কক্সবাংলা ডটকম(১৪ মে) :: মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে এক লাখ ২০ হাজার সৈন্য পাঠানোর কথা ভাবছে যুক্তরাষ্ট্র। ইরানে হামলার ছক তৈরি করে সেদেশের ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে নতুন এ পরিকল্পনা উপস্থাপন করা হয়েছে। এর আগে গত ১২ মে মার্কিন কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদ জানায়, পরমাণু চুক্তি ও হরমুজ প্রণালি নিয়ে ইরানের সঙ্গে বাড়তে থাকা উত্তেজনার মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে একটি প্যাট্রিয়ট আকাশ প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থাপনা ও যুদ্ধজাহাজ পাঠাচ্ছে। উভচর যান ও উড়োজাহাজ পরিবহনে সক্ষম ইউএসএস আর্লিংটন শিগগিরই উপসাগরে থাকা অপর যুদ্ধজাহাজ ইউএসএস আব্রাহাম লিংকনের সঙ্গে যোগ দেবে বলে জানান তাঁরা। এরই মধ্যে কাতারের মার্কিন ঘাঁটিতে বেশ কয়েকটি বি-৫২ বোমারু বিমান পৌঁছেছে বলেও পেন্টাগন জানিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন বাহিনীর ওপর ইরানের সম্ভাব্য হামলার হুমকি মোকাবেলায় এসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। তেহরানের কাছ থেকে হুমকির মাত্রা সম্পর্কে সুস্পষ্ট কিছু বলেননি মার্কিন কর্মকর্তারা। অন্যদিকে, ইরান তাদের দিক থেকে হুমকির বিষয়টিকে ‘বাজে কথা’ বলে উড়িয়ে দেয়। শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটিতে হস্তক্ষেপের লক্ষ্যে ‘মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ’ চালাতেই ওয়াশিংটন মধ্যপ্রাচ্যে একের পর এক অস্ত্র ও যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করছে বলে অভিযোগ তাদের। ইরানের আধা সরকারি বার্তা সংস্তা ইরনা দেশটির জ্যেষ্ঠ ধর্মীয় নেতা ইউসুফ তাবাতাবি-নেজাদের বরাত দিয়ে জানায়, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক নৌযান (ইরানের) কেবল একটি ক্ষেপণাস্ত্রেই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।’পেন্টাগন বলে, তারা ইরানের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়াতে চায় না। তবে ওয়াশিংটন ওই অঞ্চলে মার্কিন বাহিনী এবং স্বার্থের সুরক্ষায় প্রস্তুত। গত শুক্রবার এক বিবৃতিতে পেন্টাগন জানায়, ইরানের কার্যক্রমে কড়া নজরদারি অব্যাহত রাখছে মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়।
এদিকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার জেরে ইরান থেকে ভারত জ্বালানি তেল কেনা বন্ধ করলেও কূটনৈতিক তৎপড়তা চালাচ্ছে ইরান। সম্প্রতি ভারত সফরে এসে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের সঙ্গে দেখা করেছেন ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জাভেদ জারিফ। পর্যবেক্ষকদের ধারণা, ভারতে তেল রফতানি অব্যাহত রাখতে চাবাহার বন্দরকে হাতিয়ার করতে পারে ইরান। ফলে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ও ইরানের কূটনৈতিক তৎপড়তায় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে ভারত। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি ভারতের এই উভয় সংকট নিয়ে বিশেষ এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানা গেছে।
গত নভেম্বরে আমেরিকার ট্রাম্প প্রশাসন যখন নতুন করে ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা চাপায়, তখন ভারত-সহ আটটি দেশকে ইরান থেকে তেল কেনার ক্ষেত্রে সাময়িক ছাড় দেওয়া হয়েছিল। তবে চলতি বছর মে মাসে সেই অব্যাহতির মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। আর এই পরিস্থিতিতেই ভারত ও ইরান দুই দেশই সংকটে পড়েছে।
মার্কিন নিষেধাজ্ঞার জেরে ইরান থেকে ভারত জ্বালানি তেল কেনা বন্ধ করার মাত্র কয়েকদিনের মাথাতেই ভারতে জরুরি সফর করেন ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী। মঙ্গলবার দুপুরে দিল্লিতে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের সঙ্গে বৈঠক করে তেহরান ফিরে গেলেও এখনও কোনও দেশই বিবৃতি দেয়নি। পর্যবেক্ষকদের ধারণা, ভারত যেন ইরান থেকে তেল কেনা অব্যাহত রাখে সে জন্য তেহরান দিল্লিকে চাপে রাখতে চাইছে – আর এ জন্য দরকষাকষির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে চাবাহার বন্দরকে।
দিল্লিতে শীর্ষস্থানীয় ইরান-বিশেষজ্ঞ কামার আগা বিবিসিকে বলছিলেন, “বস্তুত ইরান ভীষণভাবে চায় ভারত তাদের থেকে আগের মতো তেল কেনা অব্যাহত রাখুক, তবে ভারতের সমস্যা হচ্ছে তাদের ওপর পশ্চিমা দেশগুলোর সাঙ্ঘাতিক চাপ।” তিনি বলেন, নানা কারণে সামনে জাতিসংঘ, ফিনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স ইত্যাদি ফোরামে যু্ক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ভারতের জন্য খুব জরুরি।’
তিনি আরও বলেন, ‘ভারত সবসময়ই দাবি করে থাকে তাদের পররাষ্ট্রনীতি সম্পূর্ণ স্বাধীন – এখন ইরানের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমি বলব ভারতের সেই পররাষ্ট্রনীতিই এক কঠিন পরীক্ষায় পড়েছে।’
এই পটভূমিতেই সোমবার রাতে দিল্লিতে নামেন ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জাভেদ জারিফ। গত চার মাসের মধ্যে এটি তার দ্বিতীয় সফর। জারিফ বলেন, ‘রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আঞ্চলিক ক্ষেত্রে’ ভারতকে তাদের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। নিষেধাজ্ঞা থেকে অব্যাহতি উঠে যাওয়ার পর উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলতেই তার দিল্লি আসা।
বিবিসি জানায়, ভারতের জন্যও ইরান থেকে অপরিশোধিত তেল কেনা অনেক সুবিধাজনক – কারণ তাতে পরিবহন খরচ ও দাম দুটোই কম পড়ে। ভারতের অন্তত তিনটি রিফাইনারি বা তেল পরিশোধনাগারও পুরোপুরি ইরানের তেলের ওপর নির্ভরশীল ছিল মাত্র কিছুদিন আগে পর্যন্তও।
জ্বালানি খাতের সিনিয়র সাংবাদিক জ্যোতি মুকুল বলেন,‘গত কয়েক মাসে কিন্তু ভারত ইরানি তেলের বিকল্প কিছু কিছু ব্যবস্থাও নিতে শুরু করেছে। পাশাপাশি চীন, জাপান, ভারতের মতো বৃহৎ ক্রেতা দেশগুলো একটা কনজিউমার ব্লক তৈরি করে এক সুরে কথা বলারও চেষ্টা করছে, কেন এশিয়ার দেশগুলো তেলের বেশি দাম দেবে সেই প্রশ্নও তুলছে।’
জ্যোতি মুকুল বলেন, ‘তবু আমি বলব, ইরান থেকে তেল কতটা কম আসবে সেই প্রশ্নটা যতটা না-দামের – বরং তার চেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির”, বলছেন মিস মুকুল।
ইরান সঙ্কটে বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের দাম সম্প্রতি অনেকটাই বেড়েছে – কিন্তু ভারতে লোকসভা নির্বাচনের সময় সরকার পেট্রল-ডিজেলের দামে ততটা আঁচ পড়তে দেয়নি। অনেকের আশঙ্কা, নির্বাচন শেষ হলেই তেলের দাম অনেকটা বেড়ে যেতে পারে।
প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য অসীমা গোয়েলের দাবি, ‘গত বছর একটা সময় ভাবা হচ্ছিল তেলের দাম একশো ডলার ছোঁবে, যদিও তা শেষ পর্যন্ত হয়নি। সেই অভিজ্ঞতার পর আমি কিন্তু এবারও আশাবাদী দামটা নাগালের মধ্যেই থাকবে। সৌদি-সহ ওপেক দেশগুলোর ওপর মার্কিন চাপ, শেল গ্যাস বা নানা ধরনের বিকল্প গ্রিন এনার্জির কারণে আমার মনে হয় না তেলের দাম বেড়ে যাবে।”
এদিকে কামার আগা নিশ্চিত যে এদিন সুষমা স্বরাজের সঙ্গে বৈঠকে ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী অবধারিতভাবে চাবাহারকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
পাকিস্তানের দক্ষিণ-পশ্চিম জলসীমার খুব কাছে অবস্থিত চাবাহার বন্দরের আধুনিকীকরণ ও সম্প্রসারণে বড় অংকের বিনিয়োগ করে ভারত। বিনিময়ে মেলে চাবাহার বন্দর ব্যবহারের অধিকার। এই বন্দর থেকে ৭২ কিলোমিটার দূরে পাকিস্তানে চীন গদর বন্দর নির্মাণ করছে। ফলে চাবাহার বন্দরটি ভারতের কাছে ও মধ্য এশিয়া ও আফগানিস্তানের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তানকে বাইপাস করে এই বন্দরের সাহায্যেই ইরান ও আফগানিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্য করতে পারবে ভারত।
ইরান যাতে পাকিস্তান বা চীনের দিকে বেশি না ঝোঁকে, সেটাও ভারত নিশ্চিত করতে চায়। ফলে একদিকে সস্তা তেল, চাবাহার ও ইরানের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক আর অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে সমর্থনের প্রয়োজনীয়তা – এই চরম উভয় সঙ্কটের মধ্যেই সমাধানের পথ খুঁজতে হচ্ছে দিল্লিকে।
Posted ২:৩৩ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ১৫ মে ২০১৯
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta