কক্সবাংলা ডটকম(১১ নভেম্বর) :: ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কেবলি বাড়ছে। নানা প্রণোদনা দিলেও মূলত কিছু মুখ্য সমস্যার সমাধান করা যাচ্ছে না। ফলে, নতুন উদ্যোগ যেমন উত্সাহিত হচ্ছে না তেমনি পুরনো উদ্যোক্তাদেরও নাভিশ্বাস চরমে।
সম্প্রতি ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, শিল্প কারখানাগুলোতে উত্পাদন মারাত্মকভাবে বিঘ্ন ঘটছে। গ্যাস—বিদ্যুতের সমস্যার কারণেই মূলত এই পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে। তদুপরি, পণ্য পরিবহন জটিলতা, বিভিন্ন স্থানে কাগজপত্র যাচাইয়ের নামে হয়রানিসহ নানাবিধ জটিলতায় রফতানিবাজারও বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে কারখানা বন্ধ না হয়ে উপায় কী! তাতে ব্যাংকে খেলাপি হওয়াই স্বাভাবিক। উপরন্তু, নীতিগ্রহণেরও সমস্যা রয়েছে। নীতির ধারাবাহিকতা বজায় না থাকা, বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে নীতিমালার শিথিলতা, গোষ্ঠীবিশেষের জন্য বিশেষ সুবিধা প্রভৃতি কারণে সত্ ও প্রকৃত উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যবসায় টিকে থাকা কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদের ক্ষেত্রে ব্যাংক গ্রাহক সম্পর্কও গুরুত্ব পাচ্ছে না। অথচ, ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্ককে বিশেষ প্রাধান্য দেওয়ার বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনায়ও রয়েছে।
ব্যাংকিং সূত্র মতে, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার কারণে পণ্যমূল্য কমছে। তদুপরি, ডলারের দামও বেড়েছে। একটি প্রকল্পের বিপরীতে যখন ঋণ প্রদান করা হয়, তখন ডলারের যে মূল্য থাকে পরবর্তীতে তা বেড়ে যায়। বর্তমানে ডলারের মূল্য ৮২ টাকা। এর সঙ্গে শ্রম মজুরি, কাঁচামালসহ আনুষঙ্গিক খরচও বেড়ে যায়। যা সামগ্রিক ব্যয় কাঠামো বাড়িয়ে দেয়। ফলে, তুলনামূলক কম মুনাফায় বাড়তি খরচের বহর মোকাবেলা করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এরই মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সুবিধা না থাকায় কারখানাগুলো পুরোদমে উত্পাদনে যেতে পারছে না।
তিতাস গ্যাসের সাভার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, সাভার এলাকায় গ্যাসের চাহিদা প্রতি ঘন্টায় ৯৭ লাখ ৬৫ হাজার ৮৫৩ ঘন ফুট। এর মধ্যে শিল্প কারখানায় চাহিদা প্রতি ঘন্টায় প্রায় ৮২ লাখ ঘন ফুট। এছাড়া আবাসিক এলাকায় ১৭ লাখ ৯৩ হাজার ৪৮৭ ঘন ফুট, অন্যান্য বাণিজ্যিক খাতে ২৫ হাজার ৮৯৭ ঘন ফুট। এর মধ্যে ডিইপিজেডেই প্রতি ঘন্টায় ১৪ লাখ ৫৫ হাজার ৮০৯ ঘন ফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু এর বিপরিতে গ্যাস পাওয়া যায় ২৫ থেকে ৩০ ভাগ। গ্যাস সংকটের কারণে অনেক শিল্প কারখানাই দিনে গড়ে কয়েক ঘন্টা বন্ধ থাকে।
যৌক্তিক কারণে ঋণের কিস্তি পরিশোধে সামর্থ্যহীন হয়ে পড়া এসব কারখানা মালিককে কোনোরূপ প্রণোদনা দেয়া না হলেও বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে সুবিধা দেয়া হচ্ছে। এমনকি সুবিধার পর সুবিধা তারা নিচ্ছেন। যারা এসব সুবিধা নিচ্ছেন তাদের ব্যবসায়িক ইমেজও প্রশ্নবিদ্ধ। কিন্তু প্রকৃত অর্থেই যারা উত্পাদন বাধাগ্রস্ত হওয়ার কারণে ব্যাংকের কিস্তি দিতে হিমশিম খাচ্ছে তাদের বিষয়টা উপেক্ষিত রয়েই যাচ্ছে।
সূত্র জানায়, ইচ্ছেকৃত খেলাপিদের দৌরাত্ম্য এতই বাড়ছে যে অযাচিত হস্তক্ষেপে ঋণ অনুমোদনসহ খেলাপি হওয়ার পরও বিশেষ সুবিধা ভোগ করছে তারা। এ অবস্থায় প্রকৃতই যারা টিকতে না পেরে খেলাপি হয়ে যাচ্ছে তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নেয়া এবং দেউলিয়াত্বের পথে হাঁটা ছাড়া গত্যন্তর থাকছে না।
সর্বশেষ তথ্যমতে, চলতি বছরের জুনে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৪ হাজার ১৮৪ কোটি টাকা। যা বিতরণ হওয়া ঋণের ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ। ২০১৬ সালের জুনে এ পরিমাণ ছিল ৬৩ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা। সে হিসাবে গত এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১০ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক হলেও ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি ফিরছে না। উদ্যোক্তারা নতুন করে বিনিয়োগে আসছেন না। অভ্যন্তরীণ ভাবে প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে অনেকেই শিল্পকারখানা বন্ধ করে দিচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে একদিকে যেমন ব্যাংকের ঋণ বিতরণ বাড়ছে না, অন্যদিকে খেলাপির পরিমাণও বাড়ছে। শুধু বড় ঋণ খেলাপিই নয়, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) এক গবেষণায় দেখা গেছে, এসএমই খাতেও খেলাপি ঋণ বাড়ছে। ২০১০ থেকে ২০১৬ সালে এই ছয় বছরে শুধু এসএমই খাতে খেলাপি বেড়েছে সাড়ে আটগুণ।
এছাড়াও ব্যাংকগুলোতে অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা এবং সঠিক উদ্যোক্তাকে না দিয়ে নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানে ঋণ দেয়ার কারণে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী বলেন, ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে না পারলে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী কৌশলে ব্যাংকের অর্থ হাতিয়ে নেবেন, যা আর ফেরত পাওয়া যাবে না। এর লাগাম টানতে হবে। তা না হলে সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতসহ দেশের গোটা অর্থনীতিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
Posted ১০:২১ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ১১ নভেম্বর ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta