দীর্ঘ মন্দার কবলে দেশের শেয়ারবাজার। দিন দিন মূলধন হারাচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। কিছু কোম্পানির মানহীন আইপিও অনুমোদন দেওয়া হয়। এসব কেনায় বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছেন বিনিয়োগকারীরা। এ অবস্থায় পুঁজিবাজারে বড় ধরনের আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে। ৩ হাজার কোটি টাকার লেনদেন নেমে এসেছে ৩শ কোটির ঘরে। লেনদেন কমে যাওয়ায় ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্টস ব্যাংকগুলোকে রিজার্ভ থেকে মাসিক খরচ মেটাতে হচ্ছে। এজন্য অনেকেই কর্মী ছাঁটাইয়ে নেমেছে।
জানা গেছে, ২০১০ সালের শেয়ারবাজার ধসের পর দীর্ঘ সময়েও স্বাভাবিক গতি ফিরছে না দেশের শেয়ারবাজারে। আলোচ্য সময়ে নতুন করে অসংখ্য কারসাজির ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু কারও বিরুদ্ধেই কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। বর্তমানে আইপিও এবং প্লেসমেন্ট শেয়ারের অবৈধ বাণিজ্য অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। গত আট বছরে বর্তমান কমিশন ৯০টির অধিক কোম্পানির আইপিও অনুমোদন করে।
এর সিংহভাগই মানহীন। উল্টো প্রভাবশালীদের পক্ষ নিয়ে স্টক এক্সচেঞ্জকে তালিকাভুক্ত করে নিতে চাপ দিয়েছে বিএসইসি। বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, অতি মূল্যায়িতভাবে আইপিও অনুমোদন দিয়েছে কমিশন। বাজারে আসার পর থেকেই কমছে শেয়ারের দাম। এগুলো কিনে দিন-দিন নিঃস্ব হচ্ছেন বিনিয়োগকারী। সম্প্রতি বাজারের অস্থিরতার পেছনে দুর্বল কোম্পানিকে দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা। অন্যদিকে কোম্পানির উদ্যোক্তারা নিজেও শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে অর্থ তুলে নিচ্ছেন।
গত কয়েক বছরে বাজারে নতুন শেয়ার প্রিমিয়ামসহ তালিকাভুক্ত হয়েছে। এসব শেয়ার প্রথম দিন ৭০/৮০ টাকায় বিক্রি হয়। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে শেয়ারের মূল্য কমতে কমতে অভিহিত মূল্যের নিচে নেমেছে। কোনো কোনো শেয়ার ২-৩ টাকায়ও পাওয়া যাচ্ছে।
২০১৩ সালে তালিকাভুক্ত হয় বস্ত্র খাতের কোম্পানি ফ্যামিলিটেক্স। বর্তমানে কোম্পানির শেয়ার মূল্য ২ টাকা ৮০ পয়সা। তালিকাভুক্তির সময় কোম্পানির উদ্যোক্তাদের হাতে ছিল ৪৬ শতাংশ শেয়ার। বর্তমানে রয়েছে ৪ শতাংশ শেয়ার। অর্থাৎ কোম্পানির উদ্যোক্তারা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন। অথচ কোম্পানির উদ্যোক্তাদের হাতে ৩০ শতাংশ শেয়ার থাকার কথা ছিল।
২০১২ সালে তালিকাভুক্ত হয় জেনারেশন নেক্সস ফ্যাশন। বর্তমানে কোম্পানির প্রতি শেয়ার ৩ টাকা ৮০ পয়সায় লেনদেন হচ্ছে। তালিকাভুক্তির সময় কোম্পানির উদ্যোক্তাদের হাতে ছিল ৩৭ শতাংশ শেয়ার। বর্তমানে কোম্পানির উদ্যোক্তাদের হাতে আছে ১৩ শতাংশ শেয়ার।
অ্যাপোলো ইস্পাত লিমিটেড ২০১৩ সালে তালিকাভুক্ত হয়। প্রতিটি শেয়ারের বর্তমান বাজারমূল্য ৫ টাকা। তালিকাভুক্তির সময় উদ্যোক্তাদের হাতে ছিল ৩১ শতাংশ শেয়ার। বর্তমানে রয়েছে ২০ শতাংশ শেয়ার। এ রকম আরও অর্ধশত কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছেন বিনিয়োগকারীরা। তবে তাদের বিনিয়োগ সুরক্ষায় কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়নি নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
এছাড়া সম্প্রতি মুন্নু সিরামিক, মুন্নু স্টাফলার, বিডি অটোকার, লিগ্যাসি ফুটওয়ারসহ অনেক কোম্পানি নিয়ে কারসাজি হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ, কারসাজিকারীরা অন্যায়ভাবে যে পরিমাণ মুনাফা করেছে, তার ১০ ভাগের একভাগও জরিমানা করা হয়নি। এর ফলে এ দিকে কারসাজিতে অসাধু চক্রের আগ্রহ বেড়ে গেছে, ঠিক বিপরীতভাবে আস্থা কমেছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের।
পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম (এআইএস) বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, দুর্বল কোম্পানির খারাপ পারফরম্যান্স পুঁজিবাজারের জন্য ফ্যাক্টর।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, গত কয়েক বছরের প্লেসমেন্ট শেয়ার ও দুর্বল আইপিওর কারণে বাজারের ভারসাম্য হারিয়েছে। এ ছাড়া কয়েক মাস ধরেই বাজার স্বাভাবিক গতিতে চলছে না। এ জন্য আতঙ্কিত হয়ে বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। ফলে বাজার অস্বাভাবিক আচরণ করছে।
সম্প্রতি কয়েকদিনের টানা দরপতনে বিনিয়োগকারীদের লোকসানের পাল্লা এতই ভারী হয়েছে যে, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের জন্য রীতিমতো আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুনাফার স্বপ্ন তো দূরে থাক, লসেই শেয়ার বিক্রি করছেন অনেকে। শঙ্কা জেগেছে লোকসানের পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। যারা ঋণ করে শেয়ার কিনেছেন, তাদের অবস্থা আরও খারাপ। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, সাধারণ বিনিয়োগকারী শেয়ারবাজার ঠিক করতে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
ডিএসইর এক পরিচালক জানিয়েছেন, বিচার সংস্কৃতি গড়ে না ওঠায় বাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরছে না। শেয়ারবাজারে আসা নতুন কোম্পানির অনেকগুলোই নিম্নমান, দুর্বল মৌলভিত্তি ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে অনুমোদন নিয়ে বিনিয়োগকারী থেকে শুরু করে বাজার-সংশ্লিষ্ট সবার মনেই ছিল নানা প্রশ্ন ও সংশয়। তাদের মধ্যে কিছু কোম্পানির আইপিও অনুমোদনের সঙ্গে বিএসইসির বিরুদ্ধে ‘অবৈধ আর্থিক লেনদেনের’ অভিযোগ উঠেছে।
নানা সুবিধার বিনিময়ে এসব নিম্নমানের কোম্পানিকে বাজারে আসার সুযোগ করে দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। তবে এসব অভিযোগের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি। আবার এসব অভিযোগ যাচাই করার জন্য যে ধরনের নিরপেক্ষ তদন্ত দরকার ছিল, তা-ও হয়নি।
Posted ৪:৪৪ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ২০ অক্টোবর ২০১৯
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta