কক্সবাংলা ডটকম :: সাম্প্রতিক কোনো বছর সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে এত করুণ দশা দেখা যায়নি। সঞ্চয়পত্র কেনার চেয়ে মানুষ ভাঙাচ্ছে বেশি। গত নভেম্বর মাসে গ্রাহকরা যে পরিমাণ কিনেছেন, ভাঙিয়েছেন তার চেয়ে ৯৭৮ কোটি টাকা বেশি। গত সেপ্টেম্বর থেকে এ প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে কেনার চেয়ে ভাঙানো বেড়েছে ১ হাজার ৬১১ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, উচ্চ মূল্যস্ফীতিসহ বিভিন্ন কারণে নতুন করে সঞ্চয় প্রবণতা এমনিতেই কমেছে। সংসার চালাতে হিমশিম খেয়ে কেউ কেউ জমানো টাকা তুলে খরচ করছিলেন। এর মধ্যে গত কয়েক মাস ধরে যথাসময়ে টাকা ফেরত পাওয়া যাবে না—এমন গুজবের কারণে অনেকে সঞ্চয়পত্র বা ব্যাংকে জমানো টাকা ভাঙিয়ে কাছে রাখছেন।
আগ থেকেই আর্থিক প্রতিষ্ঠানে টাকা রাখার প্রবণতা কমেছে। আবার দীর্ঘদিন ধরে শেয়ারবাজারেও মন্দাভাব কাটছে না। আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে সঞ্চয় প্রবণতা কমার কারণে মানুষের হাতে নগদ টাকা অনেক বেড়েছে।
গত অক্টোবর শেষেও যেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাইরে ছিল ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। গত সপ্তাহে তা অনেক বেড়ে ২ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকায় ওঠে। অবশ্য গত কয়েক দিনে ঘরে রাখা কিছু কিছু টাকা আবার ব্যাংকে আসতে শুরু করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে মোট ৩৪ হাজার ৯৩৪ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। একই সময়ে ভাঙানো হয়েছে ৩৬ হাজার ৫৪৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু গত নভেম্বর মাসে ৬ হাজার ৮৯০ কোটি টাকা বিক্রির বিপরীতে ভাঙানো হয় ৭ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা।
মূলত গত সেপ্টেম্বর মাস থেকে কেনার চেয়ে ভাঙানো বেড়েছে। তবে দিনে দিনে এ প্রবণতা বাড়ছে। গত সেপ্টেম্বরে কেনার চেয়ে বেশি ভাঙানো হয় মাত্র ৭১ কোটি টাকা। অক্টোবরে ভাঙানো বেড়েছে ৯৬৩ কোটি টাকা। আর নভেম্বরে আরও বেড়ে ৯৭৮ কোটি টাকায় ঠেকেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে যেখানে ভাঙানোর চেয়ে বিক্রি বেশি হয় ৪০১ কোটি টাকা।
সব মিলিয়ে সঞ্চয়পত্রে সরকারের মোট ঋণ কমে ৩ লাখ ৬২ হাজার ৩৯৯ কোটি টাকায় নেমেছে। গত আগস্ট শেষে যা ৩ লাখ ৬৪ হাজার ৪১১ কোটি টাকা ছিল। এ সময়ে প্রবাসীদের মধ্যে সঞ্চয় ভাঙানোর প্রবণতা বেশি দেখা যাচ্ছে। সব মিলিয়ে প্রথম পাঁচ মাসে প্রবাসী তিন বন্ডে ৪৬৬ কোটি টাকা বিক্রি হয়েছে। এর বিপরীতে ভাঙানো হয় ১ হাজার ১১৮ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে প্রবাসী বন্ড ভাঙানো বেড়েছে ৬৫২ কোটি টাকা।
সাম্প্রতিক কোনো বছর সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে এত করুণ দশা দেখা যায়নি। গত অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি বেশি হয় ১০ হাজার ২৬ কোটি টাকা। এর পর গত অর্থবছরের পুরো সময়ে নিট বিক্রি হয় ১৯ হাজার ৯১৬ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে নিট ৪১ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা পায় সরকার। অবশ্য সঞ্চয়পত্রের বিপরীতে সরকারের সুদ ব্যয় অনেক বৃদ্ধির ফলে কয়েক বছর এখানে ঋণ কমাতে চাচ্ছে সরকার।
এ জন্য সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিভিন্ন শর্ত আরোপ করা হয়েছে। তবে এমন একসময়ে সঞ্চয়পত্রে সরকারের ঋণ কমছে, যখন দেশের অনেক ব্যাংক তারল্য সংকটে পড়েছে। সরকারের ঋণের চাহিদাও বেড়েছে। যে কারণে এখন চাহিদা মেটাতে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া বাড়িয়েছে সরকার।
সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কমতে কমতে প্রায় তলানিতে নেমেছে। বলা যায়- অনেকটা উল্টোরথে ছুটছে সাধারণ মানুষের সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে পরিচিত এ খাতটি। সুদের হার কমার পাশাপাশি বিভিন্ন কড়াকড়ি আরোপে সঞ্চয়পত্র বিক্রির চেয়ে সুদ-আসল পরিশোধে বেশি টাকা ব্যয় হচ্ছে।
এর ফলে এ খাত থেকে কোনো ঋণ নিতে পারছে না সরকার। উল্টো ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধ করতে হচ্ছে। এতে বাড়ছে ব্যাংকঋণের পরিমাণ। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
তথ্য মতে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি এক হাজার ৬১১ কোটি টাকা ঋণাত্মক (নেগেটিভ) হয়েছে। অর্থাৎ এ পাঁচ মাসে যত টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে, তা দিয়ে গ্রাহকদের আগে বিনিয়োগ করা সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। উল্টো এই পরিমাণ টাকা সরকার তার কোষাগার থেকে অথবা ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়ে শোধ করেছে।
এ ব্যাপারে পিআরআইএর নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, সুদের হার হ্রাস ও নানা ধরনের কড়াকড়ি আরোপের কারণে মানুষের সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে গেছে। সে কারণেই নিট বিক্রি নেগেটিভ হয়েছে। সরকারকে কোষাগার থেকে সুদ-আসল পরিশোধ করতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, বাজারে সব জিনিসের দামই চড়া। সরকারি হিসাবেই মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশ। পরিবহন, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ অন্য সব খাতেই খরচ বেড়েছে। এতে মানুষের সঞ্চয় করার ক্ষমতা কমে গেছে। এর প্রভাব পড়ছে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে। সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, সবশেষ নভেম্বর মাসে মোট ৬ হাজার ৮৮৯ কোটি ৮৭ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। মুনাফা ও আসল পরিশোধ করা হয়েছে ৭ হাজার ৮৬৮ কোটি ২৫ লাখ টাকা। ফলে নিট বিক্রির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ঋণাত্বক ৯৭৮ কোটি ৩৯ লাখ টাকা।
আর সব মিলিয়ে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে অর্থাৎ জুলাই-নভেম্বর সময়ে মোট ৩৪ হাজার ৯৩৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এর বিপরীতে মুনাফা ও মূল বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে ৩৬ হাজার ৫৪৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এই পাঁচ মাসে সঞ্চয়পত্র খাতে যা বিনিয়োগ হয়েছে তার চেয়ে এক হাজার ৬১১ কোটি টাকা বেশি পরিশোধ করেছে সরকার।
অক্টোবর মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি ৯৬৩ কোটি ১৬ লাখ টাকা ঋণাত্মক (নেগেটিভ) ছিল। আগের মাস সেপ্টেম্বরেও নিট বিক্রি ৭০ কোটি ৬৩ হাজার টাকা ঋণাত্মক (নেগেটিভ) ছিল। তার আগের মাস আগস্টে নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল মাত্র ৮ কোটি টাকা। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ৩৯৩ কোটি ১১ লাখ টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল।
বিক্রির চাপ কমাতে ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে মুনাফার ওপর উৎসে করের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। একই সঙ্গে এক লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে টিআইএন (কর শনাক্তকরণ নম্বর) বাধ্যতামূলক করা হয়। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট না থাকলে সঞ্চয়পত্র বিক্রি না করার শর্ত আরোপসহ আরো কিছু কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়। তারপরও বাড়তে থাকে বিক্রি।
সর্বশেষ সঞ্চয়পত্র খাতে সরকারকে যাতে বেশি সুদ পরিশোধ করতে না হয়, সে জন্য বিক্রি কমাতে গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ২ শতাংশের মতো কমিয়ে দেয় সরকার। এর পর থেকেই বিক্রি কমছে।
বাজেট ঘাটতি মেটাতে চলতি অর্থবছর সঞ্চয়পত্র থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে সরকার। এর বিপরীতে প্রথম পাঁচ মাসে এই খাত থেকে কোনো ঋণ পায়নি সরকার, উল্টো এক হাজার ৬১১ কোটি টাকা কোষাগার থেকে অথবা ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়ে শোধ করেছে। অর্থনীতি বিশ্লেষকরা আরো জানিয়েছেন, আড়াই বছরের করোনা মহামারির কারণে মানুষের আয়-উপার্জন কমে গেছে। অনেকে চাকরি হারিয়ে গ্রামে চলে গেছেন। কারো বেতন কমেছে। এরপর শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এই ধাক্কায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশে ডলারের বিপরীতে টাকার ব্যাপক দরপতন হয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়াতে বাধ্য হয়েছে সরকার। বাজারে জিনিসপত্রের দাম এমনিতেই বেশি ছিল। যুদ্ধের কারণে তা আরো বেড়ে গেছে।
এর ফলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় অর্থাৎ বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় মানুষের সঞ্চয় করার ক্ষমতা কমে গেছে। এ কারণে মানুষ আর আগের মতো সঞ্চয়পত্র কিনতে পারছে না।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হালনাগাদ তথ্য বলছে, পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসভিত্তিক) গত নভেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ। অক্টোবরে ছিল ৮ দশমিক ৯১ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে ৯ দশমিক ১০ শতাংশ এবং আগস্টে ছিল আরো বেশি ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। অন্যদিকে সর্বশেষ নভেম্বরে মজুরি সূচক ছিল ৬ দশমিক ৯৮ শতাংশ।
গত ২০২১-২২ অর্থবছরে সব মিলিয়ে ১ লাখ ৮ হাজার কোটি টাকার বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়। এর মধ্যে গ্রাহকদের মূল টাকা (বিনিয়োগ) ও মুনাফা (সুদ) বাবদ পরিশোধ করা হয় ৮৮ হাজার ১৫৪ কোটি টাকা। যার মধ্যে সরকারকে সুদ পরিশোধ করতে হয়েছে ৪০ হাজার কোটি টাকা। অর্থবছর শেষে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধের পর এ খাতে সরকারের নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ১৯ হাজার ৯১৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৫২ দশমিক ৪৪ শতাংশ কম। ২০২০-২১ অর্থবছরে নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৪১ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকা।
২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে ৩২ হাজার কোটি টাকার ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ধরেছিল। সে হিসাবে দেখা যায়, গত অর্থবছরে লক্ষ্যের চেয়ে এই খাত থেকে ৩৭ দশমিক ৫০ শতাংশ কম ঋণ নিয়েছিল সরকার।
২০২০-২১ অর্থবছরে মোট ১ লাখ ১২ হাজার ১৮৮ কোটি ২৪ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়। এর মধ্যে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল বাবদ ৭০ হাজার ২২৯ কোটি টাকা গ্রাহকদের পরিশোধ করা হয়। সে হিসাবে নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৪১ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা।
Posted ১২:৩৫ অপরাহ্ণ | শুক্রবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২২
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta