কক্সবাংলা ডটকম(২৭ অক্টোবর) :: বাজারজাতকরণে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে বাংলাদেশ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছে একের পর এক বিদেশি ওষুধ কোম্পানি। এতে করে বৈচিত্র্য হারাচ্ছে দেশের ওষুধ খাত, সেই সঙ্গে গবেষণালব্ধ ওষুধ প্রাপ্তির ব্যাপ্তিও কমে যাচ্ছে। তবে বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প মালিক সমিতির নেতারা দাবি করছেন, বিদেশি ওষুধ কোম্পানিগুলোই এ দেশে অনৈতিক বিপণন ব্যবস্থা চালু করেছে।
বেশ কয়েক বছর আগেই ফাইজার, ফাইসন্স, স্কুইবসহ বড় বড় কয়েকটি বিদেশি ওষুধ কোম্পানি বাংলাদেশ থেকে তাদের বিনিয়োগ গুটিয়ে নিয়েছে। ২০১৮ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশ ছাড়ে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক ওষুধ কোম্পানি গ্লক্সোস্মিথক্লাইন। আর চলতি মাসের ১৬ তারিখে গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে নিজেদের ব্যবসা গুটিয়ে নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে সানোফি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশি কোম্পানিগুলো অনেক গবেষণা করে তাদের পণ্য বাজারজাত করে থাকে। এ ক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে আছে দেশীয় কোম্পানিগুলো। গবেষক, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের ব্যক্তিদের যোগসূত্র খুব একটা নেই। ফলে ১৯৮২ সালের পর থকে এ পর্যন্ত ওষুধের মানের প্রশ্নে কোন পয়েন্ট যোগ হয়নি। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ওষুধ রপ্তানি করলেও সেগুলোর মান নিয়ে জনমনে প্রশ্ন রয়েছে।
তারা আরো বলছেন, দেশীয় ওষুধ কোম্পানিগুলো পণ্য বিক্রয়ের ক্ষেত্রে বিক্রয় প্রতিনিধিদের ওপর নির্ভরশীল। এতে করে অনেক ক্ষেত্রে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নামে বিভিন্ন কোম্পানি। চিকিৎসকদের নানা উপঢৌকন, ব্যক্তিগত বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয় বিক্রয় প্রতিনিধিদের মাধ্যমে। সকাল, বিকেল এমনকি রাতেও ডাক্তারদের চেম্বার কিংবা বিভিন্ন হাসপাতালে দেখা যায় বিক্রয় প্রতিনিধিদের ভিড়। তারা রোগীদের হাত থেকে চিকিৎসাপত্র কেড়ে নিয়ে দেখেন চিকিৎসক কোন কোম্পানির ওষুধ সেখানে লিখেছেন। এসব অনৈতিক বিপণন ব্যবস্থার কারণে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে বিদেশি ওষুধ কোম্পানিগুলো। কারণ, তারা বিপণনের জন্য অনৈতিক কোনো পন্থা অবলম্বন করতে অভ্যস্ত নয়। এ অবস্থায় ওষুধ কোম্পানির এমন অসুস্থ প্রতিযোগিতা ঠেকানো না গেলে মানহীন ওষুধে বাজার সয়লাব হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
নিজেদের ব্যবসা গুটিয়ে নেয়ার বিষয়টি জানাতে গিয়েও একই কথা বলেছে সানোফি কর্তৃপক্ষ। সানোফির পক্ষ থেকে জানানো হয়, বাংলাদেশের ওষুধ বিপণনব্যবস্থা অনৈতিক। কোম্পানিগুলোকে তাদের ওষুধ চালানোর জন্য চিকিৎসকদের মোটা অঙ্কের কমিশন এবং উপহার সামগ্রী দিতে হয়। গাড়ি উপহার দেয়ার মতো ঘটনাও ঘটে। কমিশন এবং দামি উপহার না পেলে অনেক ডাক্তার তাদের পণ্য চিকিৎসাপত্রে লেখেন না। এতে করে ব্যবসায়িকভাবে কোম্পানিগুলো প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। আবার অনৈতিকভাবে কমিশন এবং দামি উপহার দেয়ার সুযোগও এসব কোম্পানির নেই। তাদের বৈশ্বিক নীতি তা অনুমোদন করে না। এই অবস্থায় ব্যবসা গুটানো ছাড়া তাদের পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব নয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দেশীয় এক ওষুধ কোম্পানির বিক্রয়কর্মী জানান, নতুন কোনো ওষুধ আসলে তার তথ্য নিয়ে চিকিৎসকদের কাছে তাদের যেতে হয়। চিকিৎসকরা যদি মনে করে এ ওষুধটা লাগবে তাহলে তারা সেটি চিকিৎসাপত্রে লেখেন। তবে এ জন্য চিকিৎসকদের ম্যানেজ করতে হয়। এ ছাড়া ওষুধের নমুনা হিসেবে বেশকিছু ওষুধও চিকিৎসকদের দিতে হয়।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, কিছু বিদেশি কোম্পানি দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে আমাদের দেশে ব্যবসা করে আসছে। তারা ক্রেতাদের মনে আস্থার জায়গা তৈরি করেছে। আমরা চাই না কেউ ব্যবসা গুটিয়ে চলে যাক। আমরা চাই ওষুধ শিল্পে দেশি-বিদেশি সব কোম্পানি থাকুক। এদের মধ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতা থাকুক। এতে করে এই শিল্পে বৈচিত্র্য যেমন থাকবে তেমনি প্রযুক্তি স্থানান্তরের সুযোগও থাকবে। অন্যথায় বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান খসরুর মতে, বিদেশি কোম্পানিগুলোর ব্যবসা গুটিয়ে নেয়া দেশের ওষুধ শিল্পে বড় কোনো প্রভাব ফেলবে না। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, গুটিকয়েক বিশেষায়িত ওষুধ ছাড়া সাধারণভাবে আমাদের দেশের ওষুধ শিল্পে এর কোনো প্রভাব পড়বে না। তবে বিদেশি কোম্পানিগুলো যেসব কারণ দেখিয়ে তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছে সেদিকে আমাদের নজর দিতে হবে।
হাডসন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প মালিক সমিতির মহাসচিব এস এম শফিউজ্জামান দাবি করেন, বাংলাদেশের ওষুধ এখন বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। এমন কি ইউরোপ আমেরিকাতেও রপ্তানি হচ্ছে। ফলে ওষুধ বিক্রিতে তাদের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নামতে হয় না। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, দেশে ৪/৫টি বিদেশি ওষুধ কোম্পানি আছে। তারা লাভজনক অবস্থাতেই রয়েছে। তবুও নিজেদের ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান। তবে এতে আমাদের ওষুধ শিল্পে কোনো প্রভাব পড়বে না।
Posted ৪:০৪ পূর্বাহ্ণ | সোমবার, ২৮ অক্টোবর ২০১৯
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta