কক্সবাংলা ডটকম(২৩ মার্চ) :: অতীতের ধারাবাহিকতায় বিগত ৫ বছরেও অস্ত্র রফতানিতে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। পাশাপাশি অতীতের থেকে রফতানির পরিমাণ বাড়িয়েছে তারা। ২০১৩-২০১৭ মেয়াদে বিশ্বব্যাপী মোট রফতানিকৃত অস্ত্রের এক তৃতীয়াংশেরও বেশি যুক্তরাষ্ট্রের। আর পূর্ববর্তী মেয়াদের তুলনায় তাদের অস্ত্র রফতানি বৃদ্ধির পরিমাণ ২৫ শতাংশ।
অস্ত্র বিক্রির পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বিগত ওবামা প্রশাসনের ধারাবাহিকতায় অস্ত্র রফতানিকে আরও গতিশীল করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। পরিবর্তন এসেছেন বেচাবিক্রির ধরনেও। সবমিলে অস্ত্র রফতানিতে তাদেরকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো কেউ নেই আপাতত। ভবিষ্যতেও যুক্তরাষ্ট্র বহুদিন রফতানিতে এই অপ্রতিরোধ্য অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হবে বলে আভাস দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
সংঘাত ও সশস্ত্রীকরণসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইন্সটিটিউট (এসআইপিআরই) এর সবশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বিশ্বে রফতানিকৃত অস্ত্রের ৩৪ শতাংশই যুক্তরাষ্ট্রের।
ওই প্রতিবেদনে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র প্রস্তুতকারক করপোরেশনগুলোও বিপুল অর্থ আয় করছে। পিস রিসার্চ ইন্সটিটিউট এর তালিকায় ২০১৬ সালে শীর্ষ অস্ত্র বিক্রেতা কোম্পানির স্থানটি অর্জন করেছে স্টকস ফর লকহিড মার্টিন।
২০১৩ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটির অস্ত্র বিক্রির পরিমাণ ক্রমাগত বেড়েছে। পিস রিসার্চ ইন্সটিটিউট এর তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে স্টকস ফর বোয়িং কোম্পানিটি। ২০১৩ সাল থেকে এ কোম্পানিরও অস্ত্র বিক্রি বেড়েছে।
বিশ্বব্যাপী মার্কিন নিরাপত্তা সহযোগিতা বিশ্লেষণে নিয়োজিত সংগঠন সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল পলিসির ‘সিকিউরিটি অ্যাসিসটেন্স মনিটর’ শীর্ষক কর্মসূচির পরিসংখ্যান বলছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মেয়াদের প্রথম বছরে ৫৭০ কোটি ডলার মূল্যের অস্ত্র বিক্রি হয়েছে।
এ হার ২০১৬ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তার ক্ষমতার শেষ বছরে যে পরিমাণ অস্ত্র বিক্রি করেছেন তার চেয়েও বেশি। দুই প্রশাসনের মেয়াদেই বিপুল পরিমাণ অস্ত্র বিক্রির মধ্য দিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অস্ত্র রফতানিকারক দেশ হিসেবে নিজের অবস্থান ধরে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র।
দ্য সিকিউরিটি অ্যাসিসটেন্স মনিটরের প্রতিবেদনে ওবামা ও ট্রাম্পের শাসনামলে অস্ত্র বিক্রির প্রস্তাবের ক্ষেত্রে আরেকটি পার্থক্য দেখা গেছে। তারা বিদেশি সরকারের কাছে যে ধরনের সরঞ্জাম বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছিলেন তা আলাদা। ওবামার শাসনামলে সামরিক বিমান বিক্রিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। আর ট্রাম্পের শাসনের প্রথম বছরে ক্ষেপণাস্ত্র আর বোমা বিক্রি প্রাধান্য পেয়েছে।
আর্মস অ্যান্ড মিলিটারি এক্সপেন্ডিচার প্রোগ্রামের পরিচালক ড. অডে ফ্লিউর্যান্ট বলেছেন, ‘ওবামার আগে যেসব চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে সেগুলো থেকে দেখা যায়, ১৯৯০ সালের পর ২০১৩-২০১৭ মেয়াদেই যুক্তরাষ্ট্রর অস্ত্র রফতানি ছিল সবচেয়ে বেশি। এইসব চুক্তি এবং ২০১৭ সালে স্বাক্ষরিত হওয়া আরও কিছু বড় অস্ত্র চুক্তির কারণে যুক্তরাষ্ট্র সামনের বছরগুলোতেও অস্ত্র রফতানিকারক হিসেবে এগিয়ে থাকবে।
এরইমধ্যে সৌদি আরবের সঙ্গে ১২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্রচুক্তি চূড়ান্ত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। হোয়াইট হাউসে চুক্তির ঘোষণা অনুষ্ঠানে সৌদি যুবরাজকে স্বাগত জানানোর সময় ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘অস্ত্র ব্যবসায় সৌদি আরবের অনেক মানুষ কাজ করে।’
মার্কিন অস্ত্রের ৯৮ শতাংশই কিনেছে সৌদি
২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল সময়সীমায় অস্ত্র আমদানি দ্বিগুণ করেছে মধ্যপ্রাচ্য। ওই ৫ বছরে বিশ্বে মোট রফতানিকৃত অস্ত্রের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ গেছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। ধারাবাহিক অস্থিতিশীলতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন সত্ত্বেও সেখানে অস্ত্র বিক্রি অব্যাহত রেখেছে যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো। এতে মানবাধিকার নিয়ে তাদের অবস্থান প্রশ্নের মুখে পড়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর মোট রফতানিকৃত অস্ত্রের ৯৮ শতাংশ কিনেছে সৌদি আরব। সেখানে অস্ত্র রফতানির প্রশ্নে এরইমধ্যে প্রশ্নের মুখে পড়েছেন কানাডিয়ান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। ৫ বছরে মধ্যপ্রাচ্যে অস্ত্র আমদানি দ্বিগুণ হওয়ায় অস্থিতিশীল মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাতের ঝুঁকি আরও বেড়ে গেছে।
সংঘাত ও সশস্ত্রীকরণসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইন্সটিটিউট (এসআইপিআরই)-এর সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিগত ৫ বছরে মধ্যপ্রাচ্যের বেশিরভাগ দেশই সরাসরি সংঘর্ষে লিপ্ত ছিল। ওই অঞ্চলের দেশগুলোতে অস্ত্র আমদানি বেড়েছে ১০৩ শতাংশ। ২০১৩-২০১৭ মেয়াদে রফতানি হওয়া মোট অস্ত্র ৩২ শতাংশেরই আমদানিকারক মধ্যপ্রাচ্য।২০১৩-২০১৭ মেয়াদে মধ্যপ্রাচ্যে অস্ত্র আমদানির ক্ষেত্রে শীর্ষস্থান সৌদি আরবের। পৃথিবীর মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র আমদানিকারক দেশ তারা। ওই মেয়াদকালে দেশটির অস্ত্র আমদানি বেড়েছে ২২৫ শতাংশ। একই সময়ে তৃতীয় বৃহত্তম অস্ত্র আমদানিকারক দেশ মিসরের অস্ত্র আমদানির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে ২১৫ শতাংশ।
সংযুক্ত আরব আমিরাত ২০১৩-২০১৭ মেয়াদে চতুর্থ বৃহত্তম অস্ত্র আমদানিকারক দেশ হিসবে চিহ্নিত হয়েছে। আর অস্ত্র আমদানিতে বিংশতম স্থানে থাকা কাতার যেমন অস্ত্র আমদানি বাড়িয়েছে, তেমন ভবিষ্যৎ সরবরাহ বাড়াতে স্বাক্ষর করেছে বেশ কয়েকটি নতুন অস্ত্রচুক্তি।
এসআইপিআরআই আর্মস অ্যান্ড মিলিটারি এক্সপেন্ডিচার প্রোগ্রামের জ্যেষ্ঠ গবেষক পিটার উইজম্যান বলেছেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপকভাবে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ায় মানবাধিকার রক্ষায় অস্ত্র রফতানি নিয়ন্ত্রণ করার দাবিতে পশ্চিম ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় রাজনৈতিক বিতর্ক শুরু হয়েছে। তারপরও যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো মধ্যপ্রাচ্যে অস্ত্র রফতানি অব্যাহত রেখেছে এবং যার ৯৮ শতাংশই গেছে সৌদি আরবে।
ইউরো নিউজকে পিটার উইজম্যান বলেছেন, ‘মিসর একাধিক পক্ষের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত। এমনকি মিসরের অভ্যন্তরে সিনাইতেও সংঘর্ষ চলছে। আমদানি করা অস্ত্র খুব দ্রুতই সেখানে ব্যবহৃত হয়। সিনাইয়ের পাশাপাশি ইসলামিক স্টেটকে নিয়ে বড় ঝামেলা রয়েছে। তাছাড়াও আছে লিবিয়া। সেখানেও মিসরকে আমদানি করা যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহার করতে দেখা গেছে।’
আর এসআইপিআরআইয়ের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি জ্যান এলিয়াসনের বক্তব্য উদ্ধৃত হয়েছে সংস্থাটির ওয়েবসাইটে, ‘এভাবে অস্ত্র সরবরাহ বাড়লে তা আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার ওপর প্রভাব ফেলবে। এটি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে সমস্যাটির সমাধানে দরকার কার্যকর অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তির মতো আন্তর্জাতিকভাবে নেওয়া পদক্ষেপ।’