কক্সবাংলা ডটকম(১৯ আগস্ট) :: পাহাড়ে সংঘাতে মৃত্যুর মিছিল যেন থামছেই না। আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে প্রাণ হারাচ্ছেন আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও সাংবাদিকদের হিসাবে, গত ১০ মাসে একের পর এক হামলা-পাল্টা হামলার ঘটনায় অন্তত ৩৩ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। তবে বেশির ভাগ ঘটনায়ই থানায় কোনও মামলা হয়নি।
সর্বশেষ শনিবার (১৮ আগস্ট) সকালে পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়িতে একটি কর্মসূচি পালনের জন্য জড়ো হতে থাকা ইউপিডিএফ সদস্যদের লক্ষ্য করে সন্ত্রাসীরা গুলি ছোড়ে। এলোপাতাড়ি গুলিতে ছয় জন নিহত ও তিন জন আহতের খবর পাওয়া গেছে। এই ঘটনায় এলাকায় আতঙ্ক বিরাজ করছে। সাধারণ মানুষ কোনও জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাসা থেকে বের হচ্ছেন না। স্বনির্ভরসহ আশপাশের এলাকায় দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। চলাচল করছে না খাগড়াছড়ি-পানছড়ি সড়কের যানবাহন।
ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) মুখপাত্র নিরন চাকমা বলেন, ‘জেএসএস (এমএন লারমা) গ্রুপের নেতা তারিন্দ্র লালের (পেলে) নেতৃত্বে এই হামলা ঘটেছে বলে আমার প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছি। এলাকাবাসীকে নিয়ে জেএসএস (এমএন লারমা) ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) এর সন্ত্রাসী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে আজ সমাবেশ হওয়ার কথা ছিল। সেই কর্মসূচি পালনের জন্য জড়ো হতে থাকা দলীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের ওপর হামলা করেছে। প্রশাসনের নাকের ডগায় এভাবে সন্ত্রাসীরা হামলা করেছে এবং তাদের কেউ ধরার চেষ্টাও করেনি।’
অভিযোগ অস্বীকার করে জেএসএস (এমএনলারমা) কেন্দ্রীয় কমিটির সহ তথ্য ও প্রচার সম্পাদক প্রশান্ত ত্রিপুরা বলেন, ‘ইউপিডিএফ হচ্ছে চুক্তিবিরোধী সংগঠন। তারা সব সময় পাহাড়কে অশান্ত রাখতে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে যাচ্ছে।
শনিবার (১৮ আগস্ট) যা হয়েছে তাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে এটা হয়েছে। একটি কমন বিষয় হলো, যাই ঘটুক ইউপিডিএফ মুখস্থভাবে আমাদের দায়ী করে। আমরা সন্ত্রাসী সংগঠন না এটা পাহাড়ে বসবাসরত সবাই জানে। এই ঘটনায় কোনোভাবেই আমাদের সংগঠনের কেউ ছিল না।’
২০১৭ সালের নভেম্বরে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) নামে নতুন সংগঠন আত্মপ্রকাশের পর থেকেই পাহাড়ে নাটকীয়ভাবে হত্যার ঘটনা বেড়েছে চলছে। এসব হত্যাকাণ্ডে প্রসীত খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ এর ১৬ নেতাকর্মী-সমর্থক আজকের ঘটনাসহ ২২ জন ও জেএসএস (এমএন লারমা) এবং ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) ১৬ নেতাকর্মী খুন হন।
গত ৩ মে রাঙামাটির নানিয়াচর উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেএসএস (এমএন লারমা) এর কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি শক্তিমান চাকমা খুন হন। শক্তিমান চাকমা ছিলেন দলটির অন্যতম প্রধান নেতা। শক্তিমান হত্যার পরের দিন তার দাহক্রিয়া যোগ দিতে যাওয়ার পথে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) এর প্রধান তপন জ্যোতি চাকমা (বর্মা) সহ ছয় জন নিহত হন। প্রতিষ্ঠার মাত্র ছয় মাসের মাথায় দলীয় প্রধানকে হারিয়ে অনেকটা অস্তিত্বের সংকটে ছিল ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)।
এসব ঘটনার পর আগে ও পরে আরও তিন গ্রুপের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীকে হারায় তিনটি সংগঠনই। পাহাড়িদের অধিকার আদায়ে প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠনগুলোর মধ্যে একমাত্র সন্তু লারমা নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতি এখন কোনও ঝামেলায় না জড়ালেও বাকি তিন সংগঠনের মধ্যে প্রায়ই হত্যাকাণ্ড ঘটেই চলছে।
অনুসন্ধানে জানাযায়, তিন পার্বত্য জেলায় কৃষি থেকে শুরু করে ব্যবসা বাণিজ্য, চাকুরি, যানবাহন, ঠিকাদারি সব সেক্টর থেকেই আঞ্চলিক দলগুলো নিধিষ্ট হারে চাঁদা আদায় করে থাকে। তাদের এ চাঁদাবাজি পার্বত্য এলাকায় এখন ওপেন সিক্রেট।
জানাযায়, ইউপিডিএফ’ই(প্রসীত গ্রুপ) বছরে চাঁদা আদায় করে ৫০-৬০ কোটি টাকা। তাদের প্রতিপক্ষ দলগুলোরও চাঁদাবাজি খাতে আয় হয় এর কমবেশী। এলাকার নিয়ন্ত্রণ যার যত বেশী, ঐ সংগঠনের চাঁদা আদায়ের পরিমানও তত বেশী। তাই বিপুল অংকের চাঁদার টাকার নেশায় দলগুলো এলাকার নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তারের জন্য খুনোখুনিতে লিপ্ত থাকে। সচেতনের মহলের আশাংকা নির্বাচনের এই বছরের পাহাড়ে আঞ্চলিক দলের সংঘাত পাহাড়ের রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করবে।
জানাযায়, ২০১৭ সালের নভেম্বরে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) নামে নতুন সংগঠন আত্মপ্রকাশের পর থেকেই পাহাড়ে নাটকীয়ভাবে হত্যার ঘটনা বেড়েছে। ইউপিডিএফ থেকে ২০১৩ সালে বহিস্কৃত তপন জ্যোতি চাকমা (বর্মা) এর নেতৃত ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) গড়ে উঠে। তপন জ্যোতি চাকমা ইউপিডিএফ’র সাবেক সামরিক কমান্ডার হিসেবে পরিচিত ছিলেন । ইউপিডিএফ সামরিক কমান্ডার থাকাকালীন সময়ে তপন জ্যোতি চাকমার নেতৃত্বে পার্বত্য এলাকায় বিশেষত নানিয়াচরসহ রাঙামাটি এবং খাগড়াচড়িতে ব্যাপক আধিপত্য গড়ে তুলেছিল।
দল থেকে বহিস্কৃত হওয়ার দীর্ঘদিন পর তপন জ্যোতি চাকমা ২০১৭ সালে নিজেই ইউপিডিএফ(গণতান্ত্রিক ) নামে নতুন সংগঠন গড়ে তোলেন। নতুন ইউপিডিএফ(গণতান্ত্রিক) আত্মপ্রকাশের পর থেকেই পাল্টে যেতে থাকে পাহড়ের রাজনীতি। অতীতের তুলনায় আঞ্চলিক সংগঠনের দীর্ঘদিনের চলামান সংঘাত ২০১৫ সালের দিকে অনেকটা কমে আসছিল। কিন্তু প্রতিষ্ঠার মাত্র ৬ মাসের মাথায় গত ৪ মে দলীয় প্রধান ও প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক তপন জ্যোতি চাকমা (বর্মা)সহ ৬জনকে হত্যা করা হয়। দলের প্রধানের এই অপ্রত্যাশিক মৃত্যুতে বেকাদায় পড়ে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) ।
ইউপিডিএফ(প্রসীত) সূত্রে জানা যায়, গত নভেম্বর থেকে (১৮ আগষ্ট) পর্যন্ত প্রায় ২৪ জন নেতা কর্মী খুন হন। সংগঠনটির এক বিবৃতিতে দাবি করা হয়, সংস্কারবাদী জেএসএস এর পেলে-সুদর্শন-অংশুমান চক্র এবং নব্য মুখোশবাহিনী( ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক) খুন, গুম, অপহরণ, চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। তারা ইউপিডিএফ নেতা মিঠুন চাকমাসহ এ পর্যন্ত কমপক্ষে ২১ জন ইউপিডিএফ’র নেতা-কর্মী, সমর্থককে খুন করে ।
সর্বশেষ শনিবার(১৮ আগষ্ট) খাগড়াছড়ি স্বনির্ভর এলাকায় ইউপিডিএফের অঙ্গসংগঠন পিসিপি’র খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সভাপতি তপন চাকমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের খাগড়াছড়ি জেলাসহ সভাপতি পলাশ চাকমা, পিসিপি’র খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সহ সাধারণ সম্পাদক এল্টন চাকমা, উত্তর খবংপয্যা গ্রামের বাসিন্দা ও মহালছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য সহকারী জিতায়ন চাকমা (৫৩), একই গ্রামের কান্দারা চাকমার ছেলে রুপম চাকমা ও ধীরাজ চাকমাকে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করা হয়।
ইউপিডিএফ(প্রসীত গ্রুপ)এর পাল্টা হামলায় জেএসএস (সংস্কার) এর র্শীষ ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)এর দলীয় প্রধানসহ ১১ জন নিহত হয় বলে সংগঠন দুটির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয় । ৩রা মে রাঙামাটির নানিয়াচর উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেএসএস (এমএন লারমা) কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি শক্তিমান চাকমা খুন হন। শক্তিমান চাকমা ছিলেন দলটির অন্যতম প্রধান নেতা। তার নেতৃত্বে রাঙামাটির নানিয়াচরে জেএসএস (সংস্কার) এর প্রভাব বলয় গড়ে উঠে। তুখোড় এই নেতার মৃত্যু দলটির বড় ক্ষতি হিসেবে দেখা হয়।
শক্তিমান চাকমার হত্যার এই ঘটনার পর পর ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) এর প্রধান তপন জ্যোতি চাকমা(বর্মা)সহ ৫ জন প্রাণ হারায় প্রতিপক্ষের গুলিতে। সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার মাত্র ৬ মাসের মাথায় ৪ মে চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাওয়ার পথে নানিয়ারচর এলাকায় তাদের বহনকারী গাড়িতে প্রতিপক্ষরা ব্রাশ ফায়ার করলে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক তপন জ্যোতি চাকমা বর্মাসহ ৬ন মারা যায়।
এছাড়া জুন ও জুলাই মাসে সুরেশ বিকাশ চাকমা. জঙ্গলী চাকমা ,পঞ্চানন চাকমা ও বিজয় কুমার চাকমা ও ১৫ জুলাই শান্তি রঞ্জন চাকমা নামে এক জেএসএস কর্মীকে গুলি ও জবাই করে হত্যা করা হয় খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গাতে। হত্যাকান্ডের জন্য ইউপিডিএফ(প্রসীত)কে দায়ী করেছিল জেএসএস(এমএন লারমা) । তবে এসব ঘটনায় নিজের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করে প্রসীত খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ।
২৬ জুলাই রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার রূপকারী ইউনিয়নের দাঙ্গাছড়া, রাইন্নাছড়া ও বেতাগী ছড়ায় সশস্ত্র তিন গ্রুপ এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে বন্ধুক যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ঘন্টাব্যাপী চলা এ যুদ্ধে বন কুসুম চাকমা নামে জেএসএস(এম এন লারমা) এর এক কর্মী নিহত হয়।
এ হত্যাকান্ডের ঘটনায় রাঙামাটির বাঘাইছড়ি থানায় ইউপিডিএফ প্রসীত গ্রুপের প্রধান প্রসীত বিকাশ চাকমাসহ ৪৪ জনকে অভিযুক্ত করে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়।
রাঙামাটি গোয়েন্দা পুলিশের ওসি মো. পারভেজ জানান, ‘গত এক বছরেরও কম সময়ে রাঙামাটিতে পাহাড়ি সংগঠনগুলোর সংঘোতে ১৭ জন নিহত হয়েছে। এক মধ্যে শুধু একটি ঘটনায় মামলা হয়েছে। বাকি কোনোটারই মামলা হয়নি।’
চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক, ‘পাহাড়ের যে সংগঠন আছে চারটা তারা অভ্যন্তরীণ বিরোধের জেরে এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে। নির্বাচন সামনে আসছে। সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার পেছনে নির্বাচনের আগে নিজ নিজ আধিপত্য বিস্তারের বিষয়টি থাকতে পারে।’ তিনি জানান, গোয়েন্দা পুলিশসহ বিশেষ শাখার লোকজনকে সহিংসতা রোধে ও নজরদারি রাখার ক্ষেত্রে সতর্কভাবে কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
Posted ৩:১৮ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ১৯ আগস্ট ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta