কক্সবাংলা ডটকম(২ ফেব্রুয়ারি) :: ঢাকার দুই সিটিতে দুই মেয়রসহ অধিকাংশ ওয়ার্ডে দলীয় কাউন্সিলর প্রার্থীরা জয়ের হাসি হাসলেও ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি হতাশাজনক হওয়ায় চরম অস্বস্তিতে পড়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এ জন্য তারা প্রকাশ্যে বিএনপিকে দুষলেও ভেতরে ভেতরে নিজেদের দুর্বলতা কাটিয়ে নির্বাচনকে চেনারূপে ফেরানোর পথ খুঁজছে। পাশাপাশি সিটি নির্বাচনকে উৎসবমুখর করতে দলের বিদ্রোহী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সর্বোচ্চ ছাড় দেওয়াসহ কৌশলী নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা কিভাবে ব্যর্থ হলো তা খতিয়ে দেখতে দলীয় হাইকমান্ড জোরালো তাগিদ দিয়েছে।
দলীয় সূত্র জানায়, আগামীতে কী করলে ভোটারের উপস্থিতি বাড়বে তা নিয়ে দলের মধ্যে এর মধ্যে নানা বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে। এ ক্ষেত্রে দল ও সরকারের কী কী করণীয় থাকতে পারে সে বিষয়েও চিন্তাভাবনা চলছে। যদিও দলের কোনো দায়িত্বশীল নেতা এ ব্যাপারে সরাসরি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
তবে দলের যেসব গুরুত্বপূর্ণ নেতা সিটি নির্বাচনের দায়িত্ব সমন্বয় করেছেন তাদের একটি সূত্র জানায়, ঢাকার দুই সিটিতেই নির্বাচনটা যেন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয় এ জন্য দল ও সরকারের পক্ষ থেকে চেষ্টার কোনো কমতি ছিল না। প্রচার-প্রচারণার মাঠে ভোটের আমেজ ধরে রাখতে একাধিক ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদ উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে দলীয় বিদ্রোহীদের ব্যাপারে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতারা অনেকে গোপনে বিদ্রোহী প্রার্থীদের উৎসাহ দিলেও দলীয় হাইকমান্ড তা জেনেও না জানার ভান করেছে।
অন্যদিকে ভোটের পরিবেশ উৎসবমুখর রাখতে তৃণমূলে নেতাদের বারবার নানা নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে ভোটের দিন যাতে কোনো কেন্দ্রে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি না হয় সে বিষয়েও হাইকমান্ড সবাইকে সতর্ক করেছে। তবে এসব উদ্যোগ নেওয়ার পরও ভোটের মাঠে কেন ভোটারদের আকৃষ্ট করা যায়নি তা এখন দলের কাছে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে পর্যালোচনা করে আগামী নির্বাচন উৎসবমুখর করে তোলার পথ খোঁজা হচ্ছে বলে জানায় দায়িত্বশীল ওই সূত্রটি।
বিষয়টি স্বীকার করে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর এক সদস্য এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কমের জন্য আমাদের দায় না থাকলেও অস্বস্তি কিছুটা আছে। কীভাবে এটা কাটানো যায় তা নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে। তবে এটাও সত্য কেউ যদি নির্বাচনে না আসে তাহলে কিন্তু তাকে জোর করে নিয়ে আসা যায় না। আবার কোনো পক্ষ যদি নির্বাচনকে বিতর্কিত করতে ভোটের মাঠে আতঙ্ক ছড়ায়, তাহলেও ভোটারের সংখ্যা কিছুটা কমবে-এটাই স্বাভাবিক। আমরা আগেও চেষ্টা করেছি ভোট প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও উৎসবমুখর করতে, সামনের ধাপগুলোতেও সেই চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।’
তবে ভোটার উপস্থিতি কম বলেই যে নির্বাচন থেকে মানুষের আগ্রহ কমে গেছে-এমনটা মানতে নারাজ আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। তাদের মতে, উৎসবমুখর ভোট করতে সব রাজনৈতিক দলেরই সদিচ্ছা থাকতে হবে। এছাড়া ঢাকার দুই সিটির বেশির ভাগ ওয়ার্ডেই এবার বিএনপি শক্তিশালী ও যোগ্য প্রার্থী দিতে পারেনি। যে কারণে ভোটের মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বিতা জমে ওঠেনি।
এ ব্যাপারে যুক্তি দেখিয়ে তারা বলেন, খেলার সময় আমরা যদি আগেই জানি যে ফলাফল কী হবে, তাহলে লোকজনের আগ্রহ একটু কমই থাকবে। আওয়ামী লীগের মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের তুলনায় বিএনপির প্রার্থীরা কতটা দুর্বল ছিল-তা দু’পক্ষের প্রাপ্ত ভোটের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে সহজেই চোখে পড়বে বলে দাবি করেন সংশ্লিষ্টরা।
যদিও ভোটকেন্দ্রে ভোটারের কম উপস্থিতির জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারকেই দুষেছেন নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলেন, নির্বাচনের মাত্র তিন দিন আগে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, ‘তাদের কাছে খবর আছে- বিএনপি ভোটকেন্দ্র দখলের জন্য বহিরাগত অস্ত্রধারীদের ঢাকায় জড়ো করছে। তারা পাঁয়তারা করছে বহিরাগত গুন্ডাদের জড়ো করে নির্বাচনের পরিবেশকে ক্ষুণ্ন করতে। পুলিশের বিরুদ্ধেও তারা তাদের স্বশস্ত্র মহড়া দিতে চায়।’
সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, ওবায়দুল কাদেরের মতো আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতা এমন খবর জানালে স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ ভোটারদের মধ্যে ভীতির সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে ভয়েই অনেকে ভোটকেন্দ্রে যেতে সাহস পায়নি। এ ছাড়া যারা কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে ভোটের পরিবেশ জানতে ঘরের বাইরে বেরিয়েছেন, তারাই ভোটকেন্দ্রের আশপাশে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মহড়া দিতে দেখেছেন। এতে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে অনেকে দূর থেকেই ফিরে এসেছেন।
নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা জানান, ভোটকেন্দ্রের ৪শ গজের মধ্যে নির্বাচনী ক্যাম্প না করার জন্য নির্বাচন কমিশনের সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা থাকলেও বেশির ভাগ কেন্দ্রেই ক্ষমতাসীনরা তা মানেনি। কোনো কোনো কেন্দ্রের ৫০ গজের মধ্যে নৌকা ও আওয়ামী লীগের দলীয় কাউন্সিলর প্রার্থীরা একাধিক নির্বাচনী ক্যাম্প করে তাদের দলীয় নেতাকর্মী বসিয়ে উত্তপ্ত মহড়া দিয়েছেন, যা নির্বাচন কমিশন দেখেও না দেখার ভান করেছে। এসব কারণে সাধারণ ভোটাররা তাদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন, যা ভোটার অনুপস্থিতির অন্যতম কারণ বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা।
তাদের এ অনুমান যে একেবারে অমূলক নয়, তা সাধারণ ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে আভাস পাওয়া গেছে। মতিঝিল এলাকার গৃহবধূ শাহানাজ পারভীন জানান, তিনি মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলে ভোট দিতে গিয়ে দেখেন, কেন্দ্রের দেয়াল ঘেঁষে একাধিক নির্বাচনী ক্যাম্প রয়েছে। সেখানে বসে থাকা নেতাকর্মীরা ভোটারদের নির্দিষ্ট মার্কায় ভোট দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছেন, যা দেখে পরে তিনি ভোট না দিয়েই ফিরে এসেছেন।
একই ধরনের অভিযোগ করেছেন, খিলগাঁওয়ের জোড়পুকুর এলাকা ভোটার মহাসীন আলী। তিনি জানান, খিলগাঁও মডেল কলেজে ভোট দিতে গিয়ে দেখেন কেন্দ্রের সামনের রাস্তার বিপরীতে টানা ক্যাম্প বসিয়ে সহস্রাধিক নেতাকর্মী সকাল থেকে মহড়া দিচ্ছে, যা তাকে ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলেছে। তাই তিনি স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে ভোট না দিয়েই ঘরে ফিরেছেন।
এ প্রসঙ্গে একজন সাবেক নির্বাচন কমিশনার বলেন, এ ধরনের নির্বাচনী পরিবেশের কারণে বেশির ভাগ ভোটার ভোটকেন্দ্রে যেতে সাহস পাননি। এই অবস্থা গণতন্ত্রের জন্য অশনিসঙ্কেত উলেস্নখ করে তিনি বলেন, এহেন নির্বাচনবিমুখতা গণতন্ত্রবিমুখতায় পর্যবসিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এদিকে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার জন্য নানাভাবে বিএনপিকে দুষেছেন। তাদের অভিযোগ, বিএনপির প্রার্থীদের ভোটের আগে বিভিন্ন বক্তব্য ও কূটনীতিকদের নানা কথাবার্তা মিলিয়ে ভোটারদের মধ্যে এক ধরনের দ্বিধা তৈরি হয়েছে। ফলে ভোটার উপস্থিতি কিছুটা কম হয়েছে। আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক দলের এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘বিএনপির প্রার্থী ইশরাক হোসেন গত কয়েক দিন ধরে যেসব কথাবার্তা বলছেন, শনিবারও ভোট দিয়ে বলেছেন, আহত বা নিহত যাই হই, ভোটকেন্দ্র ত্যাগ করব না। তার কথা দাঙ্গাবাজ, উসকানিমূলক কথা। এ ধরনের কথাবার্তা এবং বিএনপির আচরণ মানুষকে একটু ভাবিয়ে তুলেছিল, এ কথা অস্বীকার করা যাবে না।’ এ ছাড়া বিদেশি কূটনীতিকদের তৎপরতা, ভোটারদের অলসতা, শীতের বিষয় এবং সব মিলিয়ে ভোটারদের মধ্যকার দ্বিধা-ভোটার উপস্থিতি কমিয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
এদিকে ঢাকার দুই সিটির ভোটে ভোটারের কম উপস্থিতির বিষয়টি আকস্মিক কোনো ঘটনা নয় বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। বরং এটি বিগত ভোটের ধারাবাহিকতা বলে দাবি করেন তারা। বিগত সময়ের বেশ কয়েকটি নির্বাচনের ভোটার উপস্থিতির চিত্র তুলে ধরে তারা বলেন, ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আকৃষ্ট করার তাগিদ বড় দুই দলের কারোরই তেমন নেই। বরং এ নিয়ে পানি ঘোলা করতেই তারা ব্যস্ত বলে অভিযোগ করেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা।
প্রসঙ্গত, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে সব ভোট বর্জন করছে বিএনপি ও তাদের জোট শরিকরা। ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র পদের উপনির্বাচন এবং উত্তর দক্ষিণের নতুন ওয়ার্ডগুলোর নির্বাচনে বিএনপি আসেনি। যদিও সেখানে নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে দলীয় প্রার্থী না দিয়ে উন্মুক্ত রাখে আওয়ামী লীগ। তাতে ওয়ার্ডগুলোতে কিছুটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও উৎসবমুখর ভোট হলেও মেয়র পদে ভোট জমেনি। এ পদে ভোট পড়ে ৩১.০৫ শতাংশ। এরপর আসে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। এ নির্বাচনও বর্জন করে বিএনপি। উপজেলাতেও চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রার্থী দিলেও ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রার্থিতা উন্মুক্ত রাখে ক্ষমতাসীনরা। কিন্তু তাতেও নির্বাচনী আমেজ ফেরেনি।
সদ্য অনুষ্ঠিত ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বিদেশি কূটনীতিকদের অবহিত করেছে আওয়ামী লীগ।
রোববার রাতে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সংশ্লিষ্ট উপকমিটির পক্ষ থেকে রাজধানীর একটি হোটেলে কূটনীতিকদের নির্বাচনের বিষয়ে অবহিত করা হয়।
এ সময় যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জার্মানি, ইতালিসহ ৩০ দেশের কূটনীতিকরা উপস্থিত ছিলেন।
এ সময় আলোচকরা জানান, আওয়ামী লীগের মাধ্যমে দেশে হওয়া উন্নয়নের কারণেই ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন দলটির দুই প্রার্থী।
প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক সম্পাদক ড. শাম্মী আহমেদসহ বিভিন্ন কূটনীতিক মিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ইভিএম নিয়ে বিস্তারিত জানানো হয় কূটনীতিকদের।
Posted ১:২৪ পূর্বাহ্ণ | সোমবার, ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta