কক্সবাংলা ডটকম :: দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি নাজুক অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। অর্থনীতির সব সূচকই এখন নিম্নমুখী। রিজার্ভ কমতে কমতে একেবারে তলানিতে ঠেকেছে। গার্মেন্টস খাতের অস্থিরতায় ঝুঁকিতে পড়েছে রফতানি আয়। প্রণোদনাসহ নানা উদ্যোগেও বাড়ছে না রেমিট্যান্স।
ডলারের বাজার আরও টালমাটাল, খোলা যাচ্ছে না প্রয়োজনীয় এলসি। আমদানি কমছে মেশিনারিজের, কমছে বিনিয়োগ। থমকে আছে নতুন কর্মসংস্থান। বহুমখী সংকট ঘিরে ধরেছে ব্যাংক খাতকে। সরকারের আয় আসবে যেখান থেকে সেই রাজস্ব আয়ের অবস্থাও ভালো না।
ধুঁকতে থাকা শেয়ারবাজারেও নেই কোনো আশার আলো। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে দেশের মানুষে ত্রাহি অবস্থা। এই অবস্থার মধ্যে অর্থনীতির নতুন বিষফোড়া হয়ে দেখা দিয়েছে হরতাল-অবরোধ। সবমিলে দেশের অর্থনীতির ক্ষত আরও গভীর হচ্ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। সেই সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যও গভীর সংকটের দিকে যাচ্ছে বলে মনে করছেন উদ্যোক্তারা।
অর্থনীতিবিদদের কেউ বলছেন, সামনে জাতীয় নির্বাচন থাকায় সকলের নজর এখন সে দিকে, অর্থনীতির দুরবস্থা নিয়ে ভাবছে না কেউ।
আবার কোনো অর্থনীতিবিদ বলছেন, এই ভঙ্গুর অর্থনীতির প্রকট প্রভাবে সামনে আরও কঠিন সময় অপেক্ষা করছে।
দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির বর্তমান গতিপ্রকৃতি নিয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, গত তিন বছর ধরেই দেশের অর্থনীতিতে একটা মৃদু মন্দাভাব চলে আসছে। ২০২০ ও ২০২১ সাল করোনায় এক রকম থমকে ছিল দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে কিছুটা ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে অর্থনীতি। ঠিক তার পরপরই শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ।
এই যুদ্ধের প্রভাব দেশের রফতানি বাণিজ্য ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত করেছে, রফতানি আয় কমার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। এই অবস্থার মধ্যে আবার দেশে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। হরতাল-অবরোধ ফিরে এসেছে। এভাবে একের পর এক বাধা আসার কারণে অর্থনীতি ধীরে ধীরে ভঙ্গুর অবস্থায় এসে পৌঁছেছে।
শুধু তাই নয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ সরকারের নীতিনির্ধারণী যেসব প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা রয়েছে তাদেরও দায় রয়েছে এই অবস্থার জন্য। সংস্থাগুলো অর্থনীতির প্রয়োজনে সময়মতো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারেনি
। এর সবচেয়ে প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো এই টালমাটাল ডলারের বাজার। আমরা প্রায় ২ বছর আগে থেকে বলে আসছিলাম টাকার সঙ্গে ডলারের মান ঠিকমতো সমন্বয় করার। টাকার মান ধারাবাহিকভাবে বাড়িয়ে যখন গলায় এসে আটকে গেছে, তখন আর সামলাতে পারছে না। এখন বাধ্য হয়ে ডলারের দাম বাড়াতেই হচ্ছে।
সুতরাং সময়মতো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেওয়ার কারণেও দেশের অর্থনীতির সংকট বেড়ে গেছে। এখন আবার সবার নজর নির্বাচনের দিকে, ভঙ্গুর অর্থনীতি নিয়ে তেমন কাউকে ভাবতে দেখছি না, ভালো কোনো পদক্ষেপ দেখছি না। এর কুফলও সামনে ভোগ করতে হবে।
সবচেয়ে বড় শঙ্কা রিজার্ভ নিয়ে : অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় শঙ্কার জায়গা এখন অব্যাহতভাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া। বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে ঠেকেছে ১৯ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার বা ১ হাজার ৯৬০ কোটি ৩৭ লাখ মার্কিন ডলার।
উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ : খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখন প্রায় ১২ শতাংশের কাছে। কিছু উদ্যোগ নিলেও মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে পারেনি সরকার, বরং খাদ্য মূল্যস্ফীতি হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে, যা এখন বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মূল্যস্ফীতির হিসাবে গত ১ বছরে মানুষের খরচ ৯ শতাংশের বেশি বেড়েছে। গত আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে।
গার্মেন্টসে অস্থিরতা ও রফতানি আয় : মজুরি ইস্যুকে ঘিরে দেশের প্রধান রফতানি খাত তৈরি পোশাক শিল্পে চলছে অস্থিরতা। বিগত কয়েক মাস ধরে কমছে রফতানি আয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জার্মানিসহ বৃহৎ বাজারগুলোতেও কমছে গার্মেন্টস রফতানি। এর মধ্যে আবার মজুরি ইস্যুকে ঘিরে শ্রমিক আন্দোলনের সময় শ্রমিকদের ওপর হামলা-মামলা হয় এবং চারজন শ্রমিক নিহতের ঘটনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশে^র ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো উদ্বেগ জানিয়েছে এবং বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিয়ে রেখেছে। ফলে সামনের দিনগুলোতে এই পরিস্থিতি আরও জটিল হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ধারাবাহিকভাবে রফতানি আয় কমে যাওয়ায় অর্থনীতিতে সংকট আরও গভীর হবে। বাংলাদেশ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যমতে, গত মাসে অর্থাৎ অক্টোবরে দেশে রফতানি কমেছে ১৩.৬৪ শতাংশ। এ মাসে রফতানি আয় এসেছে ৩ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার, যা ১ বছর আগে ছিল ৪ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার।
গতি কমছে রেমিট্যান্সে : এ বছর সেপ্টেম্বরে ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন রেমিট্যান্স এসেছে দেশে। অক্টোবর মাসেও রেমিট্যান্স প্রবাহ আশানুরূপ হয়নি। গত সেপ্টেম্বর মাসে দেশে রেমিট্যান্স আসে ১৩৪ কোটি ৩৬ লাখ ৬০ হাজার ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় (১ ডলার সমান ১০৯.৫০ টাকা ধরে) যা ১৪ হাজার ৭১২ কোটি টাকা। ২০১৯ সালের মে মাসে ১২৭ কোটি ৬২ লাখ ২০ হাজার ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল।
কমছে রাজস্ব আদায় : এনবিআরের হিসাবে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ২ মাসে (জুলাই-আগস্ট) ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আদায় ঘাটতি হয়েছে। চলতি অর্থবছরে এনবিআরের জন্য সব মিলিয়ে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার শুল্ক-কর আদায়ের লক্ষ্য ঠিক করা হয়। চলতি নভেম্বর মাসের শুরু থেকে চলছে আয় কর আদায় কার্যক্রম। মাস শেষ হতে চললেও এবার আশানুরূপ সাড়া মিলছে না রাজস্ব আদায়ে। ফলে সরকারের আয় বাড়ছে না।
বহুমুখী সংকটে ব্যাংক খাত : বাংলাদেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাত বহুমুখী ঝুঁকিতে পড়েছে। এর মধ্যে ব্যাংকগুলোতে সুদের হার বৃদ্ধি, ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার অস্বাভাবিকভাবে কমে যাওয়া, খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া, এর বিপরীতে মূলধন হ্রাস, আয় কমে যাওয়া, ঋণ আদায় কম হওয়াসহ নানা ঝুঁকির মুখে পড়েছে আর্থিক খাত। বিশেষ করে ব্যাংকগুলোতে এখন আমানত সংকট প্রকট আকারে দেখা দিয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্যে দেখা যায়, গত ডিসেম্বরের তুলনায় মার্চে ব্যাংকগুলোর ঋণ আদায় কমেছে, বেড়েছে খেলাপি ঋণ। এতে ব্যাংকগুলোর মূলধন কমে গেছে। একইসঙ্গে ঋণ থেকে সুদ আয় ও মূলধন থেকেও আয় কমে গেছে। ফলে সার্বিকভাবে ব্যাংকগুলোর আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। মূলধন কমা ও খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণে ব্যাংকগুলোর আর্থিক ভিত্তিতে দুর্বলতা দেখা দিয়েছে। ডলার সংকটের কারণে এখনও ব্যাংকগুলো স্বাভাবিক বৈদেশিক বাণিজ্য করতে পারছে না।
উল্টো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার কিনে দেনা শোধ করায় তারল্যের একটি বড় অংশ আটকে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। এর বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে চড়া সুদে অর্থ ধার করে ব্যাংকগুলোকে তারল্য ব্যবস্থাপনা করতে হচ্ছে। এতে তাদের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। ফলে সংকট থেকে বের হতে পারছে না ব্যাংকগুলো। একই অবস্থা দেশের শেয়ারবাজারে। শেয়ারবাজার এখন এক রকম ধুঁকছে। লেনদেন নামছে একেবারে তলানিতে, কমছে সূচক। সবমিলে শেয়ারবাজার থেকেও মিলছে না কোনো সুখবর।
হরতাল-অবরোধ : বিরোধী দলগুলো আবারও টানা হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি দিচ্ছে। এতে অর্থনীতির সংকট আরও ঘনীভূত হবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা। বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম।
তিনি বলেন, নানা সংকটের মধ্যে শুরু হয়েছে হরতাল-অবরোধ। তা হলে আমরা যারা উদ্যোক্তা তারা কীভাবে ব্যবসা করব, কীভাবে ঘুরবে কারখানার চাকা। হরতালের কারণে শিল্পের কাঁচামাল সময়মতো পাওয়া যাচ্ছে না। রফতানি পণ্য সরবরাহ দুরূহ হয়ে পড়েছে।
অভ্যন্তরীণ বাজারে পণ্য সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে। পাশাপাশি বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থায় স্থানীয় বাজারে পণ্যের চাহিদাও অনেক কমে গেছে। এতে ব্যবসা-বাণিজ্য বিঘ্নিত হচ্ছে। এদিকে এর আগে যখন ২০১৩-১৪ সালের দিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা হয়েছিল, তখন ১ লাখ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছিল ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই।
সংকট থেকে উত্তরণের উপায় কী-এ বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, প্রথম কথা হলো, দেশের অর্থনীতিতে যে সংকট চলছে তা সহজে কাটবে বলে আমার মনে হয় না, বরং সামনে আরও বাড়বে। তা ছাড়া এই সংকটের কারণে সামনে আরও কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হতে পারে। এখন কথা হচ্ছে এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কী। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে দেশের অর্থনীতিতে বা আর্থিক খাতগুলোতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে।
মুদ্রানীতির সংস্কার করতে হবে। সুদের হার বাড়ালে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হবে। বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা উচিত। ৫০ শতাংশ এককালীন পরিশোধ করে ঋণ পুনঃতফসিল করার সুবিধা দেওয়ার পরও খেলাপি ঋণ ২৫ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। এ ধরনের অসৎ আচরণকে প্রশ্রয় দেওয়া বন্ধ করতে হবে। সার্বিকভাবে আর্থিক ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের সংস্কার করতে হবে। সবার আগে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও সংকট সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। এতে কম আয়ের মানুষ গভীর সংকট থেকে রেহাই পাবে।
Posted ২:২৬ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৩
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta