কক্সবাংলা ডটকম(২৩ অক্টোবর) :: ২৪ ঘণ্টার ঝটিকা সফরে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ কি বার্তা দিলেন বাংলাদেশকে? সুষমার চলে যাবার পর এটাই এখন বিশ্লেষণের বিষয়।
গত এক দশক ধরে ভারতই বাংলাদেশে শেষ কথা। একটা সময় ছিল যখন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করতো। বাংলাদেশ যতদিন পর্যন্ত বিদেশী সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল, ততদিন ইউরোপীয় ইউনিয়নের কথাও শুনতে হতো বাংলাদেশের।
কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ যত এগিয়েছে তত বাংলাদেশের ব্যাপারে ইউরোপ আমেরিকার হস্তক্ষেপ কমেছে। ভূ-রাজনীতির কৌশল হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, এমনকি জাপান এখন ভারতের হাতেই ছেড়ে দিয়েছে বাংলাদেশের ভার। ভারত যা বলে সেটাই মেনে নেয় অন্য রাষ্ট্রগুলো।
বিশেষ করে ২০১৪ নির্বাচনে ভারত একাই সমর্থন দিয়ে তার শক্তির প্রমাণ দেয়। তাই নির্বাচনের ঠিক এক বছর আগে সুষমার সফর নিয়ে রাজনৈতিক মহলের আগ্রহ ছিল অনেক। বিএনপির একাধিক নেতা স্বীকার করেছেন, সুষমার জন্যই বেগম জিয়া লণ্ডন থেকে ঢাকায় ছুটে এসেছেন।
সুষমা স্বরাজের ২৪ ঘণ্টার বৈঠকে সবচেয়ে অনালোচিত বৈঠকটি ছিল সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ। রাত সাড়ে আটটায় তিনি সাক্ষাৎ করেন জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদের সঙ্গে। এর মাধ্যমে সুষমা বর্তমান সংসদকে আস্থায় আনলেন। এই সংসদ যে ভারতের কাছে গ্রহণযোগ্য সে বার্তাটা দিয়েছেন।
মিডিয়ার সবচেয়ে লোভনীয় বিষয় ছিল সুষমা-খালেদা বৈঠক। ৫০ মিনিটের এই বৈঠকে বিএনপি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরেন। সুষমা নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেওয়ার জন্য বিএনপিকে ধন্যবাদ জানান। তিনি নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা সম্পর্কে জানতে চান। সাংবিধানিক বিষয়গুলো নিয়েও খোঁজ-খবর নেন। নির্বাচন কমিশনের ব্যাপারে সুষমার আগ্রহ একটি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে।
সেটি হলো ভারত নির্বাচন কমিশনের নেতৃত্বে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চায়। যে নির্বাচন হবে সংবিধানিক কাঠামোর মধ্যেই। ‘সহায়ক সরকার’ বিষয়টি সুষমার এজেন্ডায় ঠাঁই পায়নি। এমনকি ভারতীয় দূতাবাসে নিজস্ব কর্মকর্তাদের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায়, নির্বাচন কমিশন কেন্দ্রিক অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন প্রস্তাবনা নিয়েই তিনি কথা বলেছেন।
বেগম জিয়ার সঙ্গে একান্ত বৈঠকে সুষমা স্বরাজ ‘তারেক জিয়া’ যে ভারতের মাথাব্যাথার কারণ তা স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছেন। সাথে এটাও স্পষ্ট করেছেন, বিএনপি কার সঙ্গে চলে, কোথায় মিটিং করে- সব খবরই ভারতের কাছে আছে।
সুষমার সবচেয়ে ইস্যুহীন বৈঠক ছিল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। সুষমার পছন্দের নারী নেতাদের মধ্যে শেখ হাসিনা সেরা। এটা সুষমা তাঁর ‘ওমেন ইন পলিটিক্স’ লেখায় বহু আগেই লিখেছেন। প্রাধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে সুষমা তাঁর (শেখ হাসিনার) স্বাস্থ্যের খোঁজ-খবর নিয়েছেন। দুজন হাসিঠাট্টাও করেছেন। এখানে রোহিঙ্গা নিয়েও কথা হয়েছে।
কথা হয়নি শুধু নির্বাচন নিয়ে। এর অর্থ দাঁড়াল ‘নির্বাচন’কে এখনো ভারত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে দেখছে না। সেজন্যই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে এ প্রসঙ্গই আসেনি।
তাই যদি হবে, তাহলে সুষমা স্বরাজ ঢাকঢোল পিটিয়ে বেগম জিয়ার সঙ্গে নির্বাচনী সংলাপ করলেন কেন?
উত্তর দিলেন, ভারতেরই কূটনীতিক। ‘বাংলাদেশ তো একটু চীনে ঝুঁকেছে তাই আমরাও একটু বিএনপিতে ঝুঁকে দেখালাম, কেমন লাগে।’
আওয়ামী লীগকে ভয় দেখাতেই কী তাহলে জোর করে বেগম জিয়ার সঙ্গে এই বৈঠকের আয়োজন? আওয়ামী লীগকে বুঝিয়ে দেওয়া যে, তোমরা চীনপন্থী হলে আমাদেরও বিকল্প প্রস্তুত। সুষমার ঝটিকা সফরের সারমর্ম এটাই।
বাংলাদেশে আগামী সংসদ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ দেখতে চায় ভারত, এই রাজনৈতিক বার্তাটি দিয়ে গেলেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ।
রবিবার (২২ অক্টোবর) দু’দিনের সফরে ঢাকা আসেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের পাশাপাশি তিনি জয়েন্ট কনসালটেটিভ কমিশনের চতুর্থ বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরের সঙ্গে জড়িত এমন একটি সূত্র জানায়, তার রাজনৈতিক বার্তা হচ্ছে- আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হতে হবে। তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন এবং তাদের দু’জনের মধ্যে আধা ঘণ্টা একান্ত আলোচনা হয়।
আরেকটি সূত্র জানায়, এমাসে ভারতের অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি এবং ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) জাতীয় সাধারণ সম্পাদক রাম মাধব ঢাকায় সফরে এসে একই বার্তা দিয়ে গেছেন আওয়ামী লীগ সরকারের নেতাদের।
তিনি বলেন, ‘‘নির্বাচনের সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা নির্বাচিত সরকার ব্যতীত অন্য সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের বিষয়ে সুষমা স্বরাজ জানিয়ে দিয়েছেন যে, ‘জেলা প্রশাসকরা তাদের এখন স্যার বলেন। তাদের (জেলা প্রশাসক) কাছেই তাদের (নেতাদের) নমিনেশন পেপার জমা দিতে হয়। এ ব্যবস্থা গত ৭০ বছর ধরে ভারতে চলে আসছে।’ অন্য কোনও দেশে এ ধরনের ব্যবস্থার ব্যত্যয় সম্পর্কে তাদের কোনও মন্তব্য নেই।’’
ভারতে বাংলাদেশ মিশনে ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়া অনুবিভাগে কাজ করেছেন, এমন একজন সাবেক কূটনীতিক বলেন, ‘তারা বেশ কিছুদিন ধরে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলছে। এটি ভালো দিক।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে নির্বাচন কমিশন কাজ করছে। সামনের দিনগুলোতে এই কার্যক্রম আরও গতি পাবে। যদি সব কার্যক্রম মসৃণ গতিতে সম্পন্ন হয়, তাহলে কোনও সমস্যা নেই। আর কোনও ঝামেলা যদি তৈরি হয়, তবে কার কী অবস্থান, সেটি আরও পরিষ্কার বোঝা যাবে।’
সাবেক এই কূটনীতিক বলেন, ‘ভারত সবসময় বলে- তারা অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলায় না। কিন্তু তাদের সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জীর আত্মজীবনীতে বাংলাদেশ বিষয়ে ভারতের আগ্রহের কথা ব্যক্ত করা হয়েছে।’
রোহিঙ্গা ইস্যু
সরকারের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘রোহিঙ্গা ইস্যুটি সুষমা স্বরাজের সফরের সময়ে জোরালো ভাবে এসেছে। দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে এবং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের সময় বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সমস্যার বিভিন্ন দিক তুলে ধরে।’
তিনি বলেন, ‘ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার বক্তব্যে বলেছেন, রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়াটাই দীর্ঘমেয়াদী সমাধান, যা বাংলাদেশের অবস্থানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতের সমর্থন বাংলাদেশের জন্য জরুরি এবং এক্ষেত্রে ঢাকা শুধু মানবিক সহায়তা নয়, রাজনৈতিক সমর্থনও আশা করে, সেটি দিল্লিকে বলা হয়েছে।’
এই কর্মকর্তা বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের জন্য ভারত মানব্কি সহায়তার অংশ হিসেবে ত্রাণ সহায়তা দিয়েছে বাংলাদেশকে।’
আজ সোমবার বারিধারায় ভারতীয় হাইকমিশনের নতুন চেন্সারি ভবন এবং ভারতীয় অর্থায়নে বাংলাদেশের ১৫টি প্রকল্পের উদ্বোধন করতে গিয়ে সুষমা স্বরাজ এসব কথা বলেন।
সুষমা স্বরাজ জানান, দুই দেশের শীর্ষ ব্যক্তিদের মধ্যে আনুষ্ঠানিক নয়, পারিবারিক সম্পর্ক বিরাজ করছে।
ভারত ও বাংলাদেশের দেশাত্মবোধক গান আর নাচ দিয়ে স্বাগত জানানো হয় দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ অন্য অতিথিদের। ভারতীয় হাইকমিশনের নিজস্ব চেন্সারি ভবনের এই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের বিভিন্ন পেশার বিশিষ্টজনরা উপস্থিত ছিলেন।
দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ, আবুল হাসান মাহমুদ আলী এবং বাংলাদেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ভারতীয় অর্থায়নে বাংলাদেশের ১৫টি প্রকল্পের উদ্বোধন করেন।
সুষমা স্বরাজ বলেন, ‘ভারতের কূটনীতিতে প্রতিবেশী দেশগুলো সব থেকে আগে প্রাধান্য পায়। আর এসব দেশের মধ্যে সবার প্রথমে আছে বাংলাদেশ। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে অমীমাংসিত বিষয়গুলো সততার সঙ্গে দুই দেশ মিলেই সমাধান করবে। দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর বড় অবদানের কারণে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার সম্পর্ক বাড়ছে।’
সুষমা স্বরাজের বিশ্বাস, এই গতিতেই দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক আরো সামনের দিকে এগিয়ে যাবে।
ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘ভারত ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার ছিল দুই দেশের নাগরিকদের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানো। আর তারই প্রমাণস্বরুপ চলতি বছর প্রায় ১৪ লাখ বাংলাদেশিকে ভারতীয় ভিসা দেওয়ার আশা করছে তারা। দুই দেশের সম্পর্ক অতীতের যেকোনো সময়ের থেকে সবচেয়ে ভালো বলেও জানান ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী।’
এ সময় ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত ও হিন্দি বিভাগের প্রধানদের হাতে ভারতের অনুদানের অর্থ দিয়ে ক্রয়কৃত সামগ্রী তুলে দেন সুষমা স্বরাজ।
Posted ১:৫৩ পূর্বাহ্ণ | মঙ্গলবার, ২৪ অক্টোবর ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta