কক্সবাংলা ডটকম(১৫ ডিসেম্বর) :: কয়েক বছর ধরেই দেশের ব্যাংকিং খাতে আর্থিক অপরাধ বাড়ছে। পুরো ব্যাংকিং খাতকে নাড়িয়ে দেয়ার মতো বড় কেলেঙ্কারিও এর মধ্যে সংঘটিত হয়েছে। ব্যাংকিং খাতসংশ্লিষ্টদের নৈতিকতার ঘাটতিকে এর প্রধান কারণ বলে মনে করছেন খোদ ব্যাংকাররাই।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) গবেষণা অনুযায়ী, দেশের প্রায় ৭৩ শতাংশ ব্যাংকারই মনে করেন, নৈতিকতার ঘাটতি থেকেই ব্যাংকিং খাতে আর্থিক অপরাধ বাড়ছে।
২০০ জন ব্যাংকারের ওপর জরিপ চালিয়ে গবেষণা প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে বিআইবিএম। ‘করপোরেট এথিকস অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইন ব্যাংকস: বাংলাদেশ পারসপেক্টিভ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনটি রাজধানীর মিরপুরে বিআইবিএম অডিটোরিয়ামে এ-সংক্রান্ত এক কর্মশালায় উপস্থাপন করা হয়।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, অপরাধে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়াকে এ খাতে আর্থিক অপরাধ বৃদ্ধির কারণ বলে মনে করেন ৫৮ শতাংশ ব্যাংকার। অপরাধ সম্পর্কে ধারণা না থাকার কারণে এ ধরনের অপরাধ বাড়ছে ৫৩ শতাংশ ব্যাংকারের মতে। আর ৫০ শতাংশ ব্যাংকার মোটিভেশনের অভাবকে ও ২৭ শতাংশ স্বল্প বেতনকে আর্থিক অপরাধের কারণ বলে মনে করেন।
গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন বিআইবিএমের পরিচালক ড. শাহ মো. আহসান হাবীব। বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণে ব্যাংকিং খাত বিশেষজ্ঞরা এর ওপর বক্তব্য রাখেন। কর্মশালায় সভাপতিত্ব করেন বিআইবিএমের মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমদ চৌধূরী। প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান।
নৈতিকতার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও বিআইবিএমের সুপারনিউমারারি অধ্যাপক ইয়াছিন আলি বলেন, ব্যাংকিং খাতে নৈতিকতা খুবই জরুরি। কারণ এখানে অন্যের টাকায় ব্যবসা করা হয়। সব ক্ষেত্রেই কাউকে না কাউকে রোল মডেল হিসেবে নিতে হবে।
তবে ব্যাংক ম্যানেজার যদি অপরাধী হন, তাকে রোল মডেল হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না। যদিও এ অপরাধীর চেয়েও বড় অপরাধী ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা। তাদের শাস্তি হওয়া উচিত। পৃথিবীর সব দেশে এ ধরনের ঋণখেলাপিরা শাস্তি পেয়ে থাকে।
ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় দুর্বলতা ও স্বাধীন অভ্যন্তরীণ অডিট না থাকাও দেশের ব্যাংকিং খাতে অপরাধ সংঘটনের অন্যতম কারণ। বিআইবিএমের গবেষণায় অংশগ্রহণকারী ৭০ শতাংশ ব্যাংকারই এটিকে আর্থিক অপরাধের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ব্যাংকিং আইন ও বিধি সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণেও আর্থিক অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে বলে মনে করেন ৬০ শতাংশ ব্যাংকার।
বিশ্বব্যাপীই ব্যাংকিং খাতে সুশাসন বাস্তবায়ন করা হয় জানিয়ে ড. তৌফিক আহমদ চৌধূরী বলেন, বিশ্বব্যাপী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের মূল কাজ হলো নীতি প্রণয়ন ও নজরদারি করা। কিন্তু বাংলাদেশে এর অভাব রয়েছে। আমাদের এখানকার ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদ সুশাসন বাস্তবায়নের চেয়ে ঋণ অনুমোদনেই বেশি ব্যস্ত থাকে।
মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় সবখানেই দেখা দিয়েছে মন্তব্য করে সোনালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসএ চৌধুরী বলেন, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির কারণে ব্যাংকের ওপর মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে। ব্যাংকের ওপর মানুষ এখন আর ভরসা করতে পারছে না। এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। মানুষের কষ্টের কথা শোনার জন্য আর্থিক ন্যায়পাল গঠনেরও পরামর্শ দেন তিনি।
ব্যাংকের আস্থা সংকট খেলাপি ঋণের চেয়েও ভয়াবহ বলে মন্তব্য করেন মেঘনা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নূরুল আমিন। তার মতে, ইমেজ সংকট একটি ব্যাংকের জন্য সবচেয়ে খারাপ দিক।
বিআইবিএমের গবেষণা বলছে, ২০১৪ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে দেশের ৬৫ শতাংশ ব্যাংকেই কোনো না কোনো আর্থিক অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। এসব অপরাধের মধ্যে ৬৫ শতাংশের ক্ষেত্রে ব্যাংক নিজ থেকে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। ৩৫ শতাংশ অপরাধের বিষয়ে ব্যাংকের পক্ষ থেকে কোনো কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান বলেন, ব্যাংকিং ব্যবসা সম্পূর্ণভাবে আস্থার ওপর নির্ভরশীল। আমানতকারীদের আস্থার সংকট শুরু হলে ব্যাংকিং ব্যবসা করা কঠিন হয়ে পড়ে। সম্প্রতি একটি ব্যাংক আমানতকারীদের আস্থার সংকটের কারণে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। গ্রাহকরা আমানতের অর্থ ফিরিয়ে নিতে চাইলেও ব্যাংকটি চাহিদামতো সে অর্থ ফিরিয়ে দিতে পারছে না। এ সংকট ব্যবস্থাপনা ব্যাংকটির জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমদানি-রফতানিভিত্তিক অর্থ পাচারের অভিযোগ প্রায়ই উঠছে জানিয়ে তিনি বলেন, মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির ক্ষেত্রেই অভিযোগটা সবচেয়ে বেশি। তবে অর্থ পাচার নিয়ে যে তথ্য প্রচার করা হচ্ছে, তা অনেকাংশেই সত্য নয়। সুইচ ব্যাংকে বাংলাদেশীদের যে পরিমাণ অর্থ রাখার কথা বলা হয়, তার পরিমাণ অত বেশি হবে না। এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে দেয়া হয়েছে।
অর্থ পাচার ঠেকাতে বাংলাদেশ ব্যাংক সবসময় কঠোর অবস্থানে রয়েছে। সব ধরনের অর্থ পাচার ঠেকাতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) যৌথভাবে কাজ করছে।
অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন পূবালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বিআইবিএমের সুপারনিউমারারি অধ্যাপক হেলাল আহমেদ চৌধুরী ও প্রাইম ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহমেদ কামাল খান চৌধুরী।
Posted ১১:২৮ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta