কক্সবাংলা ডটকম(৩১ মে) :: কাকে বেছে নেবে ভারত? পুরনো মিত্র রাশিয়া, নাকি ক্রমেই কাছে আসা অংশীদার যুক্তরাষ্ট্র? প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের ৬৫ শতাংশই রাশিয়ায় তৈরি হওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশের জন্য দিল্লি মস্কোর ওপর নির্ভরশীল। আবার যুক্তরাষ্ট্রের অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রও পেতে চায় ভারত। চীনের সঙ্গে শক্তির ভারসাম্য এবং আফগানিস্তানে পাকিস্তানকে হটিয়ে নিজস্ব প্রভাব বলয় তৈরির জন্যও ওয়াশিংটনের সঙ্গে কৌশলগত সহযোগিতা জরুরি। এ অবস্থায় পরস্পরবৈরী যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে ভারত কার সঙ্গে যাবে? আসন্ন ইন্দো-ইউএস টু প্লাস টু ডায়ালগে দিল্লির কাছে এ প্রশ্নটিই রাখতে যাচ্ছে ওয়াশিংটন। খবর ইকোনমিক টাইমস।
জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী জিম ম্যাটিসের সঙ্গে সংলাপে বসবেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ। টু প্লাস টু সংলাপ নামে পরিচিত এ যৌথ আলোচনায় দুপক্ষ গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত ইস্যুগুলো নিয়ে মতবিনিময় ও দরকষাকষি করবে। তবে রক্ষণশীল প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন গোড়াতেই জানতে চাইবে, প্রতিরক্ষা খাতে মুখ্য অংশীদার হিসেবে ভারত যুক্তরাষ্ট্র না রাশিয়াকে চায়?
ওয়াশিংটনের নীতিনির্ধারকদের চিন্তাভাবনা সম্পর্কে অবহিত একটি সূত্র জানিয়েছে, ভারতের কাছে সর্বাধুনিক সমরাস্ত্র ও প্রযুক্তি হস্তান্তরে যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তি নেই। তবে সেগুলো রুশ যুদ্ধাস্ত্রের পাশে একই প্লাটফর্মে ব্যবহার হবে ভেবেই মার্কিন কর্মকর্তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ। এজন্যই রাশিয়ার কাছ থেকে ভারতের এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র কেনার বিষয়টিতে যুক্তরাষ্ট্র গভীর দৃষ্টি রাখছে।
টু প্লাস টু সংলাপের আগে জুনের মাঝামাঝি সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিনিধি দল দিল্লি আসবে। কমিউনিকেশন্স কম্প্যাটিবিলিটি অ্যান্ড সিকিউরিটি এগ্রিমেন্ট (কমকাসা) প্রটোকল নিয়ে কথা বলতে আসবে দলটি। প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি সুরক্ষা এবং দুই দেশের সশস্ত্র বাহিনীর পারস্পরিক প্রয়োজনে যুদ্ধসরঞ্জাম পরিচালনার জন্য যুক্তরাষ্ট্র এ প্রটোকল স্বাক্ষরে জোর দিচ্ছে। বিপত্তিটা এখানেই। কমকাসা প্রটোকল স্বাক্ষর করলে ভারতকে রাশিয়ার কাছে বিশ্বস্ততা নিয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। সেক্ষেত্রে বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদারে এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র কেনার চিন্তা থেকে পিছু হটতে হবে। ৫০০ কোটি ডলারে এ রকম পাঁচটি ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা হস্তান্তরের ব্যাপারে গত সপ্তাহেই কথা পাকাপাকি করেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। চার মাসের মধ্যে এ বিষয়ে চুক্তি হওয়ার কথা।
রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র কেনার বিষয়ে ভারতকে আগাম হুমকি দিয়ে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা রাশিয়ার কাছ থেকে বড় অংকের কেনাকাটা করলে ভারতকেও একইরকম ব্যবস্থার মুখোমুখি হতে হবে বলে জানিয়েছেন ওয়াশিংটনের কর্মকর্তারা। তারা ভারতের বিরুদ্ধে কাটসা (কাউন্টারিং আমেরিকা’স অ্যাডভারসারিজ থ্রু স্যাংকশনস অ্যাক্ট) আইনে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের মুখ্য উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী (রাজনৈতিক ও প্রতিরক্ষা বিষয়াদি) টিনা কাইদানো গত শুক্রবার ওয়াশিংটনে সাংবাদিকদের বলেন, কাটসা আইনকে যেনতেনভাবে দেখলে চলবে না। ট্রাম্প প্রশাসন বরাবরই মার্কিন আইনের প্রশ্নে কঠোর। আমি আশা করি, শুধু ভারত নয়, সব দেশই এটা বুঝবে, রাশিয়ার কাছ থেকে চড়া দামের অস্ত্রপাতি কিনলে আমাদেরকে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।
এদিকে ডিফেন্সনিউজ সাময়িকী গতকাল জানিয়েছে, রুশ প্রেসিডেন্ট ও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এড়াতে যৌথ পরিকল্পনা গ্রহণের প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। গত ২১ মে সোচিতে অনুষ্ঠিত বৈঠকে দুই নেতা এ প্রত্যয়ের কথা বলেন। ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেছেন, আমাদের সরঞ্জামের প্রায় ৬৫ শতাংশই রাশিয়ায় তৈরি। কাজেই এ নিষেধাজ্ঞা মানলে আমাদের যন্ত্রাংশ সরবরাহ ব্যাহত হবে।
এর আগে ১০ মে মস্কোতে রুশ জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা নিকোলাই পাত্রুশেভ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভের সঙ্গে বৈঠক করেন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল ও পররাষ্ট্র সচিব বিজয় কেশব গোখলে। গত মাসে মস্কো সফর করেন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ। এসব সফরে এ দুপক্ষের মধ্যে ১ হাজার কোটি ডলারের সমরাস্ত্র হস্তান্তরের বিষয়ে কথা হয়েছে বলে সূত্রটি জানায়।
ব্লুমবার্গ জানিয়েছে, ওয়াশিংটনের মুখোমুখি দিল্লির শক্ত অবস্থান নেয়ার স্পষ্ট আভাস দিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। সোমবার নয়াদিল্লিতে নিজের বার্ষিক প্রেস কনফারেন্সে তিনি বলেন, ভারত শুধু জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা অনুসরণ করে। যুক্তরাষ্ট্র অথবা অন্য কোনো দেশের নিষেধাজ্ঞা ভারত মানবে না।
তেহরানের বিরুদ্ধে ওয়াশিংটনের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ভারত ইরান থেকে তেল কিনবে কিনা এ মর্মে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি উপরের মন্তব্য করেন। সুষমা আরো বলেন, অতীতে আমরা মার্কিন নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইরান, ভেনিজুয়েলা ও উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে ব্যবসা করেছি। যুক্তরাষ্ট্র সরকার উত্তর কোরিয়ায় দূতাবাস বন্ধের অনুরোধ করলেও আমরা কর্ণপাত করিনি। এবারো আমাদের নীতির ব্যত্যয় হবে না।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর শক্ত মন্তব্য শুধু মনস্তাত্ত্বিক কূটনীতি নয়, রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি এবং দলীয় রাজনীতিরও স্বার্থে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের যে হারে মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে, তাতে ইরানের মতো দীর্ঘদিনের সরবরাহকারক ছেড়ে নতুন উৎস খুঁজতে ভারতকে বেগ পেতে হবে। অভ্যন্তরীণ প্রয়োজনের ৮০ শতাংশ জ্বালানি ভারত আমদানি করে। ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞার সময়ও ভারত সেদেশ থেকে তেল কিনেছে।
কম সময়ে সরবরাহে সক্ষম ইরান ভারতকে তেল পরিবহনের ব্যয় থেকেও ছাড় দেয়। বিশ্বে তেলের তৃতীয় বৃহত্তম আমদানিকারক দেশটি তাহলে কেন ইরান থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে? উপরন্তু নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সরকারের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতেও তেলের মূল্যে সতর্ক চোখ রাখতে হচ্ছে।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল জানিয়েছে, তেলের মূল্য ওঠানামায় ভারত এমনিতেই নাজুক অবস্থায় থাকে। এর ফলে দেশটিতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়, কমে যায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও ভোগব্যয়। ভারত সরকারের চলতি হিসাব ঘাটতি এখন জিডিপির ২ শতাংশ, যা তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে আরো বাড়বে। ব্যাংক অব আমেরিকা মেরিল লিঞ্চ বলেছে, তেলের দাম ব্যারেলে ১০ ডলার বাড়লে ভারত জিডিপির শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ হারায়।
এ অবস্থায় আগামী বছর নির্বাচনকে সামনে রেখে নরেন্দ্র মোদি সরকার নিশ্চয়ই তেল বাবদ আমদানি ব্যয় বাড়াতে চাইবে না। সুষমা স্বরাজ সেজন্যই সোমবার সংবাদ সম্মেলনের পর ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন। এ থেকেই স্পষ্ট, মার্কিন চাপাচাপি সত্ত্বেও নিজের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়া ছাড়া ভারতের গত্যন্তর নেই।
Posted ৩:২০ অপরাহ্ণ | শুক্রবার, ০১ জুন ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta