কক্সবাংলা ডটকম(৩০ জুলাই) :: শ্রীলংকার দক্ষিণাঞ্চলীয় হাম্বানটোটা গভীর সমুদ্রবন্দর অধিগ্রহণ করছে চীন। এ বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে গতকাল একটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান চায়না মার্চেন্ট পোর্ট হোল্ডিংস (সিএমপোর্ট) ১১২ কোটি ডলারে ৯৯ বছরের জন্য বন্দরটি ইজারা নিতে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। সিএমপোর্ট আগে থেকে কলম্বো গভীর সমুদ্রবন্দর পরিচালনা করছে। কৌশলগত বিচারে গুরুত্বপূর্ণ হাম্বানটোটা বন্দর অধিগ্রহণের সুবাদে শ্রীলংকার দুটি গভীর সমুদ্রবন্দরে চীনা কোম্পানিটির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হলো।
শ্রীলংকার প্রতিবেশী ভারতের এ বিষয়ে অস্বস্তি রয়েছে বলে সংবাদ মাধ্যমে জানা গেছে। খবর এএফপি ও আল জাজিরা।
শ্রীলংকার বন্দর ও নৌ-বিষয়ক মন্ত্রী মাহিন্দা সামারাসিংহে ও কলম্বোয় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত য়ি জিয়ানলিং নিজ নিজ দেশের পক্ষে চুক্তি স্বাক্ষর করেন। কলম্বোয় বন্দর ও নৌ-বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে চুক্তি স্বাক্ষরের পর মাহিন্দা সামারাসিংহে বলেন, চলতি সপ্তাহে কয়েকটি দেশ হাম্বানটোটা বন্দর হস্তান্তরের খবরে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। কিন্তু এ বিষয়ে উদ্বেগের কিছু নেই। আমরা বিভিন্ন ভূরাজনৈতিক উদ্বেগ প্রশমনের উদ্যোগ নিয়েছি।
এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে বাণিজ্য পরিচালনায় অতি গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথের পাশেই হাম্বানটোটা বন্দরের অবস্থান। গভীর সমুদ্রে বন্দরটি অধিগ্রহণের মাধ্যমে চীন ভারত মহাসাগরে সামরিক সুবিধা পেতে পারে বলে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
শ্রীলংকার মন্ত্রী মাহিন্দা সামারাসিংহে বলেছেন, চীন হাম্বানটোটা বন্দর পরিচালনা করবে। কিন্তু বন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্ব শ্রীলংকার হাতেই থাকবে। হাম্বানটোটা বন্দরে কোনো দেশের নৌঘাঁটি হবে না। শ্রীলংকার আইন অনুযায়ী বন্দর পরিচালিত হবে, এ মর্মে আমাদের শর্তে চীন সম্মত হয়েছে।
এর আগে গত সপ্তাহে শ্রীলংকার মন্ত্রিসভা বন্দর হস্তান্তরের চুক্তি অনুমোদন করে। চলতি বছরের শুরুতে এ বিষয়ে শ্রীলংকা ও চীনের মধ্যে প্রাথমিক চুক্তি স্বাক্ষর হয়। ওই চুক্তিতে চীনা কোম্পানি সিএমপোর্টের হাতে হাম্বানটোটা বন্দরের ৮০ শতাংশ মালিকানা হস্তান্তরের কথা বলা হয়। বাকি অংশের মালিকানা রাষ্ট্রায়ত্ত শ্রীলংকা পোর্ট অথরিটির (এসএলপিএ) কাছে থাকবে বলে চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়। বন্দরের পাশাপাশি শ্রীলংকার দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশে চীনের একটি সংরক্ষিত অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার কথাও চুক্তিতে বলা হয়।
চীন ও শ্রীলংকার মধ্যে প্রাথমিক চুক্তি স্বাক্ষরের প্রায় ছয় মাস পর শ্রীলংকার মন্ত্রিসভা গত সপ্তাহে বন্দর হস্তান্তরের (সংশোধিত) চুক্তি অনুমোদন দেয়। চুক্তির বিষয়ে শ্রীলংকার অভ্যন্তরে মতভিন্নতা ও আপত্তির কারণে মন্ত্রিসভার অনুমোদন বিলম্বিত হয়। সংরক্ষিত অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য জমি অধিগ্রহণ হবে, এ মর্মে আশঙ্কা থেকে হাম্বানটোটার স্থানীয় মানুষ চুক্তির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে।
চীন বন্দরটিকে সামরিক প্রয়োজনে ব্যবহার করবে বলে কয়েকটি রাজনৈতিক দল অভিযোগ তোলে। বন্দর অধিগ্রহণের সুবাদে ভারত মহাসাগরে ব্যস্ত সমুদ্রপথে চলাচলরত জাহাজে জ্বালানি বিক্রির (বাংকারিং) ব্যবসাটি চীন অধিকার করে নেবে বলে সিলন পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের শ্রমিক ইউনিয়ন বিক্ষোভের ডাক দেয়। শ্রীলংকার সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসের নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল চুক্তিটি পার্লামেন্টে অনুমোদনের জন্য উত্থাপনের দাবি জানায়।
বিভিন্ন পক্ষের আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে শ্রীলংকার মন্ত্রিসভা চুক্তিটি আংশিক সংশোধন করে। চীনের কাছে হস্তান্তরযোগ্য মালিকানার সীমা ৮০ থেকে কমিয়ে ৬৯ দশমিক ৫৫ শতাংশে আনা হয়।
সংশোধিত চুক্তি অনুযায়ী, সিএমপোর্ট হাম্বানতোতা বন্দরের ৬৯ দশমিক ৫৫ শতাংশ মালিকানায় থাকবে। বাকি ৩০ দশমিক ৪৫ শতাংশ মালিকানা এসএলপিএর হাতে থাকবে। বন্দর অধিগ্রহণের বিনিময়ে সিএমপোর্ট শ্রীলংকাকে ১ কোটি ১২ লাখ ডলার মূল্য পরিশোধ করবে। চুক্তি অনুযায়ী হাম্বানটোটা মাগামপুরা পোর্টের নাম পাল্টে হাম্বানটোটা ইন্টারন্যাশনাল পোর্ট হোল্ডিংস রাখা হবে।
কলম্বো গেজেটের খবরে বলা হয়েছে, চুক্তির আলোকে শ্রীলংকা ও চীন হাম্বানটোটা ইন্টারন্যাশনাল পোর্ট হোল্ডিংসে হাম্বানটোটা ইন্টারন্যাশনাল পোর্ট সার্ভিসেস কোম্পানি নামে একটি টার্মিনাল গড়ে তুলবে। সিএমপোর্ট এ টার্মিনালে ৬০ কোটি ৬০ লাখ ডলার বিনিয়োগ করবে এবং ৪৯ দশমিক ৩ শতাংশ শেয়ার ধারণ করবে। বাকি ৫০ দশমিক ৭ শতাংশ শেয়ার এসএলপিএর অধিকারে থাকবে।
এছাড়া হাম্বানটোটা ইন্টারন্যাশনাল পোর্ট গ্রুপের অধীনে ৭৯ কোটি ৪০ লাখ ডলার ব্যয়ে বন্দরের এসআইজিটি ও সিআইসিটি টার্মিনাল উন্নয়ন করা হবে। এ দুটি টার্মিনালে সিএমপোর্ট ও এসএলপিএর মালিকানা হবে যথাক্রমে ৮৫ শতাংশ ও ১৫ শতাংশ।
হাম্বানটোটা বন্দর হস্তান্তরের চুক্তিটি আবারো শ্রীলংকার মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করা হবে বলে মাহিন্দা সামারাসিংহে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, হাম্বানটোটা একটি লোকসানি বন্দর। ২০১৫ সাল থেকে এ বন্দর মাত্র ৪৪টি জাহাজ হ্যান্ডল করেছে। বন্দরের জন্য চীনের কাছ থেকে যে ঋণ নেয়া হয়েছে, নতুন চুক্তির মাধ্যমে সেটাই পরিশোধের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এর আগে শ্রীলংকার কলম্বো গভীর সমুদ্রবন্দর অধিগ্রহণ করে সিএমপোর্ট। চীনা কোম্পানিটি এক দশকের বেশি সময় ধরে বন্দরটি পরিচালনা করছে। শ্রীলংকার সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসের সময়ে এ অধিগ্রহণ চুক্তি হয়।
রাজাপাকসের ক্ষমতাকালের শেষ বছর অর্থাত্ ২০১৪ সালে কলম্বো গভীর সমুদ্রবন্দরে চীনের দুটি সাবমেরিন নোঙর করায় ভারত ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল। ২০১৫ সালে শ্রীলংকার নতুন প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কলম্বো সফর করেন।
এর কিছুদিন পর চীনা একটি সাবমেরিন কলম্বোয় নোঙরের আগ্রহ প্রকাশ করলে শ্রীলংকা কর্তৃপক্ষ তা প্রত্যাখ্যান করে। গতকালের চুক্তি স্বাক্ষরের পর শ্রীলংকার মন্ত্রী মাহিন্দা সামারাসিংহে বলেছেন, বিদেশী কোনো সামরিক নৌযান কেবল শ্রীলংকার অনুমোদনক্রমেই হাম্বানটোটায় নোঙর করতে পারবে।
Posted ২:৪৪ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ৩০ জুলাই ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta