কক্সবাংলা ডটকম(২৭ মার্চ) :: সোভিয়েত-মার্কিন স্নায়ুযুদ্ধের পর সর্বোচ্চ সংখ্যক রুশ কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলো। যুক্তরাজ্যে এক সাবেক রুশ গুপ্তচর ও তার মেয়েকে সামরিক বাহিনীর ব্যবহৃত বিষাক্ত রাসায়নিক গ্যাস (নার্ভ এজেন্ট) প্রয়োগে হত্যাচেষ্টায় মস্কোর সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ১৩৯ রুশ কূটনীতিককে বহিষ্কার করে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ ২৪টি দেশ। মস্কোর বিরুদ্ধে ওয়াশিংটন ও ইউরোপীয় দেশগুলোর এই পদক্ষেপকে নাটকীয় ও আকস্মিক বলে মনে হতে পারে।
তবে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, রাশিয়াকে নিয়ে ট্রাম্পের ধোঁয়াশাপূর্ণ অবস্থান ও বন্ধুত্বপূর্ণ বাগাড়ম্বরের আড়ালে মার্কিন প্রশাসন সুদীর্ঘ পরিকল্পনা মাফিক রুশবিরোধী পদক্ষেপ নিয়েছে। এদিকে রুশ আধিপত্য নিয়ে ইউরোপীয় দেশগুলোর একাংশ ক্ষুব্ধ ছিল আগে থেকেই। অপর একটি অংশের রাশিয়ার সঙ্গে স্বার্থসংশ্লিষ্টতা থাকলেও রুশ গুপ্তচর ও তার মেয়ের হত্যা প্রচেষ্টায় মস্কোর সংশ্লিষ্টতার দাবি ইউরোপীয় দেশগুলোকে এক কাতারে নিয়ে আসে। এর ফলেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে রাশিয়ার বিরুদ্ধে সমন্বিত এই পদক্ষেপ সম্ভব হয়েছে।
গত ৪ মার্চ যুক্তরাজ্যের সালিসবুরির একটি পার্কের কাছ থেকে সাবেক রুশ গুপ্তচর সের্গেই স্ক্রিপাল ও তার মেয়ে ইউলিয়াকে অসুস্থ অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। ব্রিটিশ কতৃপক্ষ দাবি করে, স্নায়ু অকেজো করে দেয় এমন বিষাক্ত রাসায়নিক নার্ভ এজেন্ট দিয়ে হত্যার চেষ্টা হয়েছিল। এই ঘটনায় রাশিয়াকে দায়ী করে ১৪ মার্চ (বুধবার)২৩ রুশ কূটনীতিককে বহিষ্কারের ঘোষণা দেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে। পরে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রী সরাসরি রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনকে দায়ী করেন। ২৬ মার্চ (সোমবার)যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত ৬০জন কূটনীতিককে বহিষ্কার করে ট্রাম্প প্রশাসন। বন্ধ করে দেওয়া হয় সিয়াটলের রুশ কনস্যুলেট। এর ধারাবাহিকতায় জার্মানি, ফ্রান্সসহ ইউরোপীয় বিভিন্ন রাষ্ট্র শতাধিক রুশ কূটনীতিককে বহিষ্কারের ঘোষণা দেয়।
ট্রাম্পের বন্ধুত্বপূর্ণ বাগাড়ম্বরের আড়ালে দীর্ঘদিনের প্রস্তুতি
ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মস্কোর প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বন্ধুত্বপূর্ণ কথাবার্তা যখন সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম দখল করছিল তখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রতিরক্ষা দফতর পেন্টাগন ও হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে অনেকগুলো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। আফগানিস্তান থেকে উত্তর কোরিয়া থেকে সিরিয়া– বিশ্বজুড়ে রাশিয়াকে মোকাবিলায় এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
জানুয়ারিতে হোয়াইট হাউস ও পেন্টাগনের নীতিবিষয়ক চূড়ান্ত নথিতে রাশিয়াকে পুনরায় যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসা হয়। গত মাসে সিরিয়ায় মার্কিন সেনাবাহিনীর হামলায় রাশিয়া সংশ্লিষ্ট বেসরকারি সামরিক প্রতিষ্ঠানের হয়ে কর্মরত অন্তত ৩০০জন যোদ্ধা আহত বা নিহত হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও মার্কিন সমর্থিত যোদ্ধাদের ওপর হামলার পর এ পদক্ষেপ নেয় ট্রাম্প প্রশাসন। এছাড়া হোয়াইট হাউস পূর্ব ঘৌটা অঞ্চলে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর সিরিয়ার সরকারিবাহিনীর বিধ্বংসী হামলার সমালোচনা করে। মার্চের শুরুতেই মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পূর্ব ইউক্রেনে রাশিয়া সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষার জন্য ইউক্রেনকে ট্যাঙ্কবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র। ট্রাম্পের পূর্বসূরী সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা মস্কোর বিরুদ্ধে উসকানিমূলক পদক্ষেপ নেওয়া থেকে বিরত থাকতে ইউক্রেনকে অস্ত্র সহযোগিতা কমিয়ে দিয়েছিলেন। সোমবার ৬০ জন রুশ কূটনীতিককে বহিষ্কারের আগেই এসব ঘটনা ঘটেছে।
যেসব দেশ থেকে বহিষ্কার রুশ কূটনীতিকেরা
১. কানাডা: রাশিয়ার ৪ কূটনীতিককে বহিষ্কার ছাড়াও আরও ৩ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়।
২. ইউক্রেন: মস্কোর সঙ্গে শীতল সম্পর্কে থাকা দেশটি ১৩ রুশ কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে।
৩. জার্মানি: ৪ কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে।
৪. চেজ রিপাবলিক: রাশিয়ার ৩ কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে দেশটি।
৫. ফ্রান্স: ৪ কূটনীতিককে বহিষ্কারের আদেশ দিয়েছে।
৬. লিথুয়ানিয়া: ৩ কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে।
৭. পোল্যান্ড: ৪ কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে।
৮. স্পেন: ২ কূটনীতিককে বহিষ্কারের আদেশ দিয়েছে।
৯. নেদারল্যান্ড: ২ কূটনীতিককে বহিষ্কারের আদেশ দিয়েছে।
১০. ডেনমার্ক: ২ কূটনীতিককে বহিষ্কারের আদেশ দিয়েছে।
১১. ইতালি: ২ কূটনীতিককে বহিষ্কারের আদেশ দিয়েছে।
১২. লাটভিয়া: এক রুশ কূটনীতিককে বহিষ্কার করা ছাড়াও রাশিয়ার একটি প্রতিষ্ঠানকেও কালো তালিকাভুক্ত করেছে।
১৩. আলবেনিয়া: ২ কূটনীতিককে বহিষ্কারের আদেশ দিয়েছে।
১৪. হাঙ্গেরি, সুইডেন, ক্রোয়েশিয়া, রোমানিয়া, ফিনল্যান্ড এবং এস্তোনিয়া: প্রতিটি দেশ ১ জন করে রুশ কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে।
ট্রাম্পের অবস্থান নিয়ে এখনও ধোঁয়াশা
সোমবার রুশ কূটনীতিককে বহিষ্কারের ঘোষণায় ট্রাম্পের অবস্থান নিয়ে অস্পষ্টতার কথা জানিয়েছে ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স। খবরে বলা হয়েছে, ট্রাম্প নিজেই এমন কঠোর অবস্থানের পক্ষে ছিলেন নাকি উপদেষ্টা ও জেনারেলদের পরামর্শে সম্মতি দিয়েছেন তা স্পষ্ট নয়। ট্রাম্পের সমালোচকরা তাকে রাশিয়াবিরোধী কঠোর মনোভাব গ্রহণের ক্ষেত্রে অনাগ্রহী হিসেবে আখ্যায়িত করতে চান। যদিও প্রশাসনের এক সিনিয়র কর্মকর্তা জানিয়েছেন, রুশ কূটনীতিকদের বহিষ্কারের সিদ্ধান্তে ট্রাম্প একেবারে শুরু থেকেই জড়িত ছিলেন। মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের আর্মড সার্ভিসেস কমিটির শীর্ষ ডেমোক্র্যাট নেতা অ্যাডাম স্মিথ বলেন, ‘তিনি (ট্রাম্প) যেভাবে অনিচ্ছাকৃত সিদ্ধান্তটিতে পৌঁছেছেন, তা বিরক্তিকর।’ যদিও রাশিয়া ও দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সম্পর্কে ট্রাম্পের কোমল অবস্থানের বিপরীতে এটি একটি বড় পদক্ষেপ।
২০১৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়া হস্তক্ষেপের অভিযোগ তদন্ত চলমান থাকার পরও ট্রাম্প মস্কোর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক জারি রাখার দাবি করে আসছিলেন দীর্ঘদিন ধরেই। ২০ মার্চ পুতিন পুনরায় নির্বাচিত হওয়ায় অভিনন্দন জানিয়েছেন ট্রাম্প। এতে ক্ষুব্ধ হয়েছেন ক্ষমতাসীন রিপাবলিক দলের নেতারাও। কিন্তু এর মাত্র দুইদিন পর ট্রাম্প কঠোর রাশিয়াবিরোধী জন বোল্টনকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগের ঘোষণা দিয়েছেন। এদিকে বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুতে ট্রাম্পকে টুইটারে মন্তব্য করতে দেখা গেলেও গুপ্তচর হত্যা প্রচেষ্টায় রুশ সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তিনি নীরব ভূমিকা পালন করেন।
বিচ্ছিন্ন নয়, রাশিয়াবিরোধী সামগ্রিক পদক্ষেপ
নার্ভ এজেন্ট হামলা রুশ কূটনীতিক বহিষ্কারের প্রধান কারণ হিসেবে সামনে এসেছে। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তারা সতর্ক করেছেন, এই হামলাকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখা ঠিক হবে না। তারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মস্কোর আগ্রাসনমূলক পদক্ষেপের কথা সামনে আনছেন। আফগানিস্তানে দায়িত্বরত মার্কিন সেনাবাহিনীর শীর্ষ কমান্ডার গত সপ্তাহেই অভিযোগ তুলেছেন, রাশিয়া তালেবান জঙ্গিদের অস্ত্র সরবরাহ করছে। ট্রাম্প নিজেই জানুয়ারিতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা এড়াতে উত্তর কোরিয়াকে সহযোগিতার অভিযোগ তোলেন। মাত্র দুই সপ্তাহ আগে নির্বাচনে হস্তক্ষেপ ও সাইবার হামলার জন্য রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করে ওয়াশিংটন। যদিও এতে পুতিনের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের শাস্তি দেওয়া হয়নি।
ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রাশিয়ার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক একেবারে বাদ দিতে চায় না যুক্তরাষ্ট্র। এক কর্মকর্তা জানান, ইরান ও উত্তর কোরিয়া ইস্যুতে এখনও রাশিয়ার সহযোগিতা চাওয়া হবে।
ইউরোপ যেভাবে ঐক্যবদ্ধ হলো
দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন খুব একটা আদর্শ নয়। কিন্তু সোমবার রুশ কূটনীতিকদের একযোগে বহিষ্কারের সিদ্ধান্তটি ছিল নাটকীয় এবং ইঙ্গিতপূর্ণ। এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমন্বিতভাবে রাশিয়া ও দেশটির প্রেসিডেন্ট পুতিনের যে কোনও আগ্রাসী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে কঠোর ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ইঙ্গিত স্পষ্ট হয়েছে। ইইউ’র জন্য রাশিয়া সব সময় জটিল ইস্যু। মহাদেশটির জ্বালানি সরবরাহে রাশিয়ার ভূমিকার কারণেই এই জটিলতা। এছাড়া রাশিয়াকে মোকাবিলায় বিভিন্ন দেশের নেতাদের মতের পার্থক্য রয়েছে। কেউ কেউ আবার পুতিনকে বিরক্ত করতে চান না। কিন্তু ৪ মার্চ যুক্তরাজ্যের মাটিতে নার্ভ এজেন্ট হামলা সব সীমা অতিক্রম করেছে বলে মনে করছেন ইউরোপীয় নেতারা। হামলাটির ধরনের কারণে ইইউ কর্মকর্তাদের এটিকে অবজ্ঞা করার সুযোগ ছিল না।
ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের কথা তুলে ধরে এক সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, ক্রিমিয়া ও ইউক্রেনে রাশিয়া আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে চলেছে। এমনকি হস্তক্ষেপ না করার অলিখিত আন্তর্জাতিক আইনও মানছে না মস্কো। আর এখন ব্রিটেনে নার্ভ এজেন্ট হামলা চালিয়েছে। ইউরোপীয় চার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউ ইয়র্ক টাইমসকে জানান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কারণে সংস্থাটিতে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে খুব একটা জনপ্রিয় নন। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার (২২ মার্চ) রাতে পরিস্থিতি ছিল উল্টো। ওই রাতে ইউরোপীয় নেতারা বিলাসবহুল নতুন সদর দফতরে নৈশভোজে মিলিত হয়েছিলেন পুরো আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে রাশিয়া। সেখানে থেরেসা মে যুক্তরাজ্যের মাটিতে রাশিয়ার নার্ভ এজেন্ট হামলার বিস্তারিত তথ্য জানান এবং সহযোগিতা ও কঠোর পদক্ষেপের আহ্বান জানান। পরদিন সকালে ইউরোপীয় নেতারা একমত হন সমন্বিত পদক্ষেপের অপরিহার্যতহার প্রশ্নে প্রয়োজন। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বলেন, সবার দেশে ফিরে যাওয়া এবং রুশ কূটনীতিকদের বহিষ্কারের বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, “ম্যাক্রোঁ অন্যদের বলেন, ‘চলুন সোমবার দুপুর ৩টায় ঘোষণা করি’।”
নৈশভোজের আগেই থেরেসা মে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ও জার্মান চ্যান্সেলরকে এই বিষয়ে অবহিত করে সহযোগিতা চেয়েছিলেন। সেখানেই নৈশভোজে সবার সহযোগিতা চাওয়ার কৌশল নেওয়া হয়েছে। জার্মানি ও ফ্রান্স প্রকাশ্যে রাজি হওয়াতে অন্য দেশগুলোকে অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও রাজি হতে হয়েছে। সোমবার সকালেই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়ে যায়। ইউরোপীয় রাষ্ট্রদূতরা ব্রাসেলসে মিলিত হন। সেখানে প্রতিটি দেশের করণীয় তুলে ধরা হয়। ইউরোপিয়ান কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাস্কের জন্য একটি বিবৃতি প্রস্তুত করা হয়। ফলাফল ছিল বিস্ময়কর। ইইউভুক্ত ১৬টি দেশ ন্যুনতম একজন রুশ কূটনীতিককে বহিষ্কার করতে সম্মত হয়। আয়ারল্যান্ডের মতো দেশও এতে শামিল হওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করে।
ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্র সমন্বিত পদক্ষেপে ট্রাম্প প্রশাসনের ভূমিকা
ইইউ দেশগুলোর সমন্বিত পদক্ষেপের পক্ষে কাজ করে ট্রাম্প প্রশাসনও। মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ হোয়াইট হাউসের দুই কর্মকর্তার বরাত দিয়ে জানিয়েছিল, রাশিয়ার বিরুদ্ধে একই ধরনের পদক্ষেপ নিতে ইউরোপীয় মিত্ররাও যেনও এগিয়ে আসে তা নিশ্চিত করতে চাইছেন ট্রাম্প। এজন্য গত এক সপ্তাহ ধরে মার্কিন কর্মকর্তারা ইউরোপিয়ানদের সঙ্গে নিয়ে একটি সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে কাজ করছেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কঠোর পদক্ষেপ ও সহযোগিতা চাওয়ার পরই এই কাজে হাত দেওয়া হয়। মস্কোতে দায়িত্ব পালন করা সাবেক ব্রিটিশ কূটনীতিক ইয়ান বন্ড বলেন, কূটনীতিক বহিষ্কারের ক্ষেত্রে এর আগে এতো দেশকে সমন্বিতভাবে ঘোষণা করতে দেখিনি। শীতল যুদ্ধের পর এই প্রথম এসব দেশ ন্যুনতম একজন রুশ কূটনীতিককে বহিষ্কার করল।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের কূটনৈতিক সম্পাদক প্যাট্রিক উইন্টোর লিখেছেন, গুপ্তচর হত্যাচেষ্টার আগেই রাশিয়ার আগ্রাসী কর্মকাণ্ডে ইউরোপের ধৈয্যের বাধ ভেঙে গিয়েছিল। অনেক দেশই ক্ষুব্ধ ছিল রাশিয়ার ভূমিকায়। সোমবার যেসব দেশ রুশ কূটনীতিকদের বহিষ্কার করেছে তাদের নাগরিককে হয়ত বিষ দিয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়নি। কিন্তু তাদের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ, সাইবার নেটওয়ার্কে হামলা, দিনের পর দিন সিরিয়ায় রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার নিয়ে জাতিসংঘে তাদের নিন্দা প্রস্তাব আটকে দিয়েছে রাশিয়া ভেটো প্রয়োগ করে।
যুক্তরাজ্যের যুক্তি
টেরেসা মে ২৩ রুশ কূটনীতিককে বহিষ্কারের সময় বলেছিলেন, এই ২৩ জনকে রাশিয়ার ‘অঘোষিত গোয়েন্দা কর্মকর্তা’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সোজা ভাষায় বললে, এরা হলেন রাশিয়ার গুপ্তচর, যারা ‘সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা’ পরিচয়ে রুশ কূটনীতিক হিসেবে যুক্তরাজ্যে ঘোরাফেরা করছেন এবং যুক্তরাজ্যের বিরুদ্ধে গোপন তথ্য সংগ্রহ করছেন।
সাবেক রুশ গুপ্তচর সের্গেই স্ক্রিপাল ডাবল এজেন্ট হিসেবে ক্রেমলিনের খবর ব্রিটিশ সরকারকে সরবরাহ করতেন। এ কারণেই তাকে হত্যা চেষ্টায় আঙ্গুল রাশিয়ার দিকেই উঠল।
এর প্রতিক্রিয়ায় ব্রিটেনে কূটনীতিক বহিষ্কারের অর্থ হলো অভিজ্ঞ গুপ্তচরদের একটি বিশাল দলের কর্মকাণ্ড আটকে দেয়া, যেন তারা যুক্তরাজ্যের কোনো গোপন ও সম্ভাব্য স্পর্শকাতর তথ্য রাশিয়ায় পাচার করতে না পারে। অদূর ভবিষ্যতেও যেন এভাবে অঘোষিত কূটনীতিক রাশিয়া নিতে না পারে সেটাও এই পদক্ষেপের অন্যতম উদ্দেশ্য।
টেরেসার ভাষণে মূলত রাশিয়ার যুক্তরাজ্যবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার অঙ্গীকার করা হয়েছে। অর্থাৎ যুক্তরাজ্যের মাটিতে থেকে যুক্তরাজ্যের বিরুদ্ধে কাউকে কিছু করতে দেয়া হবে না। তবে বৈধভাবে ব্যবসাসহ বিভিন্ন কাজে রাশিয়ার নাগরিকরা অবশ্যই সেখানে থাকতে পারবেন এবং আসা-যাওয়া করতে পারবেন। এদেরকে আপাতত আশঙ্কার আওতায় আনছে না ব্রিটিশ সরকার।
রুশ কূটনীতিকদের বহিষ্কার প্রক্রিয়ায় মোটামুটি যুক্তরাজ্যের পদ্ধতিই মেনে চলছে বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে।
কী করবে রাশিয়া
এখন দেখার বিষয় রাশিয়া এর জবাবে কী করে। ইতোমধ্যে যুক্তরাজ্যে কূটনীতিক বহিষ্কারের ঘটনায় ২৩ ব্রিটিশ কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে দেশটি। আর সোমবারের ঘোষণাকে ‘উস্কানিমূলক আচরণ’ উল্লেখ করে এর জবাব দেয়ার অঙ্গীকারও করেছে দেশটি।
তবে ভবিষ্যতে আরও কঠোর বহিষ্কারের পদক্ষেপ নেয়া হতে পারে – কথাটি বলে পুতিনকে স্পষ্টভাবে সাবধানই করলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প, যেন রাশিয়া তার জবাব ঠিক করার আগে পরিণতি হিসেবে ভালোভাবে ভেবে নেয়।
রাশিয়ায় ফুটবল বিশ্বকাপ বয়কট করতে পারে অস্ট্রেলিয়া
যুক্তরাজ্যের মাটিতে নার্ভ এজেন্ট হামলা চালানোর জের ধরে রাশিয়ায় অনুষ্ঠিতব্য ২০১৮ সালের ফুটবল বিশ্বকাপ বয়কট করতে পারে অস্ট্রেলিয়া। এই ঘটনায় মিত্র রাষ্ট্র যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে অস্ট্রেলিয়াও দুই রুশ কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স মঙ্গলবার এখবর জানিয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলি বিশপ জানিয়েছেন, রুশ কূটনীতিকদের বহিষ্কারের পাশাপাশি আরও পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে। এর মধ্যে থাকতে পারে রাশিয়ায় অনুষ্ঠিতব্য ২০১৮ সালের ফুটবলি বিশ্বকাপ বয়কট করা।
জুলি বিশপ বলেন, আরও ব্যাপক আকারে পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে। বিশ্বকাপ বয়কট এসব পদক্ষেপের একটি হতে পারে।
তবে অস্ট্রেলিয়ার ফুটবল নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপের প্রস্তুতি পরিকল্পনা মতোই এগিয়ে যাচ্ছে। ফুটবল ফেডারেশন অস্ট্রেলিয়া এক ইমেইল বিবৃতিতে জানায়, ইংল্যান্ডসহ বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করা সবগুলো ফিফার টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করবে। আমাদের লক্ষ্যও তাই।
যুক্তরাজ্যে এক সাবেক রুশ গুপ্তচর ও তার মেয়েকে সামরিক বাহিনীর ব্যবহৃত বিষাক্ত রাসায়নিক গ্যাস (নার্ভ এজেন্ট) প্রয়োগে হত্যাচেষ্টায় মস্কোর সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ১৩৯ রুশ কূটনীতিককে বহিষ্কার করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়াসহ ২৪টি দেশ।