কক্সবাংলা ডটকম(১৪ ডিসেম্বর) :: জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব জেফরি ফেল্টম্যান বলেছেন, মিয়ানমারকে অবশ্যই রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদান ও পুনর্বাসন করতে হবে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি এ পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হতে হবে এবং এজন্য সবার আগে রাখাইনবিষয়ক পরামর্শক কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হবে। নিরাপত্তা পরিষদে ব্রিফিংয়ে অংশ নিতে গিয়ে ফেল্টম্যান মঙ্গলবার এসব কথা বলেন।
এ সময় তিনি রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে পাঁচ দফা সুপারিশ তুলে ধরেন। একই ব্রিফিংয়ে মহাসচিবের বিশেষ দূত প্রমিলা প্যাটেন রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতা অবিলম্বে বন্ধে মিয়ানমারের উদ্দেশে নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব পাসের আহ্বান জানান।
নিরাপত্তা পরিষদ মঙ্গলবার মিয়ানমার ইস্যুতে বিশেষ বৈঠকে মিলিত হয়। গত ৬ নভেম্বর পরিষদের সভায় পাসকৃত প্রস্তাবের ধারাবাহিকতায় এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ৬ নভেম্বরের সভায় মিয়ানমারের প্রতি রাখাইন প্রদেশে সামরিক অভিযান বন্ধের আহ্বান জানিয়ে ওই প্রস্তাব পাস করা হয়। একই সঙ্গে প্রস্তাব পাসের এক মাস পর রোহিঙ্গাদের হালনাগাদ পরিস্থিতি নিরাপত্তা পরিষদকে অবহিত করতে বলা হয় জাতিসংঘ মহাসচিবকে।
ব্রিফিংয়ে অংশ নিয়ে জাতিসংঘের রাজনৈতিকবিষয়ক সহকারী মহাসচিব জেফরি ফেল্টম্যান বলেন, মিয়ানমারকে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যকার উত্তেজনা নিরসন করে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও সম্মানজনক প্রত্যাবর্তনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এজন্য মিয়ানমার জাতিসংঘের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে পারে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ায় জেফরি ফেল্টম্যান বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের প্রতি জাতিসংঘের পক্ষে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। একই সঙ্গে তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি এসব প্রয়াসে সমর্থন অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, সহিংসতা কমলেও রাখাইনে এখনো রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি-গ্রাম পোড়ানো হচ্ছে। স্যাটেলাইটে নেয়া ছবিতে এসব দৃশ্য ধরা পড়ছে। বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ঢলও পুরোপুরি থামেনি। রেড ক্রস ও ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামকে রাখাইনের কয়েকটি জায়গায় যেতে দিলেও মিয়ানমার সরকার এখনো জাতিসংঘ সংস্থাগুলোর সেখানে প্রবেশে বাধা দিচ্ছে বলে তিনি জানান।
জাতিসংঘের শীর্ষ রাজনৈতিক কর্মকর্তা জেফরি ফেল্টম্যান রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে পাঁচটি সুপারিশ উপস্থাপন করেন। এর মধ্যে রয়েছে— রাখাইন বিষয়ে কফি আনান কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের শান্তিপূর্ণ ও স্থায়ীভাবে প্রত্যাবাসন সম্পন্ন করা; বাস্তুচ্যুতদের নিজ ভিটেমাটি অথবা তার কাছে পুনর্বাসন; তাদের অবাধ চলাচলের অধিকার প্রদান; প্রত্যাবাসনের শর্ত হিসেবে মিয়ানমার যে নাগরিকত্বের প্রমাণের কথা বলেছে তা উদারভিত্তিক করা এবং পুরো প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো।
নিরাপত্তা পরিষদের এই ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সম্পাদিত দ্বিপক্ষীয় চুক্তির বিষয়টি উল্লেখ করে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন নিরাপত্তা পরিষদকে জানান, চুক্তির শর্তানুযায়ী শিগগিরই জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠিত হবে এবং মিয়ানমারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করা সম্ভব হবে।
তবে তিনি উল্লেখ করেন, এ দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে কেবল প্রত্যাবাসনের কাজটি করা সম্ভব হতে পারে, কিন্তু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানবিক দুর্দশার যে মূল কারণ, তা দূর করতে এতদসংশ্লিষ্ট বহুবিধ বিষয় ও অমীমাংসিত প্রশ্নগুলো মিয়ানমারকেই সমাধান করতে হবে এবং এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অব্যাহত সহযোগিতা ও পর্যবেক্ষণ একান্তভাবে প্রয়োজন।
ব্রিফিংয়ে অংশ নিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত প্রমিলা প্যাটেন বলেন, মিয়ানমারের সৈন্যরা রোহিঙ্গা নারীদের ওপর ভয়াবহ যৌন নিপীড়ন চালিয়েছে। কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবিরে আমি ভুক্তভোগীদের কাছে এসব বর্বরতার হূদয়বিদারক বর্ণনা শুনেছি।
মরিশাসের কূটনীতিক প্রমিলা প্যাটেন সংঘাতকালীন যৌন সহিংসতা বিষয়ে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূতের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বলেন, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, নির্যাতন এবং শিশু হত্যার মাধ্যমে মিয়ানমার বাহিনী যৌন সহিংসতা চালিয়েছে। বাংলাদেশে তিনদিন অবস্থানকালে আমি যেসব নারীর সঙ্গে কথা বলেছি, তাদের প্রত্যেকেই নিপীড়ন সহ্য করেছে অথবা প্রত্যক্ষ করেছে।
প্রমিলা প্যাটেন রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের সহিংসতা বন্ধে অবিলম্বে মিয়ানমার বিষয়ে প্রস্তাব পাসের জন্য নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, জাতিগত নির্মূল অভিযানের অংশ হিসেবে মিয়ানমার বাহিনী ধর্ষণ-নির্যাতন চালিয়েছে। জাতিগত নির্মূলের এ অভিযানের লক্ষ্য পূরণ হতে দেয়া যাবে না।
মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত হাও দো সুয়ান বলেন, কথিত যৌন সহিংসতার অভিযোগের বিষয়ে মিয়ানমার সরকার জোরালো প্রমাণ পেলে অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। গত মাসে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এক তদন্ত প্রতিবেদনে সৈন্যদের হাতে হত্যা ও ধর্ষণের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে তিনি জানান।
এ বিষয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিকি হ্যালি বলেন, এটা গ্রহণযোগ্য না। বার্মায় অবশ্যই যা ঘটেছে তার স্বাধীন, স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের সুযোগ দিতে হবে। তিনি বলেন, আমরা বার্মা সরকারের অনেক প্রতিশ্রুতি শুনছি। কিন্তু এবার তাদের কাজ দেখতে চাই।
চীনের উপরাষ্ট্রদূত উ হাইতাও বৈঠকে বলেন, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যকার চুক্তির মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধান করতে হবে। বাইরে থেকে চাপ প্রয়োগ করে কোনো সমাধান করা হলে তাতে সাময়িকভাবে পরিস্থিতির উন্নতি হলেও পরবর্তীতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে তিনি সতর্ক করেন।
বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ব্রিটেনের রাষ্ট্রদূত জোনাথন অ্যালেন বলেন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের চুক্তি হলেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, নিরাপত্তা পরিষদকে এই ইস্যুতে লেগে থাকতে হবে এবং আমাদের এ ইস্যুতে টানা দৃষ্টি রাখতে হবে। তিনি ইউএনএইচসিআরের মাধ্যমে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় স্বতন্ত্র নজরদারির আহ্বান জানান।
Posted ১:২২ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta