তবে আগামী নির্বাচন নিয়ে দলের মূল কৌশল গণমাধ্যমকে জানাতে নারাজ বিএনপি নেতারা। তারা বলছেন, ‘আগেভাগে নির্বাচনকে ঘিরে দলের পরিকল্পনা জানিয়ে দিলে সরকার কৌশলী হওয়ার সুযোগ পাবে। একইসঙ্গে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়ে দিলে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা হতাশ হয়ে পড়তে পারে। তাই এ নিয়ে মুখ না খুলতে নেতাদের কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।’
নাম না প্রকাশের শর্তে লন্ডনে বসবাসরত বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির একজন বলেন, ‘এ সরকারের অধীনে ভোটে যাওয়া মানে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে বৈধতা দেওয়া। তখন প্রশ্ন উঠতে পারে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে কেন অংশ নিলাম না আমরা। তাছাড়া এখন পর্যন্ত দেশের যা অবস্থা, তাতে নিরপেক্ষ নির্বাচন কিংবা সব দলের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সৃষ্টির কোনও সম্ভাবনা নেই। বিএনপিকে চাপে রাখার কৌশল থেকে নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিতে চাইবে না সরকার। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে সরকারের ফাদেঁ পা দেবে।’
তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ ও জিয়া পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কিত লন্ডনের একজন ব্যারিস্টার বলেন, ‘নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রশ্নে সম্ভাব্য প্রার্থীদের অনাগ্রহ গুরুত্বপূর্ণ। বিএনপির মনোনয়নে তিন-চারবার সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী হয়েছেন, এমন অনেকে বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যেতে চান না। এমন জ্যেষ্ঠ নেতারা তারেক রহমানের কাছে নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন। তাদের অনেকে লন্ডনে এসে তার সঙ্গে দেখা করে ও অনেকে দেশ থেকে ফোনে যোগাযোগ করছেন।’
বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন নিয়ে অনাগ্রহের কারণ হিসেবে জ্যেষ্ঠ নেতারা বলছেন, ‘সব আসনে সরকারি দলের নেতারা দুই মেয়াদে সরকারে থাকার সুযোগে ব্যবসা-বাণিজ্যে অনেক সুবিধা নিয়েছেন। গত ১০ বছরে সম্ভাব্য প্রার্থীদেরও আয় অনেক বেড়েছে। গত তিনটি নির্বাচনে প্রার্থীদের হলফনামায় সম্পদ ও আয়ের হিসাব তুলনামূলক বিশ্লেষণ করলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে।’
এমনিতে ওয়ান ইলেভেনের সময় থেকে সরকারের বাইরে থাকায় বিএনপির মাঠপর্যায়ের নেতারা মামলা-হামলায় বিপর্যস্ত। দলের সাবেক সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে সাবেক মন্ত্রীরাও বর্তমান সরকারের সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে রোষানলের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এমন বাস্তবতায় ঝুকিঁ নিয়ে নির্বাচনে গেলেও তা সুষ্ঠু হবে এমন নিশ্চয়তা নেই বলে মনে করেন তারা। তাদের আশঙ্কা, এখন বাড়িঘরে থাকা নেতাকর্মীকে তখন নতুন নতুন মামলায় এলাকাছাড়া হতে হবে।
অন্য কারণটি হলো- বিএনপির সরকার গঠনের কোনও প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশের নিশ্চয়তা না থাকলে একাধিকবারের সাবেক এমপি ও মন্ত্রীরা ঝুকিঁ নিয়ে নির্বাচনে জিতেও শুধু ‘বিরোধী দলের এমপি’ পরিচয়ের গণ্ডিতে থাকতে চান না।
বিএনপির জরিপে শতাধিক আসনে জনপ্রিয় ও বিজয়ী হওয়ার মতো প্রার্থী এই জ্যেষ্ঠ নেতাদের অভিমত, ‘এমপি হলেও স্থানীয় প্রশাসন চলবে সরকারি দলের নির্দেশনায়। সংসদে যাওয়ার সুযোগ পেলেও এলাকা বা দলের জন্য কাজ করার সুযোগ থাকবে না। তখন তাদের অবস্থা হবে অনেকটা এখন বিএনপির মনোনয়নে জিতে আসা উপজেলা চেয়ারম্যানদের মতো!’
সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীর জয়ী হওয়া প্রসঙ্গে তারেক রহমানের ওই ঘনিষ্ঠজন বলেন, ‘সদ্যসমাপ্ত সিলেট সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী হেরে গেলেও সরকার অনেকভাবে জিতেছে। সিলেটে তুলনামূলক সুষ্ঠু নির্বাচনের মোটামুটি একটি নজির দেখিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
একইসঙ্গে সিলেটের নির্বাচন নিয়ে জামায়াত শিবিরের দীর্ঘদিন ফেরারি থাকা নেতাকর্মীদের মাঠে নামার সুযোগ দিয়েছে সরকার। শেষ পর্যন্ত জামায়াত যেমন চট্টগ্রামের পর নিজেদের ঘাঁটি হিসেবে বলে আসা সিলেটে নিজেদের নাজুক অবস্থানের প্রমাণ পেয়েছে, তেমনই সিলেট সিটি নির্বাচন নিয়ে সারাদেশে ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ে বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্কে প্রবল তিক্ততা ও দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছে।’
তবে সিলেট সিটি নির্বাচনে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান কেন তৎকালীন ও বর্তমান মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রার্থী বদরুজ্জামান সেলিমকে মনোনয়ন দিতে আগ্রহী ছিলেন, তা নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি লন্ডনে বিএনপির কোনও নেতা।
আগামী নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিলে দল ভেঙে যাওয়ার কোনও আশঙ্কা আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে দলের কেন্দ্রীয় নেতা ও বর্তমানে লন্ডনে অবস্থানরত ঢাকা মহানগরের একটি আসন থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশী একজন নেতা মঙ্গলবার বলেন, ‘এতকিছুর পরও বিএনপি এখনও ঐক্যবদ্ধ আছে। দল ভাঙার তো কম চেষ্টা হয়নি। সংসদ নির্বাচনকে ঘিরেও এই অপচেষ্টা থাকবে। তবে এ ব্যাপারে বিএনপির শীর্ষপর্যায় বা সরাসরি করে বললে তারেক রহমানের কোনও দুর্ভাবনা বা টেনশন নেই।
কারণ তিনি দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। বিএনপি আগামী নির্বাচনে অংশ না নিলে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখাই তার নেতৃত্বের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। অতীতে দলের সঙ্গে যারা বেঈমানি করেছেন, তারা কর্মীদের কাছে এখনও অপমানিত হচ্ছেন। ওয়ান ইলেভেনে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়া নেতারা নিজেদের পরিণতি দেখেছেন। এখন বিএনপির কৌশল হলো, যে কোনও পরিস্থিতিতে দলকে ধরে রাখা।’
তারেক রহমান লন্ডনে বসে দলের জন্য কেমন পদক্ষেপ নিচ্ছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তার একজন উপদেষ্টা বলেন, ‘কূটনৈতিক উদ্যোগ তো দৃশ্যমান হয় না। সবকিছু গণমাধ্যমে বলা সম্ভবও নয়। এ মুহূর্তে তারেক রহমানের উপদেষ্টা হিসেবে দলের যুক্তরাজ্য শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক (ব্যারিস্টার এম এ সালাম) কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। সরকারকে বহিঃর্বিশ্বে চাপে রাখতে চায় বিএনপি। এজন্য দেশ-বিদেশে জনমত গঠনে কাজ করছে দলটি।’
ওই উপদেষ্টার তথ্য অনুযায়ী, ‘তারেক রহমানের সরাসরি নির্দেশনায় বিএনপির বেশ কয়েকটি টিম লন্ডন থেকে নীরবে কাজ করছে। বেলজিয়াম ও মধ্যপ্রাচ্য সফর করেছেন তিনি। বিশ্বজুড়ে সরকারের নেতিবাচক কর্মকাণ্ড তুলে ধরার পাশাপাশি নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত রাখতে রাজনৈতিকভাবে সব ধরনের চেষ্টা চালাচ্ছেন তারেক রহমান। এছাড়া আরাফাত রহমান কোকোর কন্যা জাহিয়া রহমানসহ জিয়া পরিবারের তৃতীয় প্রজন্মকে রাজনীতিতে আনতে তাদের পারিবারিক প্রচেষ্টাও চলছে।’
এদিকে শেষ মুহূর্তে সরকারি দল যেন ফাঁকা মাঠে গোল দিতে না পারে সেজন্য পরিস্থিতি অনুযায়ী সুযোগ কাজে লাগাতে ইতোমধ্যে ৩০০ আসনের প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করে রেখেছে বিএনপি। এর মধ্যে মৌলভীবাজার-৩ (সদর-রাজনগর) আসন থেকে দলের মনোনয়ন প্রত্যাশী কেন্দ্রীয় আন্তর্জামতিক বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্বে থাকা মাহিদুর রহমান। টানা ১৭ বছর যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি ছিলেন তিনি।
আগামী নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণের প্রশ্নে মঙ্গলবার মাহিদুর রহমান বলেন, ‘আমি বিএনপি নির্বাচনমুখী ও ভোটের রাজনীতি করা বৃহত্তর দল। আমরা অবশ্যই নির্বাচনে যেতে চাই। কিন্তু সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে একের পর এক রাজনৈতিক মামলা দিয়ে আমাদের নির্বাচনে যাওয়ার পথ বন্ধ করা হচ্ছে। সিটি নির্বাচনসহ বিভিন্ন নির্বাচনে স্বচ্ছতা না থাকার চিত্র দেখেছি আমরা। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নেই। আগামী সংসদ নির্বাচনের ফল আগেই অনেকটা নির্ধারিত। এমন পাতানো খেলায় বিএনপি অংশ নেবে কিনা তা শীর্ষপর্যায়ের চূড়ান্ত সিদ্বান্তের ব্যাপার।’
এই রাজনৈতিক নেতার মন্তব্য, ‘এত বছর ক্ষমতার বাইরে থেকে জেল-জুলুম সহ্য করেও মানুষের জনসমর্থন ধরে রাখতে পেরেছে বিএনপি। আগামীতেও দলটি তা পারবে। তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি ঐক্যবদ্ধ ছিল, আছে, থাকবে।’