প্রকৌশলী বদিউল আলম(২১ জুন) :: পৃথিবীতে প্রায় জাতির ইতিহাসে কোন না কোন দিন, ক্ষণ, বিশেষ কোন ঘটনা, জয়-পরাজয় বা ধ্বংস-সৃষ্টির কারণে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকে। ২৩ শে জুন তেমনই একটা দিন। যা বাঙালীর জাতীয় চেতনার ভিত। দু’টো প্রধান কারণে দিনটি চিরস্মরণীয়। একই দিনে ১৭৫৭ সালে বাঙালীর পরাজয় এবং ব্রিটিশ দাসত্বের শৃঙ্খলে বন্দী, অন্যদিকে ১৯৪৯ সালে একটি স্বাধীন জাতি ও দেশ সৃষ্টির প্রত্যয়ে একটি রাজনৈতিক দলের জন্ম, যার নাম বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ। সঙ্গতকারনে বাঙ্গালীর জাতীয় ইতিহাসে ডিসেম্বর, র্মাচ ও জুন মাস নব জাগরনের চেতনায় তাৎপর্য মন্ডিত।
১৭৫৭ সালের ২৩ শে জুন দুঃখ-বিরহ-বেদনা ও কলংকে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে বাঙালী তথা গোটা ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের হৃদয়ে। যাকে আমরা পলাশী দিবস হিসেবে আখ্যায়িত করি। সেদিন পলাশীর আম্রকাননের (মুর্শিদাবাদ, পশ্চিমবঙ্গ, বর্তমান ভারত) যুদ্ধে নবাব সিরাজদ্দৌলার সেনাবাহিনী ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সেনাবাহিনীর কাছে পরাজিত হয়।
ফলে তার সূত্রপাত ধরে প্রায় ১৯০ বছর গোটা ভারত সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ গোলামীর ঝিনঝিরে বন্দী থাকে। তার পরবর্তী সময়ে দাসত্ব থেকে মুক্তির সোপানে উদ্দীপ্ত হাজারো দেশপ্রেমিক বিপ্লবীরা তাদের জীবন দান করেছেন। পরিশেষে ১৯৪৭ সালে গোটা ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে।
কিন্তু পলাশী যুদ্ধ কেন সংঘঠিত হল, তার দীর্ঘ বর্ণনা এই ক্ষুদ্র পরিসরে লেখা অসম্ভব। তবে ইতিহাসবিদ ও রাজনীতিবদরা পলাশী যুদ্ধের জয়-পরাজয়ের নিরপেক্ষ বিশ্লেষণে প্রমাণ করেন যে, ওটা প্রকৃত কোন যুদ্ধ ছিলোনা, ছিলো কাসিমবাজার কুটির প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের ফসল। আমরা বাঙালীরা যে কতো আত্মঘাতী ও পরশ্রীকাতর, তা জাতীয় জীবনের অনেক ক্ষেত্রেই এখনো দৃশ্যমান। এই পৃথিবীতে বহুজাতির মানুষের সংস্পর্শ পেয়েছি কিন্তু আমার খুব কমই তেমনটি দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়েছে।
প্রসঙ্গতঃ পলাশীর যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন হাজার ও ৮টা কামান এবং অপরদিকে নবাব সিরাজ বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা পঞ্চাশ হাজার ও ৪০টা কামান। এতো বিশাল ব্যবধানেও নবাব বাহিনীর পরাজয়। বিষয়টা অতি বিষ্ময়কর বটে। বলা হয়ে থাকে, নবাব বাহিনীর কামানের বারুদ নাকি ওই দিন বৃষ্টিতে ভিজে অকেজো হয়ে পড়ে। ব্রিটিশ বাহিনীর বারুদ বৃষ্টিতে ভিজেনি।
তা’ হলে নবাব বাহিনীর প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খান কি এতই অদক্ষ ও অপরিনামদর্শী ছিলো যে স্বীয় কামানের বারুদের নিরাপত্তা দিতে অপারগ? অথবা দৈবক্রমে ভিজে গেছে। ধরে নেয়া যাক, তাই সঠিক। তবে সামনা সামনি ও হাতাহাতি যুদ্ধেও (হোক ব্রিটিশ বাহিনীর ৮টি কামান সচল) ব্রিটিশ সাড়ে তিন হাজার সৈন্যের কাছে নবাবের পঞ্চাশ হাজার সৈন্যের শোচনীয় পরাজয় এবং আত্মসমর্পন পৃথিবীর কোথাও হয়নি। সাধারণ মানুষতো বটে, এমনকি বিশ্ববিখ্যাত সমরবিদ জেনারেলরাও ওই যুদ্ধের অসম ও অসম্ভব ফলাফলে বিস্মিত।
ইতিহাস স্বাক্ষী দেয় যে, কাসিম বাজার কুটি ও নবাব প্রাসাদ থেকে পলাশীর রনাঙ্গন পর্যন্ত যুদ্ধ পরাজয়ের ষড়যন্ত্র বিন্যস্ত থাকে। গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্তদের অনেকেই নবাবের পরম আত্মীয়। অন্ততঃ নবাব বাহিনীর প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খান ও ঘসেটি বেগমের নাম সর্বজনবিদিত। সঙ্গে নবাব মন্ত্রীসভার জগত শেট, উমি চাদ, রাজবল্লব, রায় দূর্লভ, রাজ নারায়ন প্রমুখরা।
নবাবের পতনের পরে তারা সবাই পূর্ব প্রতিশ্রুতি মোতাবেক ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী কর্তৃক রাজক্ষমতা, ধনদৌলত ও অন্যান্য সুবিধাদি প্রাপ্ত হন। তাদের একটুকুও অনুশোচনা হয়নি যে, সামান্য লোভের বশবর্তী হয়ে পুরো বাংলাসহ ভারতবর্ষকে ব্রিটিশের গোলামীর কাঁচায় আবদ্ধ করতে সহযোগীতা করেছে।
ইতিহাসের কাছে তারাই হচ্ছে বেঈমান, বিশ্বাসঘাতক ও দেশপ্রেমহীন লুটেরা। তাই আজ ২৫৭ বছর পরেও সেই কুলাঙ্গারদের নামে কোন সচেতন বাঙালী বা ভারতীয় মানুষ নিজ প্রজন্মের সন্তানদের নাম ধারণ তো দূরের কথা, ঘৃনায় সে সব নামে থুথু ছিটকায়।
অপরদিকে দেশপ্রেম ও স্বাধীনতায় উদ্দীপ্ত নবাব সিরাজ ও তার সহযোদ্ধা মীরমদন, মোহনলাল প্রমুখরা চিরস্মরণীয় ও বরণীয় বাংলার এবং ভারতের মানুষের গহীন হৃদয়ে। এখনো প্রত্যেহ অসংখ্য ফুলেল শুভেচ্ছা ও ভালবাসায় সম্মানিত এবং নয়নজলে সিক্ত হয় তাদের সমাধি। আর বেইমান মীর জাফর গংদের কবর ঘৃনায় ম্লানিত হয় অসংখ্য সেন্ডেল, জুতো ও থুথু নিক্ষেপে। মুর্শিদাবাদ ভ্রমণে সেই বাস্তবতা এখনো দৃষ্টিগোচর হয়। আগামী অনন্তকাল সেই ঘৃণা বিদ্বেষ থাকবেই। এটা তাদের ঐতিহাসিক ও চিরাচরিত প্রাপ্য।
সাম্প্রতিকালে কিছু প্যাড সর্বস্ব পার্টি ও ইসলামী লেবাসযুক্ত পার্টির অপতৎপরতা লক্ষ্যনীয়। পলাশী দিবস-বাঙালী তথা ভারতীয় মানুষের চেতনার ভ্রুন এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু পলাশী দিবসের সার্বজনীনতাকে ব্যতয় ঘটিয়ে ইসলামীকরণের ব্যর্থ প্রয়াস তাদের।
উল্লেখ্য যে, ভারতের শাসকরা-যেমন সোলতানী শাসকরা, মোগল শাসকরা বা নবাব শাসকরা মুসলিম শাসক হলেও তাদের দীর্ঘ শাসনের ইসলাম ধর্মকে রাষ্ট্র শাসনে কারাবন্দী করেননি। বরং অসাম্প্রদায়িক চেতনার চিত্তে রাজনৈতিক সমাজ ব্যবস্থায় রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন।
সুতরাং ২৩ শে জুনের পলাশী দিবসকে তারাই স্মরণ ও লালন পালন করবেন, যারা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে এই বাংলা ও বাঙালীর মুক্তির সংগ্রামে লিপ্ত এবং যারা আধুনিক বাংলাদেশ তথা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে অঙ্গীকারাবদ্ধ। সর্বোপরি, ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মানুষগুলোর পলাশী দিবসের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন ভন্ডামী ও মায়াকান্না বৈই আর কিছু নয়।
ইতিহাসের পাতায় সত্য লুকানো বড়ই দুস্কর। হালে ১৭৫৭ সালের ২৩ শে জুনের পলাশী প্রাঙ্গনে ষড়যন্ত্রের যোগসূত্র ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টে পুনরাবৃত্তি দেখি। নায়ক-নায়িকা বা খলনায়কদের নাম ভিন্ন হলেও ক্ষেত্র বা মূলঘটনা প্রায় এক ও অভিন্ন। ১৫ আগষ্টে একদিকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ও তারপক্ষের লোকজন, অন্যদিকে ছায়া কাসিম বাজার কুটির মূল হোতা খন্দকার মোস্তাক, জেনারেল জিয়া, কর্নেল ফারুক রশীদ গংরা।
ইতিহাসের নিমর্ম হত্যাকান্ডের মাধ্যমে কাপুরুষ মীর জাফরের মতো খোন্দকার মোস্তাক ও জেনারেল জিয়াদের অসাংবিধানিক পন্থায় রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে খলনায়কে ভূষিত এবং সুবিধাভোগী হন। ইতিহাসের পাতায় লক্ষ্যনীয় যে, মীর জাফর গংদের মতো খোন্দকার মোস্তাক গংদের শেষ পরিণতির অধ্যায় বড়ই করুন ও অস্বাভাবিক।
বিশ্বের ইতিহাসে দেখা যায়, বেইমান, বিশ্বাসঘাতক, ষড়যন্ত্রকারী ও দেশপ্রেমহীন মানুষের শেষ পরিণতি তেমনই হয়।
প্রসঙ্গত বাংলা ও বাঙালীর প্রায় ৩ হাজার বছরের ইতিহাসে মুক্তি ও স্বাধীনতার প্রত্যয়ে রাজনৈতিক সংগঠনটির জন্ম ঢাকায়, ২৩ শে জুন ১৯৪৯। বলা যেতে পারে, যেদিন বাংলা স্বাধীনতা হারায় তার ১৯১ বছর পরে সেই একই দিনে বাংলার স্বাধীনতার ভ্রুনের জন্ম। কাকতলীয় বৈকি। ব্রিটিশ শাসকের শৃঙ্খলমুক্ত হলেও পাকিস্তানী শাসকের শৃঙ্খলে বন্দী পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলার জনগণ। অতপর বাঙালীর স্বাধীনতা ও মুক্তির প্রত্যয়ে মৌলানী ভাষানী, শামসুল হক ও শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখদের প্রচেষ্টায় জন্ম নেয় মুসলিম আওয়ামীলীগ। পরবর্তীতে তার নামকরণ হয় আওয়ামীলীগ।
আরো ক’বছর পর বাঙালীর ন্যায্য দাবী ও আন্দোলনে জনগণের প্রিয় রাজনৈতিক দলের প্রধান নেতৃত্বের মধ্যমনি হন শেখ মুজিব। আরো পরে ২৩ ফেব্রুয়ারী ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু বলে আখ্যায়িত হন। এর ধারাবাহিকতায় র্দীঘ আন্দোলন ও সংগ্রাম পরিশেষে বঙ্গবন্ধু মুজিবের আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে বাংলার আকাশে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার সূর্য উদিত হয়।
বিশ্বের প্রায় জাতির ইতিহাসে স্মরণীয় ও বরণীয় ব্যক্তিবর্গরা থাকেন যারা চিরনন্দিত। আবার তাদে সাথে কিছু কুলাঙ্গারদেরও দেখা যায়, যারা বিশ্বাসঘাতক, বেঈমান তারা চিরনিন্দিত।
২৩ শে জুন তাদের কথা স্মরণীয়। বাঙালী জাতিকে তথা ভারতীয় মানুষদের অমানিষার অন্ধকার থেকে আলোর পথ দেখাতে যারা নিজেদের সর্বোচ্চ ত্যাগ-তিতিক্ষা উৎসর্গ করেছেন তাদের নাম ইতিহাসের পাতায় স্বর্নাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে। তারা হলেন- নবাব সিরাজদ্দৌলা, মীর মদন, মোহনলাল, শহীদ তিতুমির, টিপু সুলতান, ক্ষুধিরাম, হায়দর আলী, হাজী শরিয়ত উল্লাহ, বাঘা যতীন, মাষ্টার দা সূর্যসেন, প্রীতিলতা, নেতাজী সুভাষ বসু প্রমুখরা ।
সর্বোপরি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বাঙালীর প্রত্যাশিত একটি স্বাধীন জাতি ও দেশ দিয়েছেন। তার সেই আকাংখার সোনার ও ডিজিটাল বাংলাদেশে গড়ছি। আর্ন্তজাতিক অঙ্গনে সম্মান সহ মাথা উচু করে উন্নত জাতি গঠনে প্রতিজ্ঞাবদ্ব। আজকের এই দিনে জাতীয় বেঈমানদের ঘৃণায় নিন্দা জানাই। অপরদিকে বিনয় চিত্তে দেশপ্রেমিক বিপ্লবীদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। জানাই সালাম ও নমস্কার। চিরঞ্জীব থেকো তোমরা।
Posted ৭:০৮ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২১ জুন ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta