কক্সবাংলা ডটকম(২ আগস্ট) :: দেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় ক্ষত তৈরি করছে সড়ক দুর্ঘটনা ও যানজট। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হিসাব বলছে, শুধু সড়ক দুর্ঘটনার কারণে ক্ষতি হচ্ছে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ দশমিক ৬ শতাংশ।
ডব্লিউএইচওর এ হিসাবও বেশ কয়েক বছরের পুরনো। যদিও সড়কে দুর্ঘটনা এখন আগের চেয়ে বেড়েছে।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে, ২০১৭ সালেই প্রায় পাঁচ হাজার সড়ক দুর্ঘটনায় সারা দেশে নিহত হয়েছে ৭ হাজার ৩৯৭ জন। আর চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ২ হাজার ৪৭১ জন। এছাড়া গত তিন বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়েছে চার হাজার মানুষ। সড়কে দুর্ঘটনার মতোই অর্থনীতিতে ক্ষত বাড়াচ্ছে যানজট।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের হিসাব অনুযায়ী, শুধু যানজটের কারণে প্রতি বছর ক্ষতি হচ্ছে দেশের মোট জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ। সব মিলিয়ে সড়ক দুর্ঘটনা ও যানজটে প্রতি বছর ক্ষতি হচ্ছে জিডিপির সাড়ে ৩ শতাংশ।
আইন প্রয়োগে দুর্বলতাকেই সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। ডব্লিউএইচওর পর্যবেক্ষণও বলছে, যানবাহনের গতিসীমা, চালকদের ড্রাইভিং আইন, মোটরসাইকেল হেলমেট আইন— সবগুলোর বাস্তবায়নই খুব দুর্বল। পূর্ণ স্কোর ১০-এর মধ্যে কোনোটিতেই বাংলাদেশের অর্জন ৪-এর বেশি নয়।
সড়কে যানজটের জন্য পরিকল্পনার অভাবকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। চার লেনের সড়ক থাকলেও সেতু আছে দুই লেনের। আবার চার লেনের সেতু থাকলেও সড়ক আছে দুই লেনের। বাস বে না থাকায় সড়কের ওপর গাড়ি থামিয়েই যাত্রী ওঠানো-নামানো হচ্ছে।
রাস্তা দখল করে অবকাঠামো নির্মাণও যানজটের আরো একটি কারণ। নগরীর যানজট হ্রাসে ফ্লাইওভার নির্মিত হলেও তা যানবাহনের গতি না বাড়িয়ে উল্টো কমাচ্ছে।
বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহবুব আলম তালুকদার বলেন, যানজট ও সড়ক দুর্ঘটনায় বিপুল অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে, এটা সবারই জানা।
দেশের সাধারণ মানুষ যেমন জানে, তেমনি নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যারা আছেন, তারাও জানেন। কিন্তু সমাধানের জন্য দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেন না। উল্টো সমস্যা জিইয়ে রাখা হয়। রাস্তায় যখন ১২ বছরের শিশুকে লেগুনা চালাতে দেখি, তখন এমনটা মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়।
সড়ক দুর্ঘটনা, যানজট নিরসনে দূরদর্শী পরিকল্পনার অভাব রয়েছে। এ থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। তা না হলে দেশের অর্থনীতিতে যেমন ক্ষতির পরিমাণ বাড়বে, তেমনি সড়কে মৃত্যুর মিছিলও দীর্ঘ হবে।
সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের পরিসংখ্যান নিয়মিত প্রকাশ করে আসছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। ২০১৭ সালের দুর্ঘটনা ও হতাহতের পরিসংখ্যান গত জানুয়ারিতে প্রকাশ করেছে সংগঠনটি।
তাতে দেখা গেছে, গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৩৯৭ জন নিহত ও ১৬ হাজার ১৯৩ জন আহত হয়েছে। গত বছর এসব হতাহতের ঘটনা ঘটে ৪ হাজার ৯৭৯টি দুর্ঘটনায়।
সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের পরিসংখ্যান প্রকাশ করে আসছে সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষও (বিআরটিএ)। সংস্থাটির হিসাব বলছে, ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ২ হাজার ৩৪৫ জন।
সড়ক দুর্ঘটনার কারণগুলোর অন্যতম ফিটনেসবিহীন যানবাহন। বিআরটিএর হিসাবেই ফিটনেস সনদ নবায়ন হয়নি, এমন যানবাহন রাস্তায় আছে প্রায় ৫০ হাজার। ১০ বছর বা তার বেশি সময় ধরে ফিটনেস সনদ নবায়ন করা হয়নি এসব যানবাহনের।
চালকদের বিরামহীন গাড়ি চালানোও দুর্ঘটনা বাড়িয়ে দিচ্ছে। ইউরোপের দেশগুলোয় টানা সাড়ে ৪ ঘণ্টা গাড়ি চালানোর পর চালককে ন্যূনতম ৪৫ মিনিট বিশ্রাম নিতে হয়। দিনে ৯ ঘণ্টার বেশি গাড়ি চালানো পুরোপুরি নিষিদ্ধ। তবে সপ্তাহে একদিন ১০ ঘণ্টা পর্যন্ত গাড়ি চালানো যেতে পারে। পাশাপাশি চালকদের প্রতিদিন ১১ ঘণ্টা বিশ্রাম নেয়ার কথা বলা হয়েছে। যদিও বাংলাদেশে টানা ১২ ঘণ্টা, এমনকি ১৬ ঘণ্টাও গাড়ি চালাচ্ছেন চালকরা।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. শামছুল হক বলেন, সাধারণত দূরপাল্লার রুটে গাড়ি চালানোর সময় প্রতি ৫ ঘণ্টা পর চালককে বিশ্রাম দেয়ার নিয়ম। কিন্তু আমাদের দেশে এ নিয়মের তোয়াক্কা করা হয় না। উল্টো ঈদের সময় তাদের টানা একাধিক ট্রিপ দিতে বাধ্য করা হয়। একটানা দীর্ঘক্ষণ গাড়ি চালিয়ে ক্লান্ত চালকের পক্ষে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে, যার ফলাফল দুর্ঘটনা।
সারা দেশে অপরিকল্পিত গতিরোধকও সড়কে প্রাণ ঝরাচ্ছে। সারা দেশের সড়ক-মহাসড়কে অপরিকল্পিত গতিরোধক থাকলেও এগুলোর বেশির ভাগই আনমার্কড। অনেক গতিরোধকের সামনে আবার সাইনবোর্ডও নেই। ফলে সহজেই এসব গতিরোধক চালকের চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে। দুর্ঘটনা কমানোর বদলে এগুলো হয়ে উঠছে দুর্ঘটনার কারণ।
চালকের মাদকাসক্তিও সড়ক দুর্ঘটনা বাড়াচ্ছে। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সড়ক দুর্ঘটনার ৩০ শতাংশ ঘটাচ্ছেন মাদকাসক্ত চালক। দুর্বল তদারকির কারণে মাদকাসক্ত চালকরা দিব্যি গাড়ি চালিয়ে নিচ্ছেন।
অর্থনীতিতে বড় ধরনের ক্ষত তৈরি করছে যানজট। সম্প্রতি যানজটের আর্থিক ক্ষতির একটি হিসাব করেছে বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট। তাদের হিসাব অনুযায়ী, প্রতি বছর দেশে যানজটের কারণে যে আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে, তা জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ।
রাস্তা কম, গাড়ি বেশি— মোটা দাগে এটিই ঢাকার যানজটের প্রধান কারণ। যানবাহনও পার্ক করে রাখা হয় সড়কেই। ছোটবড় পরিবহন কোম্পানিগুলো যেমন রাস্তায় রাস্তায় গাড়ি পার্ক করে, তেমনি একই প্রবণতা লক্ষ করা যায় ব্যক্তিগত গাড়িমালিকদের ক্ষেত্রেও। পার্কিংয়ের কারণে কোথাও রাস্তার সিংহভাগ বেদখল হয়ে পড়ে। স্বভাবতই পার্কিংপ্রবণ এলাকায় তীব্র হয়ে ওঠে যানজট।
যানজট কমাতে গত এক যুগে ঢাকা ও চট্টগ্রাম নগরীতে নির্মাণ করা হয়েছে এক ডজন ফ্লাইওভার। যদিও যানজটের ভোগান্তি কমেনি এ দুই নগরের বাসিন্দাদের; উল্টো বাড়ছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, এক দশকে রাজধানীতে যানবাহনের গড় গতিবেগ ২১ কিলোমিটার থেকে কমে দাঁড়িয়েছে সাত কিলোমিটারেরও নিচে।
অপরিকল্পিত এসব ফ্লাইওভারের পাশাপাশি অপ্রতুল রাস্তাঘাট, দুর্বল ব্যবস্থাপনাও যানজটের তীব্রতা বাড়াচ্ছে। ঢাকায় যানজটের তীব্রতা এতটাই বেড়েছে যে, তা সহনীয় মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। এ কারণে ঢাকায় দৈনিক ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে।
Posted ১০:৪৫ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০২ আগস্ট ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta