কক্সবাংলা রিপোর্ট :: ২০২২ সালকে স্বাগত জানাতে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতে হাঁটতে হাঁটতে পশ্চিম আকাশে চোখ পেতে রাখা। অথবা নীল নোনা জলে ভাসতে ভাসতে দেখা বছরের শেষ সূর্যাস্ত। এরপর গভীর রাত পর্যন্ত সৈকতে কনসার্ট। দেশের স্বনামধন্য শিল্পীদের কণ্ঠে লাখো পর্যটকের কণ্ঠ মেলানো। সব মিলিয়ে ‘থার্টি ফার্স্ট নাইট’ ও ইংরেজি নতুন বছর বরণকে কেন্দ্র করে কক্সবাজার হয়ে উঠত উৎসবের শহর। কিন্তু মহামারির কারণে দুবছর ধরে ছেদ পড়েছে সেই চেনা দৃশ্যে। এবারও কক্সবাজারে উন্মুক্ত স্থানে অনুষ্ঠান আয়োজনের ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
কক্সবাজারে উন্মুক্ত স্থানে অনুষ্ঠান আয়োজনের অনুমতি নেই। করোনা মহামারির কারণে ৩১ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে ‘থার্টি ফার্স্ট নাইট’ কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে অত্যন্ত সীমিত পরিসরে আয়োজন করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
তারপরও দেশের বিভিন্ন স্থানের লোকজন কক্সবাজারে ২০২১ সালের শেষ সূর্যাস্তকে বিদায় ও রাতে বিভিন্ন হোটেলের ইনডোরে বিভিন্ন আয়োজনের মাধ্যমে এবং বিশাল সমুদ্র সৈকতে ঘুরে বেড়িয়ে ইংরেজি নতুন বছর ২০২২ সালকে বরণ করতে কক্সবাজারে ছুটে আসবেন।
কিন্তু কদিন আগে স্বামী-সন্তানকে জিম্মি করে এক নারীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনার কারনে এবার কড়াকড়িটা একটু বেশিই। সব উৎসব-অনুষ্ঠানই হবে হোটেলের চার দেয়ালে। তাও সীমিত পরিসরে।
নারী পর্যটককে তুলে নিয়ে ধর্ষণের পর এবার প্রশাসন বেশ সতর্ক। পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে বেশ প্রস্তুতি নিতে দেখা গেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। জেলা প্রশাসনও বিশেষ মনিটরিং সেল গঠন করেছে। স্বাস্থ্যবিধি মানা ও পর্যটকদের নিরাপত্তায় জোরালো ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছে টুরিস্ট পুলিশ। তবুও সেভাবে নেই পর্যটক। যারা এসেছেন তাঁদের মধ্যেও আছে ভয়, আছে শঙ্কা।
বৃহস্পতিবার বিকেলে সৈকতের সুগন্ধা ও লাবণী পয়েন্ট এলাকায় এক ঘণ্টা ধরে ঘুরে উল্লেখযোগ্য পর্যটকের দেখা মেলেনি। বেশিরভাগ পর্যটকই সন্ধ্যার আগে সৈকত ছেড়ে হোটেলে গেছেন।
চট্টগ্রামের রাউজান থেকে পরিবার নিয়ে এসেছেন জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বলেন, ‘নারী পর্যটককে ধর্ষণের ঘটনাটি আসলে সবাইকে ভয় ধরিয়ে দিয়েছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা বেশ ভালোই দেখলাম। তারপরও সন্ধ্যার আগে স্ত্রী-কন্যাদের হোটেলে নিয়ে যাওয়া নিরাপদ মনে করছি।’
একই কথা বলেছেন ঢাকার উত্তরা থেকে আসা সানজিদা ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমরা শুনেছি হাজারো মানুষের সামনে থেকেই ওই নারী পর্যটককে তুলে নেওয়া হয়েছে। এসব শোনার পর ভয় তো করবেই।’
এবার আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা আগের চেয়ে জোরদার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার (জেলা ব্র্যান্ডিং ও পর্যটন সেল) সৈয়দ মুরাদ ইসলাম।
তিনি বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকেও এ সংক্রান্ত নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পর্যটকদের নিরাপত্তায় রাতে উন্মুক্ত স্থানে সব অনুষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। তবে হোটেলের অভ্যন্তরে ছোট পরিসরে অনুষ্ঠান করা যাবে।’
কক্সবাজারের হোটেল-মোটেলের ব্যবসায়ীরা জানান, স্বাভাবিক সময়ে পুরোনো বছরকে বিদায় ও নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে দুই দিনে অন্তত দুই থেকে ৩ লাখ পর্যটক কক্সবাজারে অবস্থান করেন। এত পর্যটককে জায়গা দিতে তখন হোটেল-মোটেলগুলোকে বেশ হিমশিম খেত। অনেক পর্যটককে তাই গাড়িতে কিংবা নানা জায়গায় রাত কাটাতে হতো। তবে এবার পর্যটকের সেই চাপ নেই। প্রতিটি হোটেলকক্ষে অতিরিক্ত পর্যটক রাখতে পারার মতো বিশেষ ছাড় দিয়েও মিলছে না শতভাগ বুকিং।
সেটি জানিয়ে হোটেল ও রেস্তোরাঁ মালিকদের সমিতির সমন্বিত মোর্চা ‘ফেডারেশন অব ট্যুরিজম ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’–এর সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম সিকদার বলেন, ‘আগে এই সময়ে হোটেল-মোটেলগুলোতে শতভাগ বুকিং হতো। কিন্তু এখন ৬০-৭০ ভাগের মতো হয়েছে। আশা করছি শুক্রবার আরও পর্যটক আসবেন। তাঁরা অনলাইনে হোটেল কক্ষ বুকিং দিলে এখানে এসে ভোগান্তিতে পড়বেন না।’
সাম্প্রতিককালে নানা ঘটনায় কক্সবাজার নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণার কাজ করেছে বলেও মনে করছেন আবুল কাশেম।
এদিকে পর্যটকদের স্বাগত জানাতে এই সময়ে ব্যানার-ফেস্টুন দিয়ে সাজানো হতো সব হোটেল ও মোটেলকে। কিন্তু হোটেল-মোটেল জোন এলাকায় ঘুরে এমন কোনো দৃশ্য চোখে পড়েনি। পাঁচ তারকায় ছোটখাট আয়োজন ছাড়া মাঝারি মানের হোটেল-মোটেলে থার্টি ফার্স্ট নাইটের আয়োজন নেই।
পাঁচ তারকা মানের হোটেল কক্স টুডের ব্যবস্থাপক (রিজার্ভেশন) লোকমান হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘থার্টি ফার্স্ট নাইট উপলক্ষে আমাদের হোটেলে পর্যটকদের নিয়ে কেক কাটা, বুফে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে।’
পর্যটকেরা যাতে নিরাপদে বছরের শেষ দিন ও নতুন বছর প্রথমদিন উদ্যাপন করতে পারেন সেই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার টুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মহিউদ্দিন আহমেদ। সাড়ে ৪০০ আবাসিক হোটেলে সিসিটিভি ক্যামেরা নিশ্চিত করা হয়েছে। ৩৫টি পর্যটন জোনের প্রতিটিতেই টুরিস্ট পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকেও পুলিশ সার্বক্ষণিক মাঠে থাকবে।
কক্সবাজারে পর্যটকদের স্বাগত জানিয়ে জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ বলেন, ‘কক্সবাজার শুধু দেশের নয়, পৃথিবীর একটি আকর্ষণীয় পর্যটন জোন। তাই যেকোনো বিশেষ দিন উপলক্ষে কক্সবাজারে পর্যটকের ভিড় থাকে। এবারও পর্যটকরা থার্টি ফার্স্ট নাইট উপলক্ষে কক্সবাজারমুখী হয়েছেন।’
তিনি বলেন, ‘পর্যটকদের সেবার মান বাড়াতে এবং সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে একাধিক বৈঠকে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত ও প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। শুধু থার্টি ফার্স্ট নাইট বা বর্ষবরণ নয়, ভরা পর্যটন মৌসুমে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। মনিটরিং কমিটি সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করবে।’
তিনি জানান, সরকারিভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে- এবার উন্মুক্ত স্থানে থার্টি ফার্স্ট নাইটের কোনো আয়োজন করা যাবে না। তাই কক্সবাজারেও কাউকে উন্মুক্ত স্থানে অনুষ্ঠান আয়োজনের অনুমতি দেওয়া হয়নি।
Posted ১১:৩৪ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০২১
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta