কক্সবাংলা ডটকম(২২ মে) :: ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রাশিয়ার সোচি শহরে পৌঁছেছেন। সেখানে তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে অনানুষ্ঠানিক সম্মেলনে মিলিত হবেন। কিন্তু দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
রাশিয়া ভারতের শক্তিশালী অংশীদার যারা সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। দুই দেশেরই শক্তিশালী কৌশলগত, সামরিক, অর্থনৈতিক ও কূটনীতিক সম্পর্কের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।
দুই দেশই অর্থনীতি, রাজনীতি, প্রতিরক্ষা, বেসামরিক পারমাণবিক শক্তি, সন্ত্রাস-বিরোধী সহযোগিতা এবং মহাকাশ গবেষণা খাতে উন্নয়নের জন্য ভূমিকা রেখেছে।
দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক
২০০০ সালের অক্টোবরে ভারতের সাবেক প্রেসিডেন্ট অটল বিহারী বাজপেয়ী এবং প্রেসিডেন্ট পুতিন ‘ডিক্ল্যারেশান অন দ্য ইন্ডিয়া-রাশিয়া স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ’ চুক্তিতে সই করেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এটিই প্রথম এ ধরনের কোন রাজনৈতিক পদক্ষেপ। দ্বিপাক্ষিক বিনিময় বাড়ানো এবং বিভিন্ন খাতে সহযোগিতার বিষয়ে প্রয়োজনীয় কর্মকাণ্ডের পর্যবেক্ষণে বিভিন্ন পর্যায়ে প্রাতিষ্ঠানিক সংলাপের ব্যবস্থা করার জন্য দুই দেশের সম্পর্কের প্রকৃতি নির্ধারণ করা হয় ওই চুক্তিতে।
ইসলামাবাদের সাথে মস্কোর ঘনিষ্ঠতা
নয়াদিল্লী যখন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাদের সম্পর্কের উন্নয়ন শুরু করেছে, তখন পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক বাড়িয়েছে রাশিয়া। ২০১৬ সালে, দুই দেশ প্রথমবারের মতো যৌথ সামরিক মহড়ায় অংশ নিয়েছে। উরিতে সন্ত্রাসী হামলার প্রেক্ষিতে ওই মহড়া বন্ধের জন্য ভারত অনুরোধ জানানোর পরও মহড়া অনুষ্ঠিত হয়েছে।
২০১৫ সালে, লাহোর থেকে করাচি পর্যন্ত গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণের জন্য রাশিয়া ও পাকিস্তানের সরকার পর্যায়ে চুক্তি হয়।
চীন রাশিয়ার শক্তিশালী মিত্রদের মধ্যে অন্যতম এবং ভারতের প্রধান শত্রু পাকিস্তানের তারা মিত্র। সে কারণে এ অঞ্চলে প্রভাব বজায় রাখার জন্য পাকিস্তানের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কটি মস্কোর কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
সামরিক অংশীদারিত্ব
গত পাঁচ বছরে ভারতের আমদানিকৃত অস্ত্রের ৬২ শতাংশই ছিল রাশিয়ান। ২০০৮-২০১২ সালে তাদের আমদানিকৃত অস্ত্রের ৭৯ শতাংশ ছিল রাশিয়ান। গত মাসে স্টকহোম পিস রিসার্চ ইন্সটিটিউটের এক রিপোর্টে এ তথ্য জানানো হয়েছে। ভারতের ঐতিহ্যগত বেশ কিছু অস্ত্র ও সিস্টেম সোভিয়েত ও রাশিয়ার কাছে থেকে নেয়া। এগুলোকে সক্রিয় রাখতে গেলে রাশিয়ার সাথে প্রতিরক্ষা সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে ভারতকে।
অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব
২০১৪ সালের ডিসেম্বরে দুই দেশ ২০২৫ সালের মধ্যে ৩০ বিলিয়ন ডলারের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের লক্ষ্য নির্ধারণ করে। রাশিয়ান ফেডারেল কাস্টমস সার্ভিস ডাটা অনুযায়ী ২০১৬ সালে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৭.৭১ বিলিয়ন ডলার (২০১৫ সালের তুলনায় যেটা ১.৫ শতাংশ কম)।
রাশিয়া শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের জন্য ভারতের পারমানবিক চাহিদার কথা জানে। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাটমিক এনার্জি (ডিএই) এবং রাশিয়ার রোসাটোম ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে শান্তিপূর্ণ পারমানবিক সহযোগিতা জোরদার করার জন্য স্ট্র্যাটেজিক ভিশন চুক্তি স্বাক্ষর করে। ভারতের কুদানকুলাম নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টটি (কেকেএনপিপি) রাশিয়অর সহযোগিতায় নির্মিত হয়েছে।
মহাকাশ জ্বালানি
মহাকাশ গবেষণা নিয়ে ভারত-রাশিয়া অংশীদারিত্বের সম্পর্কটি চার দশকের পুরনো। ২০১৫ সালে ভারতের প্রথম স্যাটেলাইট ‘আরিয়াভাট’ উৎক্ষেপণের ৪০তম বার্ষিকী উদযাপন করা হয়। রাশিয়ার উৎক্ষেপণ যান সয়ুজ থেকে ওই স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল। দুই দেশই মনুষ্যবাহী মহাকাশযান পাঠানোর ব্যাপারে সম্ভাব্যতা যাচাই করেছে।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে সোচিতে অনানুষ্ঠানিক সম্মেলনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। প্রথম যে বার্তাটি তিনি রাশিয়াকে দিবেন, সেটা হলো পরিবর্তিত ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং বিশেষভাবে রাশিয়ার সামরিক রফতানির বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরও ভারত-রাশিয়ার প্রতিরক্ষা সহযোগিতার সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ থাকবে।
সূত্র জানিয়েছে, “ভারত তাদের প্রতিরক্ষা ক্রয়ের ব্যাপারে অন্য কোন দেশের নির্দেশনা মানবে না”।
রাশিয়া এখন পর্যন্ত ভারতের প্রধান সমরাস্ত্র সরবরাহকারী দেশ। ভারতের একটি সূত্র জানিয়েছে, “রাশিয়া বিশ্বস্ত এবং গ্রহণযোগ্য প্রতিরক্ষা সহযোগী। রাশিয়ার সাথে আমাদের সম্পর্ক অনেক গভীর”। ভারত তার প্রতিবেশীদের সাথে এই মুহূর্তে কিছুটা জটিল নিরাপত্তা সমস্যার মধ্যে রয়েছে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, আফগানিস্তানের অবনতিশীল নিরাপত্তা পরিস্থিতি এবং চীনের আঞ্চলিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ দরকার। ভারতের জন্য তাই এটা গুরুত্বপূর্ণ যাতে সে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার ক্রসফায়ারে না পড়ে যায় এবং নিজের স্বার্থ রক্ষা করতে পারে।
বিগত কয়েক বছর ধরে ভারতের সাথে আমেরিকার সুসম্পর্ক বাড়তে থাকায় এমনিতেই দূরে সরে গেছে পুরনো বন্ধু রাশিয়া। একই সাথে পাকিস্তান, চীন ও রাশিয়ার মধ্যে একটা সমান্তরাল সমীকরণও গড়ে উঠছে। এই কারণে ভারতের জন্য রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক পুণরায় ফিরিয়ে আনাটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে। একই সাথে তারা এ বার্তা দিতে চাচ্ছে যে “ভারত তাদের পুরনো বন্ধু এবং বিশ্বস্ত সহযোগীকে” মূল্যায়ন করে।
রাশিয়া এটাও ইঙ্গিত দিয়েছে যে, আফগানিস্তানে নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতির কারণে দুই পক্ষকেই সহযোগিতা করতে হবে। রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা সের্গেই কারাগানোভ ফেব্রুয়ারিতে নিউজ১৮-কে বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে সরে যেতে পারবে বলে তার মনে হচ্ছে না। তিনি বলেন, তার বিশ্বাস যে “রাশিয়া ও ভারতকে একটা পর্যায়ে এগিয়ে আসতে হবে একসাথে কাজ করতে হবে”।
আফগানিস্তানে ভারতের অবকাঠামো এবং সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টা তাদের জন্য প্রতিবেশী দেশটির জনগণের পক্ষ থেকে সুনাম বয়ে এনেছে এবং ভারত এ ক্ষেত্রে তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে চায়।
সূত্র জানিয়েছে, সুনির্দিষ্ট দ্বিপাক্ষিক ইস্যুতেই আলোচনা সীমিত থাকবে কারণ চলতি বছরের অক্টোবরে এরই মধ্যে বার্ষিক সম্মেলনের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। উহানে মোদি ও শি-এর অনানুষ্ঠানিক সম্মেলনে যেমনটা হয়েছিল, এখানেই একই ভাবে চিন্তা করা হচ্ছে। দুই নেতা যাতে বিশ্ব পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ আলোচনার সুযোগ পান, সেজন্যেই এই সম্মেলন। পশ্চিম এশিয়া বিশেষ করে সিরিয়া পরিস্থিতি এবং ইরান চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে আসার বিষয়টি নিয়েও আলোচনা হতে পারে।
সন্ত্রাসবাদ এবং আইসিসের বিষয়টিও প্রত্যাশিত পাঁচ-ঘন্টাব্যাপী আলোচনায় আসতে পারে। দুই নেতা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করবেন এবং এরপর লাঞ্চেও আলোচনা হবে তাদের মধ্যে। আলোচনা অনানুষ্ঠানিক হওয়ার কারণে বিস্তারিত আলোচনা হওয়া সত্বেও কোন যৌথ বিবৃতি দেয়া হবে না।