমতাকে শক্তিশালী করতে গিয়ে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং সামাজিক ক্ষতে প্রলেপ দেয়ার মতো বিষয়গুলোকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে ব্যাকসিটে। তুর্কি জাতির প্রতি নিজেকে কোরবান করে দেয়ার প্রতিদান হিসেবে এরদোগান ও তার সঙ্গীরা এখন উঠে গেছেন যাবতীয় আইনের ঊর্ধ্বে, হয়ে উঠেছেন আরো সম্পদশালী।
তুরস্কের বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার পেছনের যুক্তিগুলো অনেকটা পুরনো অটোমান আমলের ‘ন্যায়চক্রের’ মতো। এ ন্যায়চক্রের প্রথায় তুরস্কের বাসিন্দারা ছিল দুই ভাগে বিভক্ত— করদাতা জনগণ এবং করমুক্ত সুবিধার অধিকারী অল্প কিছু অভিজাত। শেষোক্ত দলের মাথা ছিলেন সুলতান। এ সুলতান আবার নিজেকে শুধু ইসলামী আইনেরই অধীন বলে জাহির করতেন। যদিও এ আইন আসলে কী, সেটা নির্ধারণের বিষয়টিও ছিল তার কুক্ষিগত। ১৮৩৯ সালের দিকে অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের সময়ে এক ফরমান জারির মাধ্যমে বাতিল করে দেয়া হয় এ ‘ন্যায়চক্র’ প্রথা। প্রায় দুই শতাব্দী পর এরদোগান তুরস্ককে এমন এক অতীতে নিয়ে গেছেন, যা পেছনে ফেলে আসার জন্য প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে লড়াই চালিয়ে গেছেন সংস্কারকরা।
এরদোগান যে ধরনের পদ্ধতি চালু করেছেন, তাতে অর্থনীতির হাল ধরার মতো দক্ষ রাজনীতিবিদ ও আমলাদের কোনো জায়গাই নেই। নেতার ব্যক্তিগত স্বার্থের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ, এ কারণে ঠেলে বের করে দেয়া হয়েছে তাদের। প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা বা তর্ক চালানোর সাহস পায় না কেউই। একগাদা ইয়েস-ম্যানে (এবং কিছু ইয়েস-উইমেনেও) পরিবেষ্টিত হয়ে আছেন তিনি। এরা তার নিজের বিশালতা ও সর্বজ্ঞতার ধারণায় হাওয়া দিতে মুখিয়ে আছে সর্বদাই। এমনকি এরদোগান যখন ইঙ্গিত দেন, সে সময় তাকে সমর্থন না দেয়ার অর্থ হচ্ছে শত্রুকে সহায়তা করা; এ কারণে তুরস্ক পার্লামেন্টের বিরোধীদলীয় নেতারাও তখন পরিণত হন নখদন্তহীন চিয়ারলিডারে।
রাশিয়া ও ভেনিজুয়েলার মতোই এখানে জনগণের মধ্যে একেবারে অল্পসংখ্যক কিছু বিরোধীর উপস্থিতি সহ্য করা হয়। শুধু এটুকু বোঝানোর জন্যই যে, মুক্তমতের স্বাধীনতা রয়েছে। কিন্তু এসব বিরোধীরও দুর্বিষহ জীবনযাপন করতে হয়। অন্যরা যাতে সীমা লঙ্ঘন না করে, সেজন্য হুঁশিয়ারি হিসেবে যেকোনো মুহূর্তে গ্রেফতার হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় থাকেন তারাও।
এখন হোক আর পরে হোক; অর্থনৈতিক চাপের কারণে তুরস্ক মুদ্রা ও আর্থিক বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার মতো পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবেই। কিন্তু তাতে দীর্ঘমেয়াদি বেসরকারি বিনিয়োগ বা দলে দলে দেশত্যাগ করে চলে যাওয়া মেধাগুলোকে আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না। বিকাশ ঘটবে না তুরস্কের উন্নতির পথ করে দেয়ার মতো স্বাধীন পরিবেশেরও। চীন ও এশিয়ার অন্য কয়েকটি দেশ দেখিয়েছে, সংবেদনশীল অর্থনৈতিক নীতিমালা কাজে লাগিয়ে স্বৈরতন্ত্রের মধ্যেও উন্নতি করা সম্ভব। কিন্তু আর্থিক নীতিমালা যদি হয়ে ওঠে রাষ্ট্রপ্রধানের ব্যক্তিগত ক্ষমতা বৃদ্ধির আরেক হাতিয়ার, এর মূল্য অর্থনীতিকেই চুকাতে হয়।
Posted ৫:৪৮ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ২৬ আগস্ট ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta