কক্সবাংলা ডটকম(১৩ নভেম্বর) :: বিশেষ ব্যবস্থায় চলতি বছরের জানুয়ারিতে ইসলামী ব্যাংক এবং অক্টোবরে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় বড় পরিবর্তন এসেছে। এর পর বর্তমানে ব্যাংক খাতে এক ধরনের পরিবর্তন আতঙ্ক বিরাজ করছে।
চট্টগ্রাম ভিত্তিক এস আলম গ্রুপ চলতি বছরে এ দুটি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। এর আগে ২০১৬ সালে বিকল্পধারা বাংলাদেশের মহাসচিব আবদুল মান্নানের শেয়ার কিনে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেয় এস আলম গ্রুপ। তাতেও ব্যাংকটির উন্নতি হয়নি।
এর আগে গত দুই বছরে এস আলম গ্রুপ একে একে কিনে নেয় ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক এবং এনআরবি ব্যাংক। এর বাইরে আরও একটি ইসলামী ব্যাংকের বেশীরভাগ শেয়ার তারা কিনে নিয়েছে।
সব মিলিয়ে দেশের ৮টি বড় বেসরকারি ব্যাংক নাটকীয়ভাবে দখল করে নিয়েছে এস আলম গ্রুপ। এর বাইরে আরও ৪টি লিজিং কোম্পানি এবং ৩টি ইন্সুরেন্স কোম্পানি তাদের দখলে রয়েছে।
কখনো আইন শৃঙ্খলা বাহিনী সঙ্গে নিয়ে আবার কখনো বিশেষ বাহিনীর নেতৃত্বে তারা এসব ব্যাংক-বীমা দখল করে নিচ্ছেন। আর বাংলাদেশ ব্যাংক অনেকটা অসহায়ের মত এসব কাজের অনুমোদন দিয়ে চলছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা বলেন, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের ইঙ্গিত ছাড়া এভাবে একের পর এক ব্যাংক দখল করা সম্ভব নয়। শুধু ব্যাংক নয়, এস আলম গ্রুপ এখন টিভি স্টেশন পর্যন্ত দখল করে নিচ্ছে।
এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদ প্রয়াত বিখ্যাত রাজনীতিবিদ আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর ভাগ্নে। মামার প্রতিষ্ঠানে চাকরি দিয়ে জীবন শুরু হয় মাসুদের। মামার সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় সেখান থেকে বেরিয়ে এসে তিনি ট্রেডিং ব্যবসা শুরু করেন। এখন বিভিন্ন ব্যাংকে তাঁর ৩৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ রয়েছে বলে জানা গেছে।
আর এ অবস্থায় দেশের ব্যাংক খাতে দিন দিন নড়বড়ে হয়ে পড়ছে। ৪৮টি ব্যাংকের মধ্যে ১৩টির আর্থিক অবস্থা বেশ খারাপ। এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ অনেক বেড়ে গেছে। সুশাসনের অভাবে বেড়েছে ঋণ অনিয়ম, যা নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সার্বিকভাবে ব্যংক খাতের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি ব্যবস্থা আগের চেয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে। এমনকি দুই বছর ধরে এই ১৩ ব্যাংকে পর্যবেক্ষক বসিয়েও পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না।
দেশে সরকারি-বেসরকারি-বিদেশি মিলে মোট ৫৭টি ব্যাংক রয়েছে। আর্থিক অবস্থার অবনতি হওয়া ১৩টি ব্যাংকের মধ্যে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ও বিশেষায়িত ব্যাংকই আটটি। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ কমার্স, ন্যাশনাল, ফারমার্স ও এনআরবি কমার্শিয়ালে পরিস্থিতি কয়েক বছর ধরে খারাপ হচ্ছে।
এ ছাড়া এক যুগ আগে বিলুপ্ত হওয়া ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের দুর্নীতির বোঝা এখনো টেনে চলেছে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। বাকি বেসরকারি ব্যাংকগুলোর বেশির ভাগের অবস্থাও সন্তোষজনক নয়।
বেসরকারি খাতের একাধিক ব্যাংকের মালিকানা বদল নিয়ে নজিরবিহীন ঘটনা ঘটলেও এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপই নেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। উল্টো কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাতে সায় দিয়েছে। ফলে ব্যাংক খাতের আমানতকারীসহ সংশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে।
ব্যাংক-সংশিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চোখের সামনে ২০১১ সালের পর থেকে বেসিক ব্যাংকের মতো লাভজনক ব্যাংক সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকের পরিণত হয়েছে। সঠিক দলিলপত্র যাচাই না করে ঋণ দেওয়া এসব আইন না মেনে একক গ্রাহকককে সীমার বাইরে ঋণ দেওয়ার উদাহরণ রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে এখন খুবই সাধারণ ঘটনা এতে বাড়ছে খেলাপি ঋণ, দায় পড়ছে জনগণের ওপর। এ কারণে করের টাকা থেকে সরকার এ ব্যাংকগুলোকে প্রতিবছর বড় অংকের মূলধন জোগান দিচ্ছে।
এ অবস্থায় আবারও নতুন করে কয়েকটি ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়ার তোড়জোড় শুরু হয়েছে। এর বাইরে বাংলাদেশ পুলিশ নতুন একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে। ব্যাংক খাতের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশে পুরো ব্যাংক খাতের পরিচালনা, ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যে ফাটল সৃষ্টি হয়েছে, যে কারণে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এত বাংকের লাইসেন্স দেওয়া ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। এ জন্যই নতুন ব্যাংকগুলোর অবস্থাও দ্রুত খারাপ হচ্ছে।
সম্প্রতি ব্যাংক মালিকদের চাপে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার এ সংশোধনী চূড়ান্ত হলে তাতে কয়েকটি পরিবারের মধ্যে ব্যাংকের মালিকানা কুক্ষিগত হয়ে পড়বে। কারণ, আইন সংশোধন করে ব্যাংকের পর্ষদে একই পরিবার থেকে চারজন এবং একটানা নয় বছর দায়িত্ব পালনের সুযোগ রাখা হচ্ছে। যদিও এরই মধ্যে চট্টগ্রামভিত্তিক একটি ব্যবসায়ী পরিবারের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে কয়েকটি ব্যাংক।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গত ১৫ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ব্যাংক খাত ভালো চলছে না। তিনি নিজেও মনে করেন এ জন্য দায়ী মূলত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বল তদারকি ব্যবস্থা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষণ
রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালীএ চার ব্যাংকের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে গত ১২ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের সভাপতিত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা (এমডি) উপস্থিত ছিলেন।
ওই বৈঠকের কার্যবিবরণীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ব্যাংক কোম্পানি আইন লঙ্ঘন করে ব্যাংকগুলোর পর্ষদে ঋণ প্রস্তাব উপস্থাপন করেন এমডিরা। অথচ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকিং নীতি ও প্রবিধি বিভাগের (বিআরপিডি) প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, পর্ষদে যেকোনো ঋণ প্রস্তাব উপস্থাপনের আগে এমডির দায়িত্ব হচ্ছে ব্যাংক কোম্পানি আইনের ব্যাত্যয় ঘটছে কিনা, তা যাচাই করা অথচ বড় বড় কিছু গ্রাহককে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রেও আইনকানুন মানা হচ্ছে না নির্ধারিত ঋণসীমার অতিরিক্ত ঋণ দেওয়া হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে কিছুদিন না যেতেই সেসব ঋণ খেলাপি হয়ে পড়ছে।
Posted ১:২৯ অপরাহ্ণ | সোমবার, ১৩ নভেম্বর ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta