কক্সবাংলা ডটকম(৩১ আগস্ট) :: প্রত্ননিদর্শন ইতিহাস নির্মাণের অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রত্নতাত্ত্বিক খননে এ অঞ্চলে সভ্যতার আদি নিদর্শনের খোঁজ মিলেছে বহুবার। আবিষ্কৃত এসব প্রত্ননিদর্শনের কিছুটা সংরক্ষণ হলেও চোরাচালান চক্রের তত্পরতায় বেহাত হয়ে যাচ্ছে অনেক নিদর্শন। গত এক মাসের ব্যবধানে শুধু রাজধানী থেকেই পাচারের সময় উদ্ধার হয়েছে অন্তত ৩২টি মূল্যবান প্রত্নসম্পদ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রত্নসম্পদসমৃদ্ধ এ অঞ্চলে নজর পড়েছে আন্তর্জাতিক চোরাচালান চক্রের। দেশীয় এজেন্টদের মাধ্যমে তারা মূল্যবান প্রত্ননিদর্শন সংগ্রহ করে গোপনে পাচার করছে বিদেশে।
সর্বশেষ গত সোমবার রাতে রাজধানীর নর্দ্দা এলাকার একটি বাসা থেকে ২৮টি অতিমূল্যবান প্রত্নসম্পদ উদ্ধার করেছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এ সময় মনিরুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তিকে আটকও করা হয়। উদ্ধার হওয়া এসব প্রত্ননিদর্শনের মধ্যে রয়েছে— হরগৌরী, নবগ্রহ গণেশ, গৌতম বুদ্ধের মতো কষ্টিপাথরের ১০টি মূর্তি। ৫৭৭ খ্রিস্টাব্দের একটি তাম্রলিপি, ১৮টি বিভিন্ন ধরনের ধাতব মুদ্রা ও বেশ কয়েকটি অতি প্রাচীন স্মারকও উদ্ধার করা হয় এ সময়।
জানতে চাইল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সুফি মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘যেসব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন উদ্ধার করা হয়েছে, এগুলো সপ্তম থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর বলে আমরা ধারণা করছি। এসব নিদর্শনের মধ্যে তাম্রলিপি, নবগ্রহ, গনেশ, সূর্য, হরগৌরী, চামন্ডা ও বৌদ্ধমূর্তি রয়েছে।’
উদ্ধার হওয়া এসব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘পাচারকারী চক্রের কাছে যে তাম্রলিপি পাওয়া গেছে এটি সংস্কৃত ভাষায় লেখা। এসব তাম্রলিপি প্রাচীনতম লিখিত দলিল। এতে ভূমিদানের চুক্তি, রাজার আদেশ-নির্দেশসহ প্রশাসনিক কার্যক্রম ও গুণকীর্তন লেখা থাকতো। তাম্রলিপি থেকে একজন রাজার শাসনামল সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। এগুলো সংরক্ষণ ও তদারক করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।’
তিনি বলেন, ‘এগুলোর কোনও বাজার মূল্য নেই। কারণ, এগুলো অমূল্য সম্পদ।’
এসব প্রত্নসম্পদ উদ্ধার অভিযানে নেতৃত্ব দেন ডিবির অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ বশির উদ্দিন। তিনি বলেন, চক্রটি দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রত্নসম্পদ সংগ্রহের পর তা ঢাকায় সংরক্ষণ করে। পরে আন্তর্জাতিক চোরাকারবারি চক্রের সদস্যরা ঢাকায় এসে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এসব প্রত্নসম্পদের মূল্য নির্ধারণ করেন। সেখান থেকে অতি মূল্যবান এসব প্রত্ননিদর্শন চলে যায় বিদেশে।
সাম্প্রতিক সময়ে প্রত্নসম্পদের সবচেয়ে বড় চালানটি উদ্ধারের পর তা পরিদর্শনে যান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও ঐতিহ্য অন্বেষণের নির্বাহী পরিচালক ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমান। বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থল উয়ারী-বটেশ্বর প্রত্নগ্রামের পাশাপাশি বিক্রমপুরের বেশকিছু স্থানে প্রায় ১৬ বছর ধরে জরিপ, অনুসন্ধান, খনন ও গবেষণাকর্মের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন তিনি।
জানতে চাইলে ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, গোয়েন্দা পুলিশের উদ্ধার করা প্রত্ননিদর্শনগুলো শতভাগ আসল। এগুলো মহামূল্যবান। বাংলাদেশ অনেক সমৃদ্ধ একটা দেশ। এখানে বিভিন্ন জনপদে মূল্যবান অনেক প্রত্নসম্পদ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। দেশী কিছু রাঘববোয়ালের সহায়তায় আন্তর্জাতিক চক্রের সদস্যরা এসব প্রত্নসম্পদ পাচার করছে। এসব অতিমূল্যবান প্রত্নসম্পদ রক্ষায় সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরো শক্ত ভূমিকা রাখতে হবে। পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মাঝেও সচেতনতা তৈরি করতে হবে।
ডিবি সূত্র জানায়, প্রত্নসম্পদ পাচারের চক্রটি দুটি অংশে বিভক্ত হয়ে কাজ করে থাকে। একটি অংশ দেশীয়, অন্যটি বিদেশী। দেশীয় অংশের কাজ হলো, প্রাচীন বিভিন্ন শহরের ম্যাপ ধরে ওইসব এলাকা থেকে প্রত্নসম্পদ চুরি করা। বিদেশী অংশটি আন্তর্জাতিক বাজারে এসব প্রত্নসম্পদ বিক্রির কাজটি করে থাকে।
সম্প্রতি রাজধানী থেকে আটক চোরাচালান চক্রের সদস্য মনিরুলের বড় ভাই তরিকুল ইসলাম লিটনকে গ্রেফতার করা গেলে এ চক্র সম্পর্কে আরো বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে বলে জানান ডিবি পূর্ব বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার খোন্দকার নূরুন্নবী।
সোমবার প্রত্নসম্পদের চালানটি ধরা পড়ার দুদিন পর গতকালও রাজধানী থেকে পাচারের আগে প্রত্নসম্পদের আরেকটি চালান জব্দ করেছে র্যাব। চালানটিতে উদ্ধার হয় কষ্টিপাথরের মূর্তি। এছাড়াও গত জুনের মাঝামাঝি সদরঘাট থেকে আরেকটি কষ্টিপাথরের মূর্তি পাচারকালে উদ্ধার করেন পুলিশের এসআই এনামুল হক।
‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোং ১৮০৮’ লেখা কষ্টিপাথরের মূর্তিটি পাচারকালে গ্রেফতার হন বুয়েট থেকে পাস করা শাহেদুর রহমান বাবলা নামের এক প্রকৌশলী। তার বিরুদ্ধে কোতোয়ালি থানায় পুরাকীর্তি আইনে একটি মামলাও হয়েছে। যদিও মাত্র ১৮ দিন কারাবাসের পর জামিনে মুক্তি পান শাহেদুর রহমান বাবলা।
শাহেদুর রহমান বাবলার কাছ থেকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে এসআই এনামুল হক জানান, কষ্টিপাথরের মূর্তিটি বরগুনার এক কৃষক মাটি কাটার সময় উদ্ধার করেন। পরে এটি ৫০ লাখ টাকা চুক্তিতে কিনে আনেন তিনি। জামান নামের এক ব্যক্তির কাছে প্রত্নসম্পদটি ১ কোটি টাকায় বিক্রি করতে চুক্তিবদ্ধও হন। সেই চুক্তি মোতাবেক তিনি কষ্টিপাথরের মূর্তিটি ঢাকায় নিয়ে আসেন।
র্যাবের পরিসংখ্যান বলছে, গত এক যুগে প্রত্নসম্পদ সংরক্ষণে ৩০৪টি অভিযান পরিচালনা করেছে র্যাব। এসব অভিযানে পাচারের সময় উদ্ধার করা হয়েছে ১ হাজার ২৯৭টি প্রত্ননিদর্শন। এর মধ্যে ছিল— বিভিন্ন ধরনের ৪৮৬টি মূর্তি ও ৮১১টি মূর্তির ভগ্নাংশ। পরে উদ্ধার হওয়া প্রত্নসম্পদগুলো সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরে জমা দেয় র্যাব। পাচারের ঘটনায় মামলা হয়েছে ২১৮টি। গ্রেফতার হয়েছেন ৪৪০ জন।
র্যাবের গোয়েন্দা শাখার তথ্য বলছে, বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বেশকিছু মূল্যবান প্রত্নসম্পদ রয়েছে। এসব সম্পদ চুরি করার জন্য বেশ সক্রিয় কিছু দেশী-বিদেশী চক্র। চক্রগুলো দীর্ঘদিন ধরে পরস্পর যোগসাজশে কষ্টিপাথরের তৈরি মূর্তি ও মূল্যবান দ্রব্য অবৈধভাবে পাচার করে আসছে। তবে এর মধ্যে কিছু চক্র আছে, যারা পুরনো কয়েন থেকে শুরু করে নানা ধরনের সামগ্রী অধিক মূল্যে বিক্রির প্রলোভন দেখিয়ে অনেকের সঙ্গে প্রতারণা করে থাকে। তাদের বিরুদ্ধেও নজরদারি রয়েছে র্যাবের গোয়েন্দা শাখার।
এ বিষয়ে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, র্যাব প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই দেশের সম্পদ সংরক্ষণে বিশেষভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এর ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন সময় দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মূল্যবান প্রত্নসম্পদ উদ্ধার করা হয়। পরবর্তী সময়ে আইনানুগভাবে ওইসব প্রত্নসম্পদ সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরে জমা দেয়া হয়। ভবিষ্যতেও প্রত্নসম্পদ সংরক্ষণে র্যাবের অভিযান অব্যাহত থাকবে।
চুরি হওয়া প্রত্নসম্পদের অধিকাংশই বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে বিদেশে পাচার হয়ে থাকে। চলতি বছরের প্রথম আট মাসে দেশের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে পাচারকালে অন্তত সাতটি প্রত্নসম্পদ উদ্ধার করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।
বিজিবি সদর দপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা মুহম্মদ মহসীন রেজা জানান, দেশের প্রত্নসম্পদ রক্ষায় শুরু থেকেই বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আসছে বিজিবি। বিভিন্ন সীমান্তের পাশাপাশি সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোয়ও নিয়মিত বিজিবির টহল ও নজরদারি অব্যাহত রয়েছে বলেও জানান তিনি।
দেশের প্রত্নসম্পদ সংরক্ষণের দায়িত্ব প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের। কিন্তু চোরাকারবারিদের নজরদারি করার মতো যথেষ্ট সক্ষমতা নেই সংস্থাটির।
জানতে চাইলে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অতিরিক্ত সচিব মো. আলতাফ হোসেন বলেন, আমাদের নিজস্ব কোনো ইন্টেলিজেন্স নেই। যদি এনবিআর, দুদকসহ অন্যান্য সংস্থার মতো আমাদেরও নিজস্ব ইন্টেলিজেন্স টিম থাকত, সেক্ষেত্রে আমরা প্রত্নসম্পদ রক্ষায় নিয়মিত নজরদারি করতে পারতাম। এখন আমরা কেবল দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রত্নসম্পদগুলো যথাযথ নিয়মে সংরক্ষণের কাজটি করে থাকি। পাশাপাশি যদি কখনো প্রত্ননিদর্শন পাচারের কোনো তথ্য পাই, সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশকে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বলি।
Posted ৪:০৮ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ৩১ আগস্ট ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta