কক্সবাংলা ডটকম(২৫ ফেব্রুয়ারী) :: সংঘাত-জর্জরিত উত্তর রাখাইনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অন্তত ৯০ শতাংশ সরকারের ক্লিয়ারেন্স অপারেশনের জেরে প্রতিবেশী বাংলাদেশে চলে গেছে। মিয়ানমার সরকার ও আন্তর্জাতিক এনজিওগুলোর পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে দি ইরাবতীর হিসাবে এ সংখ্যা বেরিয়ে এসেছে।
আগস্টে হামলার পর থেকে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ মংডু ও বুথিডং এবং নিকটবর্তী রাথেডং এলাকা থেকে প্রতিবেশী দেশের শরণার্থী শিবিরে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুর ঢল নামে। শরণার্থী শিবিরে থাকা রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে বিনাবিচারে হত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের বর্ণনা দিয়েছে।
তিনটি বসতি এলাকার বিষয়ে জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ডিপার্টমেন্টের (জিএডি) সাম্প্রতিক আঞ্চলিক পরিসংখ্যান প্রতিবেদনগুলো বিশ্লেষণ করেছে দি ইরাবতী। এসব প্রতিবেদন ২০১৭ সালের অক্টোবরের বলে জিএডি জানায়। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী-নিয়ন্ত্রিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা জিএডি।
জিএডির প্রতিবেদনের পাশাপাশি দি ইরাবতী জাতিসংঘের মানবিক কার্যক্রম সমন্বয় সংস্থার (ওসিএইচএ) গণনায় বাংলাদেশের শিবিরগুলোয় রোহিঙ্গার সংখ্যা হিসাব করেছে। ওসিএইচএ বলেছে, ২৫ আগস্ট থেকে ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত নতুন আসা ৬ লাখ ৮৮ হাজার রোহিঙ্গাকে নিবন্ধন করা হয়েছে।
জিএডি প্রতিবেদনে সর্বশেষ সহিংসতার আগে মংডু, বুথিডং ও রাথেডংয়ে রোহিঙ্গার মোট সংখ্যা ৭ লাখ ৬৭ হাজার ৩৮ জন বলা হয়েছে। মংডু ডিস্ট্রিক্ট জিএডির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দি ইরাবতীকে বলেছেন, এ পরিসংখ্যান ২০১৭ সালের। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে তিনি এ কথা বলেন। মংডু ও বুথিডং বসতি এলাকা নিয়ে মংডু ডিস্ট্রিক্ট।
জিএডির হিসাবের সঙ্গে ওসিএইচএর নিবন্ধন সংখ্যা তুলনা করলে দেখা যায়, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রায় ৯০ শতাংশ বাংলাদেশে চলে গেছে এবং মাত্র ১০ শতাংশ (৭৯ হাজার ৩৮ জন) পশ্চিম মিয়ানমারের তিনটি বসতিতে থেকে গেছে। যারা মারা গেছে, নিখোঁজ অথবা গ্রেফতার হয়েছে তারা বাংলাদেশে যাওয়া ৯০ শতাংশের মধ্যে নেই।
গত অক্টোবরের তথ্য বলে জানালেও জিএডির প্রতিবেদনে অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত, হতাহত রোহিঙ্গা, হিন্দু অথবা রাখাইন মানুষের সংখ্যা নেই। সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ক্ষয়ক্ষতির তথ্যও নেই। যদিও গত ৩১ আগস্ট তারিখে মিয়ানমার সেনাবাহিনী বা তাতমাদো সন্দেহভাজন ৩৭০ জন আরসা জঙ্গিকে হত্যার কথা জানায়।
জিএডির তথ্যমতে, মংডুর অধিবাসীর ৯৩ শতাংশ রোহিঙ্গা। বুথিডংয়ে রোহিঙ্গা ৮৪ শতাংশ। রাথেডংয়ে রোহিঙ্গা অধিবাসীর হার যথেষ্ট কম, মাত্র ৬ শতাংশ।
(আরকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) আক্রমণে মংডু ডিস্ট্রিক্টে প্রায় ৩০ হাজার অমুসলিম অধিবাসী বাস্তুচ্যুত হয়। এদের মধ্যে ম্রো, থেট, দাইঙ্গেত ইত্যাদি আরাকান উপজাতির পাশাপাশি হিন্দুও রয়েছে। তবে অমুসলিম ও বৌদ্ধদের বেশির ভাগ এরই মধ্যে মংডুতে ফিরে এসেছে। আর বাস্তুচ্যুত কয়েকশ হিন্দু সরকারি উদ্যোগে পুনর্বাসনের অপেক্ষায় আছে।
জিএডি প্রতিবেদনে ‘বাঙালি’ ও ‘রোহিঙ্গা’ শব্দ দুটি ব্যবহার করা হয়নি। ২০১৬ সালে সু চি মার্কিন দূতাবাসকে ‘রাখাইনের মুসলিম সম্প্রদায়’ শব্দবন্ধ ব্যবহারের অনুরোধ করেছিলেন। সু চির নির্দেশনামতো পরবর্তীতে কফি আনান কমিশনও ‘রোহিঙ্গা’ শব্দ ব্যবহার করেনি। জিএডি সু চির ওই শব্দবন্ধও ব্যবহার করেনি।
আগের শব্দগুলো বাদ দিয়ে জিএডির প্রতিবেদনে শুধু ‘বিদেশী’ অথবা ‘বাংলাদেশী’ বলা হয়েছে, যাতে এটা বোঝায় যে, এসব মানুষ বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসী। মংডু ও বুথিডংয়ে জিএডি কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন যে, প্রতিবেদনে ‘বাংলাদেশী’ শব্দটির মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের বোঝানো হয়েছে।
তিনটি বসতি এলাকায় রাখাইন ও মুসলিম গ্রাম কয়টি করে, তা জিএডি প্রতিবেদনে স্পষ্ট বলা হয়নি। শুধু মোট গ্রামের সংখ্যা বলা হয়েছে। মংডু ও বুথিডংয়ের জিএডি কর্মকর্তাদের মতে, মংডুতে মোট গ্রাম ৩৬৪টি, যার মধ্যে ২৭২টি মুসলিম অধ্যুষিত। অর্থাৎ মংডুর ৭৪ শতাংশ গ্রাম মুসলিম অধ্যুষিত।
মাসব্যাপী সেনা অভিযানে প্রায় ৭০টি গ্রাম অগ্নিসংযোগ থেকে রক্ষা পায় বলে তারা জানান।
বুথিডংয়ে মোট গ্রাম ৩৩৯টি। এর মধ্যে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত ১৭৩টি বা প্রায় ৫১ শতাংশ। বুথিডংয়ে জিএডির একজন কর্মকর্তা জানান, রোহিঙ্গা অধ্যুষিত ১৭৩টি গ্রামের মধ্যে ৩০টি আগুনে পুড়ে মাটিতে মিশে গেছে। বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় তিনি পরিচয় প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়েছেন।
রাথেডং বসতি এলাকা রাখাইন প্রভাবাধীন। সেখানে রোহিঙ্গাদের গ্রাম মাত্র ২২টি। রোহিঙ্গা সূত্রগুলো জানিয়েছে, সেখানে মাত্র দুই-তিনটি গ্রাম আগের মতো আছে। বাকিগুলো সম্পূর্ণ জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে।
জিএডির প্রতিবেদনে মংডুতে ৮৩৬টি মুসলিম ধর্মীয় স্থাপনার কথা উল্লেখ আছে। এছাড়া সেখানে ৮৪টি বৌদ্ধ মঠ এবং ৬১টি প্যাগোডা ও মন্দির রয়েছে। সংস্থাটি বুথিডংয়ে ৪৪২টি ও রাথেডংয়ে ৮৭টি মুসলিম ধর্মীয় স্থাপনার কথা উল্লেখ করেছে। আর বৌদ্ধ মঠের সংখ্যা প্রায় ৪০০টি বলা হয়েছে। দুটি বসতিতে আরো আছে ১১০টি স্তূপ ও মন্দির। মুসলিম ও বৌদ্ধ ধর্মীয় স্থাপনার বাইরে মংডুতে হিন্দুদের ১৭টি মন্দির ও খ্রিস্টানদের একটি গির্জার কথা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
বিগত বছরে রাখাইন ও রোহিঙ্গা উভয় সম্প্রদায়ের কিছু ধর্মীয় স্থাপনা ধ্বংস করা হয়েছে। আরাকান ন্যাশনাল পার্টির মংডু শাখার সভাপতি উ খিন মং থান শুধু দুটি বৌদ্ধ ধর্মীয় স্থাপনা ধ্বংসের কথা জানিয়েছেন। বুথিডংয়ের একজন মুসলিম কর্মচারী জানিয়েছেন, বিগত বছরের শেষদিক থেকে এ পর্যন্ত কমপক্ষে ২০টি মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছে।
এ বিষয়ে বুথিডংয়ে জিএডির একজন পদস্থ কর্মকর্তা বলেছেন, এসব স্থাপনা সম্ভবত আগস্ট-ডিসেম্বর সময়কালে ধ্বংস করা হয়েছে। তবে আমার জানা মতে, নতুন করে এমন কোনো ঘটনা ঘটছে না।
তবে বুথিডংয়ের এক অধিবাসী পরিচয় গোপন রাখার শর্তে জানিয়েছেন, চলতি মাসের শুরুতেও টংবাজার এলাকায় বর্ডার পুলিশ ফাঁড়ির কাছেই অর্ধশত বছরের পুরনো মসজিদ ভেঙে ফেলা হয়েছে। এছাড়া আলিচান এলাকায় আরেকটি মসজিদ নিকটবর্তী গ্রামের লোকেরা ধ্বংস করেছে। বর্ডার পুলিশের নতুন ফাঁড়ি নির্মাণের জন্য মসজিদের জায়গাটি চিহ্নিত করা হয়েছে।
রাথেডংয়ে শতাব্দীপ্রাচীন একটি মসজিদ স্থানীয়রা সম্পূর্ণ গুঁড়িয়ে দিয়েছে বলে বাস্তুচ্যুত এক রোহিঙ্গা জানিয়েছেন। দি ইরাবতীর সরেজমিন অনুসন্ধানে বিষয়টির সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে। মংডুর দক্ষিণে উ দং ও মিন লুত এলাকায় অতিসম্প্রতি দুটি মসজিদ বুলডোজারের সাহায্যে ভাঙার কথা জানা গেছে।
মিয়ানমার সরকারের পুনর্বাসন প্রকল্পে নিযুক্ত এক বৌদ্ধ ত্রাণকর্মী পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে ইরাবতীকে জানিয়েছেন, দক্ষিণ মংডুর অবশিষ্ট মুসলিম গ্রামগুলো জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারির মধ্যে বুলডোজারের সাহায্যে সমান করে ফেলা হয়েছে।
এছাড়া মংডু ও তং পো লিতওয়ের মধ্যে মহাসড়কের পাশের মুসলিম গ্রামগুলোও ভেঙে দেয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে দুই-তৃতীয়াংশ মুসলিম গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে বলে তিনি জানান।
Posted ২:২৫ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta