কক্সবাংলা রিপোর্ট(৮ ডিসেম্বর) :: মিয়ানমারের রাখাইনে নৃশংসতম গণহত্যার বিচার নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যেই আজ পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক গণহত্যা প্রতিরোধ দিবস। বিভিন্ন দেশে গণহত্যার ঘটনা স্মরণ এবং এর বিরুদ্ধে সার্বজনীন সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্য নিয়ে ১৯৪৯ সালের ৯ ডিসেম্বর গণহত্যাবিরোধী জাতিসংঘ কনভেনশন গৃহীত হয়। ওই বছর থেকেই এ দিনটিকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে গণহত্যা প্রতিরোধ দিবসটির গুরুত্ব ব্যাপক। রাখাইনে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের জাতিগত নিধনযজ্ঞের শিকার হয়ে ১০ লাখের বেশি মানুষ কক্সবাজারের সীমান্ত এলাকা উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রয় নিয়েছে। এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার মতো নিরাপদ পরিবেশ হয়নি সেখানে।
জাতিসংঘের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে রাখাইনে গণহত্যা এবং জাতিগত নিধনযজ্ঞের বিষয়টি প্রমাণ হওয়ার পর বিশ্বজুড়েই এই গণহত্যার সঙ্গে জড়িতদের বিচারের দাবিও জোরালো হচ্ছে।
কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যারা বসবাস করছেন, তাদের এখনও তাড়া করে ফিরছে মিয়ানমার বাহিনীর বিভীষিকাময় নির্যাতনের স্মৃতি। তারাও বিচার চেয়েছেন গণহত্যার, সন্ধান চেয়েছেন এখনও নিখোঁজ শত-সহস্র স্বজনের।
এ বছর দিবসটি পালন উপলক্ষে এক বাণীতে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গণহত্যাবিরোধী জাতিসংঘ কনভেনশন অনুমোদন না করা দেশগুলোকে দ্রুত তা অনুমোদনের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি এই কনভেনশন প্রতিটি জাতি-গোষ্ঠীকে নিজেদের ভাষায় অনুবাদ করে ব্যাপকভাবে প্রচারের আহ্বান জানান।
তিনি আরও প্রত্যাশা করেন, অযৌক্তিক মুসলিম ও ইহুদি বিদ্বেষের গোঁড়ামি থেকে মুক্ত হয়ে, জাতিগত বিদ্বেষ এবং পরদেশি ভীতি কাটিয়ে সবার জন্য সমান মর্যাদা ও অধিকারের বিশ্ব প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে।
রোহিঙ্গাদের চোখে এখনও সেই বিভীষিকা :
উখিয়ার কুতুপালং ২ নম্বর ক্যাম্পের মসজিদ সংলগ্ন মাঠে দেখা হয় নূর হোসেন নামে এক শিশুর। মাত্র ১২/১৩ বছরের এই রোহিঙ্গা শিশু প্রত্যক্ষ করেছে তার জীবনে সবচেয়ে নিষ্ঠুর নির্মম ঘটনা। মা-বাবা, ভাইবোনসহ পরিবারের সাত সদস্যকে তার চোখের সামনে হত্যা করেছে মিয়ানমার সেনারা। নূর হোসেন কখনও কি ভুলতে পারবে ভয়ঙ্কর সেই দৃশ্য?
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী মোহছেনা বেগমের (২৮) পরিবারের ছয়জনকে গুলি করে মেরেছে। ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছেন তিনি। এই নারী এখন আশ্রয় নিয়েছেন উখিয়ার কুতুপালং ২ নম্বর ক্যাম্পে। স্বামী, ৩ ছেলে, এক মেয়েসহ পরিবারের ছয় সদস্যকে হারিয়ে এখনও নির্বাক মোহছেনা। তার দুই চোখে এখনও অশ্রুধারা। মিয়ানমার সেনারা মোহছেনার পরিবারের সঙ্গে হত্যা করেছে তার গ্রামের আরও দুই শতাধিক নিরীহ রোহিঙ্গাকে।
স্ত্রী সেতারা বেগম ও চার মেয়ের খবর জানেন না মংডুর জামবুনিয়াপাড়ার মাদ্রাসাশিক্ষক আবদুর রহিম। তারা কি বেঁচে আছেন, না মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নৃশংসতার শিকার হয়ে মারা গেছেন সে খবরও পাননি রহিম। তিনি এখন আশ্রয় নিয়েছেন বালুখালী ১১ নম্বর ক্যাম্পে।
কক্সবাজারে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার আবুল কালাম জানান, উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে নিবন্ধিত ৪০ হাজার এতিম শিশু রয়েছে। তাদের মধ্যে ৯ হাজার শিশুর মা-বাবা দু’জনই বেঁচে নেই। ধারণা করা হচ্ছে রাখাইনে তাদের হত্যা করা হয়েছে।
উখিয়ায় বালুখালী ক্যাম্পে কর্মরত আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা মেডিসিন সানস ফ্রন্টিয়ার্সের (এমএসএফ) এক কর্মকর্তা জানান, তার সংস্থার পক্ষ থেকে এক জরিপে দুই হাজার ৪৩৪ পরিবারের সন্ধান পাওয়া গেছে, যেসব পরিবারে এক বা একাধিক সদস্য নিহত হয়েছে।
ওই কর্মকর্তা বলেন, গত বছরের আগস্ট থেকে ডিসেম্বর রাখাইনে ১০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা হত্যার শিকার হয়েছেন। সেখানে পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে ৩৯২টি গ্রাম। লুট হয়ে গেছে রোহিঙ্গাদের সহায়-সম্পত্তি। ধর্ষিত হয়েছে তাদের অসংখ্য নারী ও শিশু।
রাখাইনে নিখোঁজ ১০ সহস্রাধিক রোহিঙ্গা :
আন্তর্জাতিক রেড ক্রসের তথ্যে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের রাখাইন থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা তাদের পরিবারের ১০ হাজার ৪৪৩ সদস্যের হদিস পাচ্ছে না। নিখোঁজ এই রোহিঙ্গাদের সন্ধান পেতে রেড ক্রসের সহায়তা চেয়েছে তাদের পরিবার। রেড ক্রসের কর্মকর্তা ওমর শরীফ এ তথ্য জানান।
ওই কর্মকর্তা বলেন, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের নিখোঁজ স্বজনের সন্ধান করা খুবই কঠিন কাজ। রোহিঙ্গারা তাদের নিখোঁজ স্বজনের সর্বশেষ অবস্থান সম্পর্কে যে ঠিকানা দিয়ে থাকেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেখানে এখন কেউ নেই। তার কথায় স্পষ্ট যে, তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে তা বলা কঠিন।
রাখাইনে অবরুদ্ধ রোহিঙ্গারা :
রাখাইনে যে অল্পসংখ্যক রোহিঙ্গা এখনও রয়ে গেছে, তারাও ভালো নেই। এক বছর ধরে তারা নিজ ভিটায় অবরুদ্ধ। সেনাবাহিনী অনেক রোহিঙ্গা পরিবারকে সরিয়ে নিয়েছে অস্থায়ী ক্যাম্পে। সেখানে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে এই রোহিঙ্গারা।
রোহিঙ্গারা জানিয়েছে, রাখাইনে কাজকর্ম করার কোনো অনুমতি নেই তাদের। বাড়িঘর থেকে বের হয়ে পাশের কোনো গ্রামে যেতে পারে না তারা। রেড ক্রসের দেওয়া ত্রাণে বেঁচে রয়েছে এই রোহিঙ্গারা।
রাখাইনে এখন কত রোহিঙ্গা আছে, তার সঠিক তথ্য আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থার কাছে নেই। তবে বিভিন্ন সূত্র জানায়, সেখানে এখন রোহিঙ্গাদের সংখ্যা এক লাখের কম। এক সময় রাখাইনে ১৫ লাখ রোহিঙ্গা ছিল। রোহিঙ্গাদের বেশিরভাগ গ্রাম জনশূন্য বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে।
কুতুপালং ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা নুর সিদ্দিক বলেন, রোহিঙ্গাদের ওপর যে গণহত্যা হয়েছে তার বিচার করতে হবে। তাদের ঘরবাড়ি ফেরত দিতে হবে; নাগরিক অধিকার দিতে হবে। স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার নিশ্চয়তা দিতে হবে।
Posted ৪:১০ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ০৯ ডিসেম্বর ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta