কক্সবাংলা ডটকম(১৫ মে) :: বিত্তশালী পিতার সন্তান সাফাত আহমেদ। টাকা খরচ করেন দু’হাতে। চড়েন নামিদামি ব্র্যান্ডের গাড়িতে। সার্বক্ষণিক সশস্ত্র দেহরক্ষীবেষ্টিত সাফাত যখন যা চেয়েছেন তাই পেয়েছেন। ভালো লাগার অনেককেই তিনি বাহুবন্দি করেছেন। এ তালিকায় হাইপ্রোফাইল বান্ধবীদের কেউ বাদ যাননি। ঘনিষ্ঠ কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে প্রায় প্রতি রাতেই তিনি রুম পার্টিতে মেতে থাকতেন। সাফাতের বন্ধুদের তালিকায় দেশের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, রাজনৈতিক নেতা, সংসদ সদস্য এবং উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তার সন্তানও রয়েছেন।
বনানীর হোটেল রেইনট্রিতে দুই তরুণী ধর্ষণের ঘটনায় রিমান্ডে থাকা সাফাত আহমেদ এভাবে মুখ খুলছেন। তবে তার বন্ধুদের নাম শুনে হতবাক গোয়েন্দারা। এমনকি কয়েকজনের নাম শুনে কিছুটা বিব্রতবোধ করছেন তারা।
এছাড়া গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে তার বাবা আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের সোনা চোরাচালানের নানা চাঞ্চল্যকর তথ্যও দিচ্ছেন তিনি।
তবে সাফাত আহমেদ ও সাদমান সাকিফের কাছ থেকে যেসব তথ্য মিলছে তা নিয়ে শেষ পর্যন্ত কতদূর এগোতে পারবেন সেটি নিয়েও সংশয়ে আছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের কেউ কেউ।
এদিকে সূত্র বলছে, ধর্ষণের মামলায় প্রাথমিকভাবে যেসব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তাতে রেইনট্রি হোটেলের মালিকপক্ষও দায় এড়াতে পারছে না। এই অপরাধের সহযোগী হিসেবে তাদের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।
বিষয়টি আঁচ করতে পেরে অজ্ঞাত স্থানে চলে গেছেন বনানীর রেইনট্রি হোটেলের মালিক ঝালকাঠি-১ আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য বিএইচ হারুনের চার ছেলে। শনিবার থেকে তাদের মোবাইল ফোনও বন্ধ রয়েছে।
দুই তরুণী ধর্ষণ মামলার তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা রোববার বলেন, রিমান্ডের দ্বিতীয় দিনে জিজ্ঞাসাবাদে সাফাত আহমেদ চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্য দিয়েছেন।
তিনি গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের জানান, এ ধরনের পার্টি তাদের প্রথম নয়। আর এসব পার্টিতে কী হয় তা জেনেশুনেই তাদের বান্ধবীরা উপস্থিত থাকতেন।
কিন্তু রেইনট্রি হোটেলের ঘটনায় কেন তারা (দুই তরুণী) অভিযোগ করল সে বিষয়টি তিনি নাকি বুঝতে পারছেন না (!) তবে এ ঘটনার জন্য নাঈম আশরাফের (আবদুল হালিম) বাড়াবাড়িকে বেশি দায়ী করেন সাফাত।
এছাড়া জিজ্ঞাসাবাদে ঘটনার রাতে দুই তরুণীর সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়টি সাফাত অনেকটা স্বাভাবিক বিষয়ের মতো স্বীকার করেন। বরং সেটিকে কেন ধর্ষণ বলা হচ্ছে তা নিয়ে রীতিমতো তিনি গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের পাল্টা প্রশ্ন করছেন।
জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে ঘটনার সরল স্বীকারোক্তি দিতে গিয়ে সাফাত আহমেদ বলেন, গুলশান-বনানী ছাড়াও রাজধানীর বিভিন্ন তারকা হোটেল কিংবা অভিজাত গেস্ট হাউসগুলোর কোনো না কোনোটিতে তারা রাত কাটিয়ে থাকেন।
নির্ধারিত হোটেলগুলোতে তাদের জন্য বিশেষ রুম কিংবা ভিআইপি স্যুট বুক করা থাকে। জন্মদিন ছাড়াও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের কথা বলে তারা রুমপার্টির আয়োজন করেন।
নামিদামি ব্র্যান্ডের বিদেশি মদ ছাড়াও ইয়াবা ও সিসার ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন থাকে তাদের এসব নিশুতি পার্টি। এছাড়া এসব পার্টিতে তারা প্রকাশ্যে পছন্দের বান্ধবীদের বেছে নেন।
সাফাত গোয়েন্দাদের জানান, মূলত নাঈম আশরাফের মাধ্যমেই তিনি মডেলসহ সুন্দরী তরুণীদের সংগ্রহ করতেন। পার্টি চলত গভীর রাত পর্যন্ত। কখনও কখনও ভোরের আলোয় ভাঙত তাদের মিলনমেলা।
প্রথম সারির সুন্দরী মডেল-আইটেম গার্লরা ছাড়াও মাঝে মধ্যে এ সারির বিদেশি অতিথিদের আনা হয় এসব জলসায়।
গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে সাফাত বলেন, ২০১৫ সালে একটি অনুষ্ঠানে নাঈম আশারেফর সঙ্গে তার পরিচয় হলেও ২০১৬ সালের মার্চ মাস থেকে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। এক পর্যায়ে নাঈম আশারফ (আবদুল হালিম) তার বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে যায়। এমনকি তার বাবা আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদও তাকে (নাঈম আশরাফ) খুব পছন্দ করতেন। গুলশান ও বনানীর কয়েকটি রেস্টুরেন্টে ছিল তাদের নিয়মিত আড্ডা।
বনানীর সেরিনা, সুইট ড্রিমসহ ১১ নম্বর সড়কের একটি রেস্টুরেন্টে সন্ধ্যার পর বসত তাদের নিয়মিত গাঁজা ও ইয়াবার আড্ডা। এসব রেস্টুরেন্টে মদের বার না থাকলেও সবই থাকত সেখানে।
প্রসঙ্গত, ২৮ মার্চ বন্ধুর সঙ্গে জন্মদিনের অনুষ্ঠানে গিয়ে বনানীর ‘দ্য রেইনট্রি’ হোটেলে ধর্ষণের শিকার হন বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া দুই তরুণী।
এ ঘটনায় ৬ মে রাজধানীর বনানী থানায় আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের ছেলে সাফাত আহমেদ, ছেলের বন্ধু নাঈম আশরাফ (সিরাজগঞ্জের আবদুল হালিম) ও সাদমান সাকিফসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন দুই ভিকটিম।
মামলার অপর আসামি পলাতক মোহাম্মদ হালিম ওরফে নাঈম আশরাফ, ড্রাইভার বেলাল ও দেহরক্ষী আবুল কালাম আজাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
এছাড়া এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রোববার তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা রেইনট্রি হোটেলের অপারেশন ইন্টারন্যাল এক্সিকিউটিভ ফারজান আরা রিমিসহ চার কর্মচারীকে তাদের হেফাজতে নিয়েছেন।
আপন জুয়েলার্সের ৮৫ কোটি টাকার স্বর্ণ ও হীরা আটক
আপন জুয়েলার্সআপন জুয়েলার্সের পাঁচটি শাখায় অভিযান চালিয়ে মোট ৮৫ কোটি টাকার স্বর্ণ ও হীরা আটক করেছে শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ। রবিবার (১৪ মে) সকালে অভিযান চালিয়ে এই বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ ও হীরা আটক করা হয়। শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ‘ডার্টি মানি’ বা কালো টাকার উৎস অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে রাজধানীতে আপন জুয়েলার্সের ডিসিসি, গুলশান, উত্তরা, মৌচাক ও সীমান্ত স্কয়ারেরর শাখায় এ অভিযান চালানো হয়। অভিযানের সময় তাৎক্ষণিকভাবে বৈধ কাগজপত্র দেখাতে ব্যর্থ হওয়ায় সাময়িকভাবে স্বর্ণ ও হীরা আটক করা হয়েছে। পরবর্তীতে বৈধ কাগজপত্র দেখাতে না পারলে আটক করা স্বর্ণ ও হীরা জব্ধ করা হতে পারে। এছাড়া আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানানো হয়, বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদ সেলিম ও তার ছেলে শাফাত আহমেদের বিরুদ্ধে চোরাচালানে সম্পৃক্ত থাকার বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ধারণা করা হচ্ছে তারা অবৈধ ব্যবসার আড়ালে ‘ডার্টি মানি’ অর্জন করেছেন। সম্প্রতি রাজধানীতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই তরুণীকে ধর্ষণের ঘটনায় এই ডার্টি মানির যোগসূত্র রয়েছে বলে মনে করে শুল্ক গোয়েন্দা। গত ১১ এপ্রিল আপন জুয়েলার্স ও মালিকদের যাবতীয় আর্থিক লেনদেনের তথ্যা চেয়ে বিএফআইইউ, বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি পাঠায় শুল্ক গোয়েন্দা।
শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ আপন জুয়েলার্সের সব অনিয়ম খতিয়ে দেখছে উল্লেখ করে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, রবিবার সকাল থেকে আপন জুয়েলার্সের ডিসিসি মার্কেট শাখা, সীমান্ত স্কোয়ার শাখা, উত্তরা শাখা, মৌচাক শাখা, এবং গুলশান এভিনিউ শাখায় অভিযান চালানো হয়। তবে গুলশান এভিনিউ শাখা বন্ধ থাকায় এটি সিলগালা করা হয়, যা পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে ইনভেন্ট্রি করা হবে।
অভিযানে চারটি শাখা থেকে ২৮৬ কেজি স্বর্ণালঙ্কার ও ৬১ গ্রাম ডায়মন্ড আটক করা হয়েছে। বর্তমান এসব অলঙ্কারের বাজার মূল্য ৮৫ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। যার মধ্যে মৌচাক শাখা থেকে প্রায় ঊনিশ কোটি ১২ লাখ টাকার স্বর্ণালঙ্কার ও প্রায় দুই কোটি ৩৮ লাখ টাকার ডায়মন্ড, সীমান্ত স্কোয়ার শাখা থেকে প্রায় ৩২ কোটি ১৪ লাখ টাকার স্বর্ণালঙ্কার ও প্রায় এক কোটি ৪৩ লাখ টাকার ডায়মন্ড, উত্তরা শাখা থেকে প্রায় ৩২ কোটি ২৬ লাখ স্বর্ণালঙ্কার ও এক কোটি ৩৩ লাখ টাকার ডায়মন্ড এবং ডিসিসি মার্কেট শাখা থেকে ২৫ কোটি ৭৪ লাখ টাকার স্বর্ণালঙ্কার আটক করা হয়।
উল্লেখ্য, অভিযানে স্বর্ণ ও ডায়মন্ডের বৈধ উৎস ও পরিশোধযোগ্য শুল্ককরাদি সম্পর্কে খোঁজ নেওয়া হয়। প্রাথমিক অনুসন্ধানে আপন জুয়েলার্সের এ সকল শাখা থেকে দেখানো কাগজপত্র অভিযান পরিচালনাকারী দলের কাছে অপর্যাপ্ত ধরা পরে। তাছাড়া উপস্থাপিত দলিলাদিতে উল্লিখিত স্বর্ণ ও ডায়মন্ডের পরিমাণের সঙ্গে ইনভেন্ট্রিকৃত স্বর্ণ ও ডায়মন্ডের পরিমাণের গরমিল পাওয়া যায়।
রবিবারের এই অভিযানে নেতৃত্ব দেন শুল্ক গোয়েন্দার যুগ্ম পরিচাল মো. সফিউর রহমান। এছাড়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অনুমতি নিয়ে সার্বিক নির্দেশনা দিয়েছেন শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান।